শিরোনাম: |
আবাদযোগ্য জমির ক্ষয়রোধে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন
|
ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম : বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর আগেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। প্রতি বছরই খাদ্যের উত্পাদন বাড়ছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে-২০১১-১২ অর্থবছরে চালের উত্পাদন ছিল মোট ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৯০ হাজার টন। ওই বছর ধানের আবাদকৃত জমির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৫ লাখ ২৮ হাজার হেক্টর আর, হেক্টরপ্রতি গড় উত্পাদন ছিল ২ দশমিক ৯৪ টন। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) চালের উত্পাদন ছিল মোট ৩ কোটি ৪৮ লাখ টন প্রায়। আবাদকৃত জমির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৩ লাখ ২১ হাজার টন। আর হেক্টরপ্রতি ফলন ছিল ৩ দশমিক ০৫ টন। চালের পাশাপাশি গম, ভুট্টা, আলু, শাক-সবজি, তেলজাতীয় খাদ্য, ডালের উত্পাদনও বাড়ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে গমের চাষ হয়েছিল ৩ লাখ ৫৮ হাজার, জমিতে আর উত্পাদন ছিল ৯ লাখ ৯৫ হাজার টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গমের উত্পাদন বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ লাখ ২২ হাজার টন। একই সময়ের ব্যবধানে ভুট্টার উত্পাদন ১৯ লাখ ৫৪ হাজার টন থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ লাখ টন। গোল আলু উত্পাদনে গত কয়েক বছরের রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে আলুর উত্পাদন ছিল ৮২ লাখ ৫ হাজার টন, যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেড়ে ১ কোটি ১৩ লাখ ৩৫ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে। শাক-সবজির উত্পাদন ২০১১-১২ ছিল ১ কোটি ২৫ লাখ ৮০ হাজার টন, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেড়ে ১ কোটি ৫২ লাখ ৬৪ হাজার টনে বৃদ্ধি পায়। একই সময়ের ব্যবধানে সরিষার উত্পাদন ৫ লাখ ২৫ হাজার টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭ লাখ ৩ হাজার টন, চীনাবাদারে উত্পাদন ১ লাখ ১ টন থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টন, তিল ৯৫ লাখ থেকে ৯৬ লাখ টনে, সয়াবিনের উত্পাদন ১ লাখ ৭২ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টন, সূর্যমুখীর উত্পাদন ১ লাখ ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫২ হাজার টনে বৃদ্ধি পায়। এছাড়া ডালের উত্পাদনও বেড়েছে। কম জমিতে অধিক পরিমাণে ফসলের উত্পাদন হচ্ছে। এটা হচ্ছে মূলতঃ সরকার আধুনিক প্রযুক্তির কারণে। ফসলের উত্পাদন বাড়লেও আবাদকৃত জমির পরিমাণ কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশে মোট ফসলি জমির পরিমাণ ১ কোটি ৫২ লাখ ৪৫ হাজার ৮৪১ হাজার ৯৩ হেক্টর। সেখানে আবাদ হচ্ছে ৮৩ লাখ ৬০ হাজার ৯৬৪ দশমিক ৭৫ হেক্টর। এর মধ্যে সেচের আওতায় আছে ৭৪ লাখ ৬ হাজার ৮২২ দশমিক ৮৭ হেক্টর। আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ২ লাখ ১০ হাজার ২৭ দশমিক ৯২ হেক্টর। কিছুদিন আগে বেসরকারি একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত একদশকে নাকি ৬৪ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমি কমেছে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মসজিদ-মাদরাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা নির্মাণে ব্যবহারের কারণে প্রতিদিনই কমছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। বিভিন্ন অনুসন্ধানে দেখা যায়, দিনে দুই হাজার বিঘা জমি কৃষি থেকে অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। একইভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন ৯৬ বিঘা জলাভূমি। সেসব জলাভূমিও ভরাট করে ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তামাক ও চিংড়ি চাষের ফলেও প্রতি বছর ২৪ হাজার বিঘা জমি কৃষিকাজের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। শহরতলী কিংবা গ্রামে অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, নগরায়ন, শিল্প-কারখানা নির্মাণ, ইটভাটা তৈরি, পুকুর-দীঘি খনন, মাছ চাষ ও নদী ভাঙনের ফলে ক্রমাগতভাবে প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। আবার আর্থিক অসঙ্গতি ও দুরবস্থার কারণে জমি বিক্রি করে বাস্তুহারা হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা। প্রতিনিয়ত অবকাঠামোগত উন্নয়নের নমে তৈরি হচ্ছে বাসগৃহ, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, দীর্ঘ সেতু ইত্যাদি। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১১ বছরে ২৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩১ একর কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাওয়ায় কমে গেছে ধান চাষ। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়, সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণেও কমছে কৃষি জমি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র ছাড়াও এলএনজি টার্মিনাল, এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, সাগরে ভাসমান জ্বালানি তেলের ডিপো ও পাইপলাইন স্থাপন বাবদ আরও প্রায় ছয় হাজার একর জমি অধিগ্রহণের সরকারি সিদ্ধান্ত রয়েছে। কৃষি জমি যে কেউ যে কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারেন। এটা নিয়ন্ত্রণের কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই। এ জন্য আইন পরিবর্তন করে উর্বর ও কৃষি উপযোগী জমির ব্যবহার নিরুত্সাহিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো বিধি-বিধান করা হয়নি এখন পর্যন্ত। জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১০ এবং কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন ২০১০ অনুযায়ী কৃষি জমি কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কোনো কৃষি জমি ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্পকারখানা ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা কোনোভাবেই নির্মাণ করা যাবে না উল্লেখ করে একটি নামমাত্র আইন থাকলেও এর শাস্তির বিষয়টি স্পষ্ট নয়। পরিকল্পনাহীন নগরায়নের ছোবলে বৈচিত্র্যও হারাচ্ছে কৃষি। ইটভাটার জন্যও প্রতি বছর হাজার হাজার একর আবাদি জমি অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকায় ধানের জমিতে বাঁধ দিয়ে লোনা পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। কোথাও হচ্ছে লবণের উত্পাদন। নানাভাবে কৃষি জমি অনুত্পাদনশীল কর্মকাণ্ডে ব্যবহার চলছে। এ ধরনের অবস্থা ক্রমাগতভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক দশকে দেশে কৃষি জমির ব্যাপক সঙ্কট সৃষ্টি হবে- তা সহজেই ধারণা করা যায়। অন্যদিকে বন্যা-খাড়তো আছেই। অকাল বন্যা, বছরে একাধিক বন্যা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশের পানি নিয়ন্ত্রণের কারণেও ফসল উত্পাদন ব্যাহত হচ্ছে। দেশের হাওরাঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, নদীর তীর সংরক্ষণ ব্যবস্থা যথাযথ না হওয়ায় আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। কাজেই এসব বিষয়গুলো নিয়ে এখনই ভাবতে হবে বা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। খাদ্যের উত্পাদন বাড়ছে, এটা খুবই ইতিবাচক বটে। তবে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে আবাদি বা আবাদযোগ্য জমির ক্ষয়রোধ করতে হবে। সারাদেশে আবাদি এবং আবাদযোগ্য জমির ক্ষয়রোধে বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির আলোকে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অভিমত অনুসারে ক্ষয়রোধ করতঃ কৃষি জমিতে খাদ্যের উত্পাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে- বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেয়া যেতে পারে। লেখক: সাবেক কর কমিশনার (আপিল) ও চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন। |