শিরোনাম: |
উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ: নতুন উচ্চতায় বাংলাদেশ
|
মোতাহার হোসেন : রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা খিলগাঁওয়ের আমতলায় অফিস সময়ে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সামনের ফুটপাতে সারিবদ্ধভাবে বসে আছেন নানা বয়সী দরিদ্র, অস্বচ্ছল, পঙ্গু, বিধবা, বয়োবৃদ্ধ নারী ও পুরুষ। এটি প্রতি মাসের শেষ সপ্তাহের অফিস সময়ের নিয়মিত চিত্র। এ রকম একদিন ওই রাস্তা পার হওয়ার সময় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনতে চাইলাম তারা কি জন্য বসে আছেন, কি চান তারা। উত্তর মেলে সহজেই। এরা সবাই দুঃস্থ ভাতার উপকারভোগী। একজন অন্যজনকে বলছেন নিজের জীবনের কথা, এই ভাতা না পেলে তাকে না খেয়ে মরতে হতো, এই টাকা জমিয়ে রেখে তার মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন- এমন নানান কথা।
একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্য এ ধরনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকা অপরিহার্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে এ ধরনের ভাতার প্রচলন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আরও বিস্তৃত পরিসরে ভাতা দেয়া অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে মাসিক সম্মানি ভাতা দেয়া হচ্ছে। দিন দিন এসব ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা এবং আর্থিক সহায়তার পরিমাণও বাড়ছে। এ ধরনের কর্মসূচি সম্ভব হয়েছে সরকারের সদিচ্ছা ও দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা শক্তিশালী হওয়ায়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হয়েছে। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য গর্বের। এই অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে অনন্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হলো। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যে তিনটি সূচক রয়েছে, সব সূচকেই বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক-একাধারে তিনটি সূচকেই যোগ্যতা অর্জন নিঃসন্দেহে একটি বিরল ঘটনা। ২০০৮ সালে সরকার একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২১ প্রণয়ন করে। ঐ পরিকল্পনায় ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কার্যপদ্ধতি ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী উন্নয়ন ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের পথে উত্তরণ পর্বটি জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এখন উন্নয়নশীল বিশ্বের রোল মডেল হচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়ায় বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা ও অবস্থান আরও সুসংহত হবে। আন্তর্জাতিক ঋণ বাজার থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি হবে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এখন কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে গণ্য করা হবে। এতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি দেশের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও যুক্ত হতে পারে। বিশেষ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত কঠিন হতে পারে, রফতানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা সংকুচিত হতে পারে। প্রসঙ্গত বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ ঘোষণা করে তালিকা প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংক মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে। একটি হচ্ছে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, অন্যটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। প্রতিবছর ১ জুলাই বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় অনুসারে দেশগুলোকে চারটি গ্রুপে ভাগ করে। যাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ মার্কিন ডলার বা তার নিচে, তাদের বলা হয় নিম্ন আয়ের দেশ। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে এ তালিকাতেই ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনা ও মানুষের গড় আয়, গড় আয়ু, কর্মসংস্থান, রিজার্ভ, রেমিট্যান্স প্রভৃতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবস্থান বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ঘোষিত সর্বশেষ সাময়িক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ১৭৫২ মার্কিন ডলার। তাই বলা যায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বিশ্বব্যাংকের ঘোষণা দেশের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নেরই প্রতিফলন ও স্বীকৃতি। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের অগ্রগতি যেভাবে হচ্ছে, বড় ধরনের কোনো ব্যত্যয় না ঘটলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে। এটি যেমন মর্যাদার তেমনি এর সঙ্গে বেশ কিছু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জও যুক্ত হবে। এখন এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে বাণিজ্যে যে অগ্রাধিকার সুবিধা পায় তার সবটুকু পাবে না। আবার বৈদেশিক ঋণে কম সুদ ও নমনীয় শর্তও সীমিত হয়ে আসবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভের পর যেসব সমস্যা তৈরি হবে তা কাটিয়ে উঠতে ইতোমধ্যে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের অনুকূলে প্রাপ্ত বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহায়তা যাতে কোনোভাবে হ্রাস না পায় সে জন্য কাজ শুরু করেছে সরকার। এ উপলক্ষে ২২ মার্চ থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সেবা সপ্তাহসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা। গত নয় বছরে সকল উন্নয়ন পরিকল্পনার ধারাবাহিক বাস্তবায়নের কারণেই বাংলাদেশ আজ এ পর্যায়ে আসতে পেরেছে। ধারাবাহিকতা, টেকসই ব্যবস্থাপনা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে একসময় উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশেও পরিণত হবে বাংলাদেশ- অপেক্ষা এখন সে দিনের। পিআইড প্রবন্ধ। মোতাহার হোসেন: সাংবাদিক,কলামিস্ট। |