শিরোনাম: |
বাঙালির বর্ষবরণ
|
আসছে ১৪২৫ বাংলাবর্ষ। পয়লা বৈশাখ দেশের সর্বত্র বর্ষবরণ উত্সবে মেতে উঠবে বাঙালি জাতি। বৈশাখি বাতাস বা বৈশাখি ঝড় না হোক তবু চৈত্র শেষ হলে আমরা অনুভব করি, বৈশাখের আগমন, হালখাতা মহরত্, নতুনখাতা পূজা, চড়ক পূজা, মহামেলা- ইত্যাদি। বৈশাখি মেলা-উত্সব আমাদের মন রাঙিয়ে দিয়ে যায়। সত্যিই বর্ষবরণ উত্সবটা হয়ে ওঠে মুখ্য। এদিন বাঙালি বহু বছর ধরে ফুরফুরে মেজাজে সময় পার করতো। নববর্ষের আগের দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা শুরু হবে। কোথাও কোথাও শুরু হবে পক্ষকালব্যাপী চড়ক পূজা ও মেলা। উত্সবে সবাই এসে আনন্দ উপভোগ করবে—এই তো আমাদের চাওয়া। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বর্ষবরণ উত্সব বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করার যে সিদ্ধান্তটি বেঁধে দেয়া আছে তা কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ কতিপয় অপশক্তির ভয়ে ভীত হয়ে আমরা কেন সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান করে ঘরে ফিরবো? বর্ষবরণ উত্সব বাঙালির প্রিয়, বড্ড প্রিয়, বড়ই আনন্দের- তাই আমরা চাই উত্সব হোক গভীর রাত অবধি। নিরাপত্তা বাহিনী উত্সব এলাকা অবশ্য অবশ্যই নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দিবেন। হাতেগোনা কতিপয় দুর্বৃত্ত আজও বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। ওই দুর্বৃত্তরাই আবার আমাদের স্বাধীনতার স্লোগান ‘জয় বাংলা’ এবং জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এরা বর্ষবরণ উত্সবকে কটুক্তি করে নানা রকম বাজে মন্তব্যও করে থাকে। ওরা হয়তো ভুলে গেছে কিংবা জানেই না যে, মুঘল সম্রাট আকবর এবং পরবর্তীকালের স,্রাটগণ বাংলা নববর্ষে নানা রঙের উত্সব আয়োজন করতেন। বিশাল মেলা বসাতেন, সেই মেলা ও বর্ষবরণ উত্সবে দলে দলে হিন্দু-মুসলমানরা আসতেন। বিভিন্ন বাজনাদারের দল ঢোল, বাদ্য ও বাজনা বাজাতো।
যারা বর্ষবরণ বিরোধী কিংবা সাম্প্রদায়িক মনোভাপন্ন, এরা চিহ্নিত প্রয়োজনে এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে এবং অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন উত্সব সফল করার জন্য যা যা করণীয় তাই করা উচিত। তাছাড়া আমরা এ-ও মনে করি, আমরা বাঙালি বীরের জাতি তাই বর্ষবরণ উত্সব তড়িঘড়ি শেষ করে সূর্যাস্তের আগেই ঘরে ফিরে যেতে চাই না। শুধুই বলবো ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে, মোদের ততই বাঁধন টুটবে। ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে মোদের আঁখি ফুটবে, ততই মোদের আঁখি ফুটবে। ... তোরা ভরসা না ছাড়িস কভু, জেগে আছেন জগত্ - প্রভু—- ওরা ধর্ম যতই দলবে ততই ধূলায় ধ্বজা লুটবে, ওদের ধূলায় ধ্বজা লুটবে।’ চৈত্রের শেষে মেলা বসতো বাংলাদেশের প্রতিটি মফস্বল শহরে, গাঁও-গ্রামের কোথাও কোথাও। প্রায় পনেরো দিন ধরে সেই বর্ষবরণ মেলা চলতো। সেই মেলার ঐতিহ্য ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ছিল। হরেক রকম খেলনা মিলত, সেই খেলনা এখন আর মেলে না বৈশাখি মেলাতে। তখনকার দিনে মেলার আয়োজক ছিলেন হিন্দু জমিদাররা কিংবা প্রভাবশালী হিন্দু পরিবারের লোকজন। যে জন্য মেলায় ঢাক-ডোল বাদ্য বাজতো। কীর্তনের আসর বসতো। চড়কের মেলায় চড়কের খেলাও হতো। সব বয়সী লোকজন এসে ভিড় করতেন। মনে হতো, চূড়ান্ত আনন্দ উপভোগ ওখানেই হতো। মেলায় আলাদা একটা গন্ধ ভেসে বেরাত। কোথায় যেন সেই কবে হারিয়ে গেছে সেই গন্ধ। এতদিন বাদে আজ মনে হয়, সে দিনের মেলায় ফুলের গন্ধ মেখে বাতাস একটি নিঃশ্বাস ফেলে যেত। মেলায় ঢুকলে মনে মনে ভাবতাম, মেলায় আসার ছন্দ আমায় দিল বুঝি আনন্দ। মনে আছে, শৈশবে পিরোজপুরে মেলার আয়োজক অসিত সেনের সেই মেলায় যাওয়ার কথা। তার বাড়ির সামনেই বসতো মেলা। সেই অসিত সেনও নেই, তার আয়োজনে মেলাও আর বসে না। সে তো প্রায় ৫০ বছর হয়ে এলো। ওই পথে গেলে আজ মনে হয়, ঐতিহ্যবাহী সেই মেলা ফুরাল-আহা কোথায় গেল সেই দিন। আজকালকার মেলা দেখলে মনে হয়, এ মেলা তো সে মেলা নয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এবং ১৯৭১ সালে দলে দলে প্রভাবশালী ও বিত্তবান হিন্দু পরিবার দেশ ত্যাগ করার কারণেই বাংলা থেকে চৈত্র সংক্রান্তির এবং বৈশাখের সেই ঐতিহ্যবাহী মেলার চির বিলুপ্তি ঘটে। সে দিনের সেই মেলার কোনো রকম ছোঁয়া এখনকার মেলার মধ্যে খুঁজে পাওয়া বড় দায়। - লিয়াকত হোসেন খোকন, ঢাকা। |