বুধবার ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ১৪ কার্তিক ১৪৩১
মুক্তিযুদ্ধের চার খলিফার অন্যতম সংগঠক আব্দুল কুদ্দুস মাখন
Published : Sunday, 18 February, 2018 at 6:00 AM, Count : 1746

স্বপন কুমার সাহা : আমরা যারা ছাত্রলীগের গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গে ৭০ দশকে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে সংক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলাম, সেই ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। মনে পড়ে ছাত্রলীগের গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টিকারী অন্যতম কয়েকজন নেতার কথা। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব, প্রয়াত আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ ও শহীদুল ইসলামসহ ছাত্রলীগের নিবেদিত সত্ ও নিষ্ঠাবান নেতাদের। যারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে দেশ প্রেমের আদর্শ সামনে রেখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য অত্যন্ত সুনিপুণ ও আন্তরিকতার সঙ্গে মুজিবনগর বিপ্লবী সরকারের পাশাপাশি থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। এদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চার খলিফার অন্যতম সংগঠক প্রয়াত আব্দুল কুদ্দুস মাখন। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখন ১৯৪৭ সালের ১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম মোহাম্মদ আবদুল আলী এবং মাতা মরহুমা আলহাজ আমেনা খাতুন। সাত ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মাখন ছিলেন তৃতীয়। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়াজ মোহাম্মদ হাই স্কুল থেকে মানবিক শাখায় ১ম বিভাগ পেয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যদিও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর দীক্ষিত মন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সজাগ দৃষ্টির কারণে ষড়যন্ত্রকারীরা কোনো সুযোগ পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় চার খলিফার নেতৃত্ব বিশাল ভূমিকা রয়েছে।
চার খলিফার মধ্যে ছিলেন তত্কালীন ছাত্রলীগের সভাপতি অনলবর্শী বক্তা নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ৭০ এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রথমবারের মতো সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন। আব্দুল কুদ্দুস মাখন অপরিণত বয়সে ১৯৯৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মারা যান। মাখন ভাই ছিলেন অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী। ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীদের প্রতি অমায়িক ব্যবহারের জন্য মাখন ভাইয়ের জনপ্রিয়তা ছিল অতুলনীয়। প্রসঙ্গিকক্রমে মাখন ভাইয়ের কিছু কথা আমার মনে পড়ে যায়। ১৯৭২ সালেই ছাত্রলীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত আকারে রূপ নেয়। ১৯৭২ সালে মে মাসে ডাকসুর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুইটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এখানে মজার ব্যাপার হলো মুজিববাদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে দুইটি প্যানেল ছাত্রলীগের নামে ডাকসুর নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। মুজিববাদ প্যানেলের ডাকসুর সহ-সভাপতি হিসেবে শেখ শহিদুল ইসলাম আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনিরুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে প্যানেল দেয়া হয়েছিল। অর্থাত্ এক কথায় শহীদ মুনির পরিষদ মুজিববাদের পরিষদ। ছাত্রলীগের ডাকসুর বিদ্রোহী প্যানেলের সহ-সভাপতি জিনাত আলী আর সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিস। জিনাত-মজলিস পরিষদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রিক পরিষদ।
জিনাত-মজলিসের মূল স্লোগান ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে আমরা লড়ছি’। বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত পোস্টার সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে পরিচিতি সভাগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমিও সেদিন জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদে ভি.পি হিসেবে ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেনেটিক ডায়াস প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। অন্যান্য হলগুলোতে ডাকসুর নির্বাচনে দুইটি প্যানেল দেয়া হয়, ব্যতিক্রম শুধু জগন্নাথ হল। জগন্নাথ হলে ছাত্রলীগের একটি প্যানেল ছিল স্বপন-ডায়াস পরিষদ। জগন্নাথ হলে যখন শহীদ-মুনির পরিষদ ও অপর প্যানেল জিনাত-মজলিস পরিষদ প্রচারনার মিছিলসহকারে আসত তখন উভয় গ্রুপের স্লোগান ছিলো স্বপন-ডায়াস পরিষদ মুজববাদের পরিষদ। আবার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পরিষদ যখন জগন্নাথ হলে মিছিলসহকারে প্রচারণায় আসত তখন তাদেরও স্লোগান ছিলো স্বপন- ডায়াস পরিষদ। জগন্নাথ হল উভয় গ্রুপের নিকটই স্বপন-ডায়াস পরিষদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তত্কালীন সময়ে বিবদমান গ্রুপের কারণে ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রলীগের পরাজয় বরণ করতে হয়। সেবার ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভিপি ও মাহবুবজ্জামান জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। ডাকসুর নির্বাচনের পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দ্বিধাবিভক্তি হলো ১৯৭২ জুলাই মাসে দুইটি সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে- একটি  সম্মেলন হলো মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সোহরাওয়র্দী উদ্যানে। এই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্মেলনটি উদ্বোধন করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৭২ এর জুলাইর ২১ তারিখ। আর সৌভাগ্যক্রমে এ সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হয়েছিলেন আব্দুল কুদ্দুস মাখন আর যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছিল স্বপন কুমার সাহাকে (আমাকে)। এ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনটি বঙ্গবন্ধু উদ্বোধন করায় আমাকে (স্বপন সাহা) সম্মেলনটির যুগ্ম আহ্বায়ক করা আমার জন্য ছিল বিরাট প্রাপ্তি। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সম্মেলনটি একই দিন ৭২ এর ২১ জুলাই পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি উদ্বোধন করেন শহীদ মুক্তিযুদ্ধা ছাত্রলীগ নেতা স্বপন চৌধুরীর পিতা। তার পরবর্তীতে ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শে গড়ে তোলা হয় ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ জাসদ।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ক্লাসে ভর্তি হন। বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ছয় দফা আন্দোলনে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে ছাত্র আন্দোলনকে গতিশীল করেন। তিনি ১৯৬৬-৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহ সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৮-৬৯ সালে ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে এম এ পাস করে একই বছরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে তিনি সর্ব প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যক্ষ ভোটে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং তত্কালীন ডাকসুর নেতৃত্বে গোটা ছাত্র সমাজকে ছাত্রলীগের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
১৯৭১ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার সদস্যের অন্যতম সদস্য আবদুল কুদ্দুস মাখন। ‘চার খলিফা’ বলে খ্যাত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অপর তিন সদস্য হলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, জনাব শাহজাহান সিরাজ ও জনাব আ স ম আবদুর রব। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ২ মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সম্মুখে সর্ব প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের ঐতিহাসিক ছাত্র জনসভায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করা হয় এবং এই ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার প্রথম ইস্তেহার পাঠ করা হয় এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করে ঘোষণা প্রদান করা হয়। ৭ মার্চ তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।
২৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজের অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং এই সমাবেশেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তকৃ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঐদিনই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ৩২নং ধানমন্ডির বাসায় বঙ্গবন্ধুর হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে দেন এবং বঙ্গবন্ধু ৩২নং বাসভবনে উত্ফুল্ল জনতার মাঝে স্বাধীন বাংলার এই পতাকা তুলে ধরেন। ওইদিন ঢাকাসহ সর্বত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। ২৬ মার্চে প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণার পর গোটা বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধকে সুসংহত ও সুসংগঠিত করার কাজে ব্যাপৃত হয় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করার কাজে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধে সীমাহীন ত্যাগ এবং অসম বীরত্ব প্রদর্শন করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিনিয়ে আনে আমাদের মহান বিজয়। অর্জিত হয় আমাদের মহান স্বাধীনতা।
 স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐতিহাসিক ভূমিকা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে মহান মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেন। তিনি পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার (চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং ফরিদপুরের একাংশ নিয়ে গঠিত) মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পূর্বাঞ্চলীয় লিবারেশন কাউন্সিলের ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবেও জনাব মাখন বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন মহান সংগঠক হিসাবে মাখনের এই ঐতিহাসিক অবদান দেশ ও জাতির নিকট চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ডাকসু’র সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও ডাকসু’র সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন এর নেতৃত্বে ডাকসুর পক্ষ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ প্রদান করা হয়। জনাব মাখন ১৯৭২ সালে ভারতের কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী মেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও যুবলীগ সমন্বয়ে গঠিত দলের সদস্য হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনাব মাখন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে নিরলস পরিশ্রম করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে বার্লিনে আন্তর্জাতিক বিশ্ব যুব উত্সবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করার পর ২৩ আগস্ট রাতে অন্যান্য জাতীয় নেতদের সঙ্গে আব্দুল কুদ্দুস মাখনকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১২ নভেম্বর জেল থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসাবে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
 জনাব মাখন মাত্র ৪৭ বছর বয়সে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস জনিত জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে লিভার সিরোসিসে ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪ খ্রিঃ তারিখে আমেরিকার ফ্লোরিডায় চিকিত্সাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যু সংবাদ রেডিও, টিভিতে প্রচারিত এবং সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হবার পর গোটা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। তত্কালীন সময়ে কার্যরত জাতীয় সংসদ অধিবেশন তার মৃত্যুর সংবাদ প্রাপ্তির সাথে সাথে মুলতবি ঘোষণা করা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪ খ্রিঃ তারিখে তার লাশ ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছলে জাতীয় নেতারা, অসংখ্য গুণগ্রাহী ও শুভাকাঙ্ক্ষি অশ্রুসিক্ত নয়নে লাশ গ্রহণ করেন। অতঃপর মরহুমের লাশ তার নিজ বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে হেলিকপ্টারে নেয়া হলে সেখানে এক স্মরণকালের সর্ববৃহত্ শোক সমাবেশ হয়। পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জাতীয় ঈদগাহ্ ময়দানে বিশাল সমাবেশে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবার পর মিরপুর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা গোরস্তানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখনকে দাফন করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারাও তার দাফনের পূর্বে তাকে বিশেষ মর্যাদায় সম্মান জানিয়ে সম্মিলিতভাবে স্যালুট প্রদান করে।
জনাব মাখনের মৃত্যুতে তত্কালীন বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী, জাতীয় নেতারা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ও জাতীয় সংসদ সদস্যরা, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা শোক প্রকাশ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রায় মানুষই তাকে ‘মাখন কুদ্দুস’ নামে ডাকতেন। মাখনের মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে চিরদিন। মা-বাবার ইচ্ছা এবং স্বপ্ন পূরণে তিনি কর্মমুখর জীবনের মাঝেও সর্বদাই ব্যতিব্যস্ত থাকতেন এবং সাধ্যমত সব চেষ্টাই করতেন। বাবার মৃত্যুর পর মা দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। মা জীবিত থাকাকালেই জনাব মাখন মৃত্যুবরণ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু-মুসলিম সমপ্রীতির বন্ধন ও ভ্রাতৃত্ববোধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় রাখার প্রয়াসে জনাব মাখনের প্রচেষ্টা ছিল নিরন্তর। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতদেরর সঙ্গে তিনি সর্বদাই চমত্কার সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। উভয় সম্প্রদায়ের নেতাদের মাঝে সব সময়ই যেন মধুর ও চমত্কার সম্পর্ক বজায় থাকে সে বিষয়টি নিশ্চিতকরণে সর্বদাই তত্পর ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীরাও তাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন। জনাব মাখন ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি সাহস ও শক্তি, একটি আস্থা ও বিশ্বাস এবং একজন নির্ভরযোগ্য অকৃত্রিম বন্ধু।
মাখন ছিলেন একজন জীবন সংগ্রামী মানুষ। কোনো প্রকার লোভ-লালসা তাকে তার আদর্শ বা নীতি থেকে কখনো বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি নিঃস্বার্থভাবে জনগণের কাজ করেছেন। এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যতদিন থাকবে ততদিনই জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখনের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং বাংলাদেশের মানুষের হূদয়ে অমর, অক্ষয় ও অম্লান হয়ে থাকবে। জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখন আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার। আমরা তোমায় ভুলব না।
লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft