বুধবার ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ১৪ কার্তিক ১৪৩১
আমরা একদিনের বাঙালি নই
Published : Thursday, 12 April, 2018 at 6:00 AM, Count : 1124

মীর আব্দুল আলীম : আমরা বৈশাখ এলেই একতারা হাতে ছুটে চলতে চাই কাঙালিনী সুফিয়ার মতো। ঢোল, তবলা, সারিন্দা নিয়ে গেয়ে উঠতে চাই হাছন আর লালনগীতি। গাইতে চাই আবদুল করিমের ‘গাড়ি চলে না চলে না চলে নারে’... কিন্তু বৈশাখ চলে গেলে আমার সেই জ্যৈষ্ঠের খর রোদ্দুরে মলিন হয়ে যাই। হতাশ হয়ে যাই কালবৈশাখীর মতো জীবনের কিছু ঝড়ের কবলে পড়ে। সব যেন শেষ হয়ে যায়। ধুঁয়ে মুছে যায় বাঙালিআনা।
আমরা একদিনের বাঙালি নই। ঘণ্টা, মাস, বছর ধরেই নিজেকে বাঙালি ভাবুন। বৈশাখের প্রথম দিনেও আমরা বাঙালি; চৌত্রের শেষ দিনেও আমরা বাঙালি থাকতে চাই। বছর জুড়ে বাঙালি কি থাকি আমরা? আমাদের নীতি-নির্ধারকরাও এ ব্যাপারে বেশ উদানসীন। তারা ভিনদেশী অপসংস্কৃতিকে ভাড়ায় আনছেন। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আনা হয় ভারতীয় শিল্পীদের। আর আনবেইনা কেন? বাঙালিতো আর বসে নেই। লাখো দর্শক হুমড়ি খেয়ে পরে মাঠে। সরাসরি টিভি চ্যানেলেও ঐ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা। অথচ আমাদের সরকার শত চেষ্টায়ও পার্শ্ববর্তী ভারতে আমাদের টিভি চ্যানেল সম্প্রচারের সুযোগ পাচ্ছে না। ওরা আমাদের শিল্প সাংস্কৃতির শেয়ার নেবে না আর ওদেরটা আমাদের ধরিয়ে দেবে তা কি করে হয়। ওদের নাটক সিনেমার প্রভাব কিন্তু আমাদের সমাজে পরতে শুরু করেছে। সংসারে অশান্তি, কুটিলতা, হত্যা বেড়ে গেছে। কি দেখছি আমরা এসব অনুষ্ঠানে। বাইজিখানায়ওতো সালিনতা থাকে। ডানাকাটা প্রায় উলঙ্গ নারী নাচিয়ে ভারতীয়রা আমাদের পকেট কেটে উড়াল দেয়। এখানেই যদি শেষ হতো না হয় কথা ছিল না। কিন্তু লেগে থাকা ঐ অনুষ্ঠানের নোংরা বিষ্ঠা আমাদের মন থেকে কি মুছে ফেলতে পারছি আমরা?
ডিসেম্বরের থার্টিফাস্ট নাইট নিয়ে কিছু না বললে লেখা অপরিপূর্ণ থেকে যায়। বেহুশ বাঙালি। ফুর্তি করে খায় রঙ্গিন জুস। কেউ থাকে আধাখোলা, কেউ বা থাকে পুরা। ছুঁড়ি বুড়ি সবাই নাচে; কত নারী আপন ছেড়ে পরকে ডাকে কাছে। কে দেশি? কে বিদেশি? বোঝা বড় দায়! ‘একদিন বাঙালি ছিলামরে’ তাই মনে পইড়া যায়। এই হচ্ছে থার্টিফাস্ট নাইট সমাচার। খুবই ঘৃণার সঙ্গে বলতে হয় আজ আমাদের সংস্কৃতিতে চলছে বিদেশি খবরদারি ওপর। হাল জামানার যুবকরা হাছন রাজাকে গাইছে পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র দিয়ে। কলুষিত করছে লালন শাহর সাধকীয় ভাবশৈলীকে। সবকিছুতেই বিদেশি রঙ। যে রঙের ধাঁধায় পড়ে আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রঙের মাঝে মরিচা ধরেছে। একশ্রেণির কিশোর-কিশোরীরা যখন গিটার আর ড্রামস ছাড়া বাংলা গান কি এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে না, সেও যখন হাতে একতারা বা গলায় ঢোল বেঁধে নেয় তখন বুঝতে হবে আকাশে ঝড় মেঘ জমেছে। বৈশাখ মানেই বাঙালির আটপৌরে জীবনে লালের দাপট, ঝড়ের সংকেত আর নতুনের আবাহনে স্টাইলিশ লাইফ। যেটা কেবলই ক্ষণিকের। যখন লিখেছি, যখন আপনারা লেখাটি পড়ছেন তখন হয়তো আমাদের কন্যা-জায়া-জননীগণ টিভিতে দেখছেন ‘সাস ভি কাভি বহু থি’ অথবা ওই টাইপের কিছু। আমরা মাইন্ড করিনি, কষ্ট পাই না। কষ্ট পেলেই কষ্ট হবে মনে। যা রোধ করবার নয়, কষ্ট পেয়ে লাভ কি তাতে?
 আমাদের দেশে হিন্দি সিরিয়ালের ক্রেজকে একটা মহামারীর সঙ্গে তুলনা করাটা বোধহয় ভুল হবে না। আমি অনেক পরিবারে একই সঙ্গে বাবা-মার সঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের গভীর মনোযোগের সঙ্গে হিন্দি সিরিয়াল উপভোগ করতে দেখেছি। দেখেছি কীভাবে তারা অকপটে পারিবারিকভাবে গিলে যাচ্ছেন একের পর এক অসামাজিক কাহিনী যেমন- মালটি-ডাইমেনশনাল পরকীয়া প্রেম, বউ-শাশুড়ির ষড়যন্ত্র, মামার সঙ্গে ভাগ্নীর সম্পর্ক, ডিভোসের্র প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মত জঘন্য কিছু বিষয়। এর অবশ্য একটা ভালো (?) দিক আছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সদস্যরা বাংলার পরিবর্তে হিন্দি বলে যাচ্ছে অনর্গল। তাদের অভিভাবকরাও নিজের সন্তানের মুখ দিয়ে হিন্দি বুলি বের করে বেশ গর্ববোধ করেন। বাংলাদেশে আজকের সামাজিক অবক্ষয় আর পারিবারিক ও সামাজিক সুস্থ নিয়মনীতির ভেঙ্গে পড়ার পেছনে হিন্দি সিরিয়ালের অবদান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়! আর এ প্রশংসার দাবিদার যারা আমাদেরকে এ জাতীয় অনুষ্ঠান যারা দেখবার সুযোগ করে দিচ্ছে তাদের। এ রাষ্ট্র এ জন্য ধন্যবাদ পায় বৈকি!
বছর ঘুরে বৈশাখ আসে, আর আমরা যেন ক্ষণিকের বাঙালি হয়ে যাই! বাঙালি হতে দিকবিদিক ছুটি। পহেলা বৈশাখে ঢাকা শহরেতো হাঁটবার জায়গাও থাকে না। বাঙালি হতে অনেকেই ঘর থেকে ছোটেন, আমি সচরাচর ঘরেই কাঁটাই দিনটা। পহেলা বৈশাখের এই দিনে, আমি একদিনের বাঙালি হতে চাই না। বৈশাখের ঐ বিশেষ দিনটাতে সকালে পান্তা-ইলিশ খাই না। শহরে থাকলেও শরীর থেকে গ্রামের গন্ধ মুছে যায়নি এখনও; মন থেকে মুছে ফেলিনি বাঙালিআনা।
আমি বৈশাখের প্রথম দিনে খুব একটা বাড়াবাড়ি করি না। গত বৈশাখেও আমি বাসায় বসে লিখছি। বাসা একেবারে ফাঁকা। সেদিন পরিবারের সবাই বাঙালি হতে ছুটে গেছেন রমনা বটমূলে। বাসায় যারা কর্ম করেন তারাও কেউ ছিলেন না। সবাই একদিনের বাঙালি সাজে বেরিয়ে পরেন ঘর থেকে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। মসজিদের আজান শুনতে পাই। পেটে বেশ টান ধরেছে। মনে হলো মাঝে মধ্যেইতো নোনা ইলশে পান্তা-শুটকি খাই; বৈশাখের এই দিনটাতে না হয় বিরিয়ানি খাওয়া যাক। হাই প্রেশারের রোগী তবুও মতিঝিলের হাজীর বিরানী খেলাম পেটপুরে। বাসায় ফিরার সময় ক্যাপিটাল থেকে বার্গার, পেস্টি আর স্যান্ডুইস কিনে নিলাম ক’পিছ। ছেলে দুটোর বেশ পছন্দ ওগুলো। সহজে কিনে দেই না বিদেশি ধাঁচের এসব খাবার। আমার অগোচরে বেইলী রোডে গিয়ে খায় মাঝে মাধ্যে। গত বৈশাখে কেন জানি নষ্ট সমাজের কষ্ট বাড়ানো ঐ খাবারগুলোই কিনেছিলাম ওদের জন্য। ঘরে কখনো মুড়ি মুড়কি, কড়ি মুড়ালি, নিমকি কিংবা জিলাপি এনেছিতো আমার ছোট ছেলেটা ভেংচি কাঁটে। ওদের এগুলো মোটেও পছন্দ নয়। বড় ছেলেটাতো বলেই ফেলে বাবা এগুলো ব্যাকডেটেড খাবার। রাগ করি না। ভাবি ওদের কি দোষ? আমরাইতো ওদের সাহেব বানিয়ে ফেলেছি। ওরা বলে পান্তায় নাকি লাখ লাখ ব্যাক্টিরিয়া জন্মে।
আমার দাদাতো এগুলো খেয়েই ১ শ’ ২২ বছর পার করেছেন। মৃত্যুর আগে কোনো রোগবালাই দেখিনি। হাসপাতালে যাননি কখনও। জীবনের শেষ দিনের সকালেও বিনে চশমায় পত্রিকার পড়েছেন। তিনি পাট ব্যবসায়ী ছিলেন। অর্থকড়ি কমতি ছিল না। তবুও তার খাবার তালিকায় ছিল কেবলই বাঙালি খাবার। বিচিকলা, বাঙ্গি, খিরাই, মিষ্টি আলু, ডাল ভাত ছিল প্রিয় খাবার। আমার গিন্নি মাঝে মধ্যে মোড়গ পালাও কিংবা কাচ্ছি বিরিয়ানী পাকালে বলতেন ওসব ছাইপাশ দিওনা ভাত দাও। ভাতের মতই সোজাসাপ্টা কথা দাদার। বাবার মাঝেও ভাব দেখিনি কখনও। বাঙালি মেজাজেই চলেন এখনও। খাবার দাবারেও এখনও তিনি ষোল আনা বাঙালি। দিন যত গড়াচ্ছে, ভাবি ছেলেগুলো বাঙালি থাকবে তো? ভিনদেশী দাপটে ওদের বাঙালি রাখাইতো কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘরে-বাইরে কোথাও বাঙালিআনা নেই। প্রাশ্চাত্ত ঢং সবখানে। পোশাকে, খাবারে, চলাফেরা সবখানেই ভিনদেশী ভাব। কি সাহিত্যে, কি চলচিত্রে সব জায়গায়ই বাঙালি হটাও মনভাব। শতাধিক টিভি চ্যানেলে নাচ-গান আর পরকিয়া মার্কা নাটক সিনেমায় আমাদের বাঙালি থাকাই দায়। লাভ ইন সিঙ্গাপুর মার্কা চলচ্চিত্র আমাদের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান সব কিছুতেই কেমন জেন সাহেবী মেজাজ। এগুলো দেখে আমাদের আগামী প্রজন্ম বাঙালি থাকে কি করে?  
আমাদের সাবধান হতে হবে। বাঙালি মনকে আরও শানিত করতে হবে, মনের ভেতরকার জং মুছে ফেলতে হবে; আরও গভীর থেকে দেশকে ভালোবাসতে হবে, বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে হবে। আমি বাঙালি, এটা ভেতরে লালন করতে হবে। নিজেদের পরিচয় নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো শক্তি জোগাতে হবে। গুরুসদয় দত্ত তার গানে বলেছিলেন ‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ, বাঙালি হ, বাঙালি হ।’ অর্থাত্ সাহস জোগাতে হবে। আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে নিজের ভেতরে। কেবল বৈশাখে নয়, বাঙালি হয়ে যেতে হবে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। যেন স্মৃতি হাতড়ে না বলতে হয়, ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে...। একদিন বাঙালি ছিলাম রে...।’
লেখক: সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft