শিরোনাম: |
বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন সবুজ শ্যামল বাংলায়
|
মোতাহার হোসেন : ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত/বঙ্গবন্ধু মরে নাই/তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা/যে মানুষ ভীরু কাপুরুষের মতো, করেনি কো কখনো মাথা নত। এনেছিল হায়েনার ছোবল/থেকে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। কে আছে বাঙালি তার সমতুল্য/ইতিহাস একদিন দেবে তার মুল্য...।’এই লিরিকটি আমার যখন মন খারপ হয়, মনে কোনো দুঃখ, ক্ষোভের সঞ্চার হয় তখন আনমনে এটি আওড়াই। এই লিরিক শুনে উজ্জীবিত হই, হতাশা দূর করি, দুঃখ ভুলে থাকতে চেষ্টা করি। একই সঙ্গে প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি, বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যায় মর্মযাতনায় ভুগি, বেদনাহত হই, হূদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। পাশাপাশি ঘাতকচক্রের প্রতি ঘৃণা, অভিশাপ এবং থুথু দেই।
এই লিরিকের কথা লিখেছেন, হাসান মতিউর রহমান। আর সুর করেছেন মলয় গাঙ্গুলি ও সাবিনা ইয়াসমিন। লিরিক হূদয়কে এখনো নাড়া দেয়। রক্তে শিহরণ জাগে, আবার মিছিলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি, ইচ্ছা হয়। ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্মদিনকে সামনে রেখে আবার স্মরণে, বরণে, হূদয়ের রক্তক্ষরণের মধ্যদিয়েই তাকে তার রাজনৈতিক দর্শন, মানবপ্রেম, আদর্শকে বোঝার চেষ্টা করি। আসলে বঙ্গবন্ধুর তুলনা তিনি নিজেই। বাংলার ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সবুজ-শ্যামল জমিনের সমান বিস্তৃত তার হ্নদয়। তার সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, বক্তব্য, বাচনভঙ্গি জাদুমন্ত্রের মতো আকর্ষণ করেছে পুরো বাঙালি জাতিকে। তিনি ঘাতকের বুলেটে যদি শাহদাতবরণ না করতেন, যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে এখন তার বয়স হতো ৯৯ বছর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম এই সবুজ শ্যামলে ঘেরা বাংলাদেশেই। আমার কাছে প্রতিদিনই মনে হয় বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিন, আবার কখনো কখনো প্রতিদিন তার শাহদাতবরণের দিন। কিন্তু ৫৫ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে আমাদের বুক থেকে কেড়ে নিলো ঘাতকের দল। ধিক্কার জানাই, ঘৃণার থুথু দেই ঘাতক চক্রের মুখে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নানা বিশেষণে ভূষিত করা যায়। তিনি বাঙালি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশ নামক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। একাত্তরের ৭ মার্চে যার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধ করেছে সেই মানুষটিকে আমরা হারিয়েছি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। যা দেশ ও জাতির ইতিহাসেই নয় বিশ্বব্যাপী একটি কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা হয়। এই মহান মানুষটিকে আজকের প্রতিটি তরুণের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়াটা সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু না, তা হচ্ছে না। জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার শাসনামলে বঙ্গবন্ধু এদেশে ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও মহান মুক্তির যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত রাখে। এমনকি খুনি মোস্তাক ক্ষমতা দখল করে ‘কুখ্যাত ইনডিমনিটি’অধ্যাদেশ জারির মধ্যদিয়ে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান, এরশাদ ক্ষমতায় এসে এই কালো আইন বলবত্ রেখেছিলেন। জাতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায় পুরো জাতিকে বহন করতে হয়। জাতি হিসেবে এটা আমাদের সকলের জন্য লজ্জার, কলঙ্কের। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ নিভৃত পল্ল্লীর ছায়াঢাকা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম হয় জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের। সোনালি এক সন্ধ্যায় শেখ পরিবারের প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে উঠেছিল জাতির জনকের জন্ম উপলক্ষে। জন্মলগ্নে মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজন খুশি হয়ে শিশুটিকে ‘খোকা’ বলেই ডাকতেন। আজ যাকে নিয়ে লিখছি তিনিই সেই খোকা থেকে হয়ে উঠলেন একজন জননন্দিত ও অবিসংবাদিত নেতা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। বাঙালি জাতির কাছে বঙ্গবন্ধু এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। জাতির কাছে তিনি পিতা। কিন্তু বিশ্বের কাছে হয়েছেন তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৩তম জন্মবার্ষিকীর এই দিনে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, তার ও তার পরিবারের অপরাপর শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। বর্তমান এবং জাতির ভবিষ্যত্ কর্ণধার তথা তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায়। এ ক্ষেত্রে জাতির জনকের আদর্শের কোনো বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির চেতনার এক অনির্বাণ শিখা। তার চেতনা, তার দর্শন, তার মানব প্রেম, মানুষের জন্য তার জীবন বিসর্জন,মানুষের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন যুগযুগ,কাল থেকে কালান্তর দেশ থেকে বিদেশ সর্বতই সমভাবে প্রাসঙ্গিক, অপরিহার্য। তার জীবন, কর্ম, রাজনীতি সবকিছুই দেশের সকলে জন্য ওই, পঠন, অনশীলন, অনুস্মরণ, অনুকরণ অপরিহার্য। তিনি ছিলেন আমাদের মুক্তি সংগ্রামের দিশারি। তার সফল চিন্তা চেতনা সর্বোপরি সমপোযোগী ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে আহ্বানের ফসল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাল সবুজের একটি পতাকা। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের উদ্ভব, নামে বাঙালি জাতির নিজস্ব পরিচয় ও ঠিকানা। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগ্রামী জীবন, সাহস, নেতৃত্ব, ত্যাগ ও মানবিক গুণাবলি লিখে কখনো শেষ করা যাবে না। তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির কণ্ঠস্বর, এক অনন্য নেতা ও রাজনীতিবিদ। প্রসঙ্গত: বিখ্যাত পত্রিকা ‘নিউজ উইক’ বঙ্গবন্ধুকে এক অনন্য ‘সুপারম্যান’ এর মানচিত্রে বং ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দর্শন ছিল অনন্য। তিনি বাঙালির নাড়ির স্পন্দন, আবেগ ও প্রত্যাশা সঠিকভাবে বুঝতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু রাজনীতির শ্রেষ্ঠ অর্জন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু হন বাঙালি জাতির জনক। ৩০ লাখ শহীদ ও দু’লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরপরেই তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। যতোদিন একজন বাঙালি বেঁচে থাকবে, ততোদিন তারা অর্জিত স্বাধীনতাকে বিপন্ন হতে দেবে না। বাঙালিকে পরাধীন রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি পৃথিবীতে আর নাই’। বাঙালি জাতির নিজস্ব ঠিকানা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের পরপরই তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা মানে একটি নিজস্ব পতাকা মাত্র নহে। জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ স্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ তিনি চেয়েছিলেন বাঙালি জাতিকে একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। তার এ স্বপ্ন ধ্বনিত হয় তারই কণ্ঠে— ‘বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করে কোনো দেশ কখনো আত্মমর্যাদাপূর্ণ ও মহান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না।’ তিনি শুধু রাজনীতির সফল নায়ক নন, তিনি ছিলেন এক বিশাল হূদয়ের মহান মানুষ। ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার সমাজতান্ত্রিক নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় কখনো দেখিনি। আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। সাহস ও ব্যক্তিত্বে এ মানুষটি হিমালয়ের মতোই উঁচু।’ বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ব্রিটিশ মানবতাবাদী আন্দোলনের অগ্রনায়ক লর্ড ফেন্নার ব্রোকওয়ে একদা মন্তব্য করেছিলেন, ‘নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও আয়ারল্যান্ডের জর্জ ডি ভেলেরা’র চাইতেও মহান ও অনন্য।’ তিনিই একমাত্র নেতা যিনি একইসঙ্গে একটি স্বাধীন জাতি ও স্বাধীন ভূমির জনক। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে অর্জিত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ছিল অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত একটি ভূখ-। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে দেশীয় আল-বদর ও আল-সামশ বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদাররা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতির চিন্তাকোষে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বাঙালি জাতি যখন অগ্রসর হচ্ছে, ঠিক তখনই আন্তর্জাতিক ও দেশীয় কুচক্রী মহল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে অত্যন্ত নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৫ আগস্টের চেয়ে ঘৃণ্যতম ও কলংকজনক দিন আর নেই। তারপর জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে প্রায় দেড়যুগ চলে স্বৈরশাসন। শুরু হয় বাঙালির গর্বের ধন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অপকৌশল। পুরস্কৃত করা হয় স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ও বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের। দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সব অন্ধকারকে দূরে ঠেলে বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করে মুক্তির পথে আজ এগিয়ে চলেছেন। এখানেও তারুণ্যের জয়ে হয়েছে জয়কার। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, এ মুহূর্তে অনতিবিলম্বে সব যুদ্ধাপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। পলাতকদের দেশে এনে শাস্তি কার্যকর করার নানা উদ্যোগ আজও চলমান। বাঙালি জাতি স্বাধীন ইতিহাসের পাতা থেকে কলংকিত নামগুলোকে মুছে ফেলতে আজ বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী চেতনা ও আদর্শ পূরণে বর্তমান প্রজন্মকে কাজে লাগাতে হবে। কেননা আজকের তরুনই হবে আগামীতে জাতির কর্ণদার। সম্মিলিতভাবে তরুণরাই জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতা থাকবে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা বহমান থাকবে, যতদিন জাতি হিসেবে বাঙালির পরিচয় থাকবে ততদিন এ দেশের প্রতিটি মানুষের হূদয়ে জাতির জনক চিরঞ্জীব, চির অম্লান, বাঙালি চেতনায় অনির্বাণ শিখা হিসেবে প্রজ্বলিত হয়ে থাকবেন। এ ছাড়াও তারুণ্য শ্রদ্ধায় শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেগে থাকবেন সবুজ শ্যামলে ঘেরা তার স্বপ্নের সোনার বাংলায়। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। |