শিরোনাম: |
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে আন্তর্জাতিক মহলের প্রশংসা
|
ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম : নিউইয়র্কভিত্তিক অর্থনীতি ও বাণিজ্য সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘বিজনেস ইনসাইডার’ ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিলের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে নতুন এশিয়ান টাইগার হিসেবে অভিহিত করেছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি), বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ড (আইএমএফ) বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীল অগ্রযাত্রার প্রশংসা করেছে। ২০১৭ সালে বড় ধরনের কোনো রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়নি। এই সময়ে রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ, লক্ষ্যমাত্রার অধিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির নিম্ন হারের সুবাদে অর্থনীতির গতি ছিল তেজি। অতি লক্ষণীয় সাফল্য হচ্ছে যে প্রবৃদ্ধির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৭.২ শতাংশ ছাড়িয়ে ৭.২৮ শতাংশ অর্জন। মাথাপিছু আয় ২০১৬-এর ১৪৬৫ ডলার থেকে বেড়ে ১৬১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। বিজনেস ইনসাইডারের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সময়ে হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান এই ৪টি দেশ ছিল এশিয়ান টাইগারের তালিকায়। কিন্তু এখন এই তালিকায় বাংলাদেশ নামে আর একটি দেশ স্থান করে নিয়েছে। ‘দেয়ার ইজ এ নিউ এশিয়ান টাইগার’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি লেখেন জোনাথান গারবার। সিডিপি’র এক রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ ২০১৮ সালের মার্চে সিডিপি’র পরবর্তী পর্যালোচনায় স্বল্পোন্নতের তালিকা থেকে উত্তরণের ৩টি মানদণ্ড পূরণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মুডিজ ইনভেস্টর সার্ভিস ২০১৭ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকারের বিএ বন্ড রেটিং ও রেটিংয়ে স্থিতিশীলতা অব্যাহতের কথা বলেছে। লন্ডনভিত্তিক প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারসের ২০১৭’র ফেব্রুয়ারির রিপোর্টে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্যে নেদারল্যান্ড, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াকে টপকে বিশ্বের ২৩তম বৃহত্ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। ‘দ্য লং ভিউ: হাউ উইল দ্য গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডার চেঞ্জ বাই ২০৫০?’ এই নিবন্ধে পিডাব্লিউসি এ কথাও বলেছে যে ২০৩০’র মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৮তম বৃহত্ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। এডিবি’র এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৭ বলেছে, ২০১৭ সালে কৃষি খাতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ধারণার চেয়েও বেশি ছিল। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট আপডেটে (সেপ্টেম্বর) বলা হয়েছে, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সাবলীলভাবে এগিয়ে চলছে। আইএমএফ ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অব্যাহত অগ্রগতির প্রশংসা করেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২৭ সেপ্টেম্বরের ২০১৭-১৮’র গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্সে (জিসিআই) বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৭ দেশের মধ্যে ৯৯তম উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক খাতের উন্নয়ন নিয়ে বর্তমান সরকার যেমন স্বপ্ন দেখছে, তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলও আশাবাদী বাংলাদেশ অচিরেই বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। অর্থনৈতিক সব কয়টি সূচক ইতিবাচক গতিতে এগুচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সাফল্য আনতে সক্ষম হয়েছে। আগের পাঁচ বছর এবং বর্তমান চার বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক দূর। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল ৯২ শতাংশ মানুষ। আর মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় ছিল ১০০ ডলার। সময়ের ব্যবধানে দেশে দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে সাড়ে ২৩ শতাংশে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে অতিদারিদ্র্যের হার এখন ১২ দশমিক ১ শতাংশ। মোট দেশজ আয়ে (জিডিপি) ৬ শতাংশের বাধা অতিক্রম করে প্রথমবারের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬৫ মার্কিন ডলারে। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তকমা ঝেড়ে ফেলার যোগ্যতা অর্জনের অনেকটাই দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যক্তি খাতে প্রবৃদ্ধির সুবাদে সরকারের রাজস্ব আয় প্রত্যাশিত হারেই বেড়েছে। অবকাঠামোসহ নানা খাতে সরকার প্রতি বছর ব্যয় করছে লাখ কোটি টাকার বেশি। এক সময় খাদ্য চাহিদা পূরণ ও বাজেট বাস্তবায়নে বিদেশিদের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হয়েছে। বাংলাদেশ এখন আর খাদ্যসহায়তা নেয় না। পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পও নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উড্ডয়নের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া অর্থায়নের অভাবে ১৯৬৪ সাল থেকে আটকে থাকা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। আর্থিক খাতে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেকটা সফলতা দেখাচ্ছে সরকার। বিদায়ী বছরে প্রথমবারের মতো মোট দেশজ আয়ে (জিডিপি) ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখেছে বাংলাদেশ। বিদ্যুত্ উত্পাদন ও বিতরণে সাম্প্রতিক সময়ে নেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প। এসব প্রকল্প ঘিরেই আগামীতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উত্পাদনে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। তিন বছরের মধ্যেই ৮ শতাংশের ঘরে উঠবে প্রবৃদ্ধি। নতুন বছর ঘিরে এমনটা প্রত্যাশা করছেন সবাই। ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের বাস। বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপ দেয়ায় তারা অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) হিসাবে বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ মানুষ এখন কর্মক্ষম। ২০২২ সালে কর্মক্ষম মানুষের হার ৬৯ শতাংশে উন্নীত হবে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ কর্মবাজারে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। বিপুল জনশক্তির কর্মের নিশ্চয়তা দিতে অবকাঠামো উন্নয়নে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। বিদায়ী বছরে নিজস্ব অর্থায়নে অনেকটাই দৃশ্যমান হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্পের অবকাঠামো। চলতি বছরের মধ্যে সেতুর মূল কাঠামো গড়ে তুলতে কর্মযজ্ঞ চলছে নদীর দুই পাড়ে। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৩৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অবকাঠামো খাতে বেশ বড় কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এসব প্রকল্পের কাজ শেষে দেশের চেহারা অনেকটাই পাল্টে যাবে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ শেষ হলে মোট দেশজ আয় ১ শতাংশের বেশি বাড়বে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এছাড়া রাজধানীর যানজট নিরসনে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়নের কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক চার লেনে রূপান্তর করা হয়েছে। চার লেনের কাজ চলছে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ রেলপথগুলো ডাবল লাইনে উন্নীত করার কাজও চলছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হিসেবে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত্ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। আলোচিত কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটি। এসব প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতু ছাড়াও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। চলছে মেট্রোরেল নির্মাণের দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া। রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ প্রকল্পের উত্পাদনে আসার কথা রয়েছে ২০১৮-এর ডিসেম্বরের মধ্যে। দ্রুত কাজ শেষ করতে এটিকে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে যোগ করা হয়েছে। জ্বালানি চাহিদা পূরণে মহেশখালীতে নির্মাণ হচ্ছে এলএনজি টার্মিনাল। তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির জন্যই এ টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দক্ষ জনশক্তি বাড়াতে স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় তৈরি পোশাক, নির্মাণ, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, চামড়া এবং জাহাজ নির্মাণ খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে ৪৭ হাজার ৪শ’ জন এবং বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে ২ লাখ ৬০ হাজার জনকে দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান ও ১ লাখ ৮২ হাজার জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কাজ চলছে। কৃষিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে দেশ। জিডিপিতে কৃষির অবদান কমে বাড়ছে শিল্প খাতে। ১৫ বছর ধরে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়নে সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এ খাতে প্রতি বছর ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও দাতারা শেষ পর্যন্ত ছাড় করেছে গড়ে ১৭৯ কোটি ডলার। লক্ষ্য অর্জনে অর্থ সঙ্কট বাংলাদেশের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তবে একটা কথা সত্য যে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে দেশ দ্রুত সামনে এগিয়ে যাবে। গত কয়েক বছরে এটাই প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তাই নয়- প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আর্থসামাজিক উন্নয়নে দেশ উল্লেখযোগ্য হারে এগিয়ে চলছে এবং মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে- ইনশাআল্লাহ। লেখক: সাবেক কর কমিশনার ও চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন। |