শিরোনাম: |
সড়কে আর কত প্রাণ ঝরবে?
|
শেখ রাশেদুজ্জামান রাকিব : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ইকরামুল হক একদিন অত্যন্ত দুঃখ করে বললেন, যখন ঢাকার বাইরে যাই মনে হয় এই বুঝি শেষ যাত্রা, আর ফেরা হবে না। তার এ কথার সত্যতা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ব্যক্তির পরিবারের করুণ আর্তনাদের মধ্য দিয়ে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। যেমনটি হয়েছে এ বছরের শেষ দিনে প্রকাশিত সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলে প্রথম হওয়া রিমি সাহার পরিবারে। পারিবারিক অনটনের কারণে ম্যাট্রিকের ফরম ফিলাপ করতে না পারার দুঃখটাকে তার বাবা চিরভস্মীভূত করতে চেয়েছিলেন সন্তানদের সাফ্যলের উত্তপ্ত মশালে। তার সেই স্বপ্নের তরী ঘাটে ফেরার মাত্র ৪ দিন আগে পরপারে পাড়ি জমাতে হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে। মেয়ে সারাদেশে মেধা তালিকায় প্রথম হয়ে জজ হয়েছে কিন্তু এর নেপথ্যের কারিগর, আজীবন দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষটি দেখে যেতে পারেননি। ঠিক এমন করেই প্রাণ হারিয়েছেন ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার্থী বগুড়ার শেরপুরের এক মেয়ে। এমন হাজারো মা, বাবা, ভাই, বোন ও কোলের শিশুকে সড়কে নিত্যই বলি দিতে হয় এ দেশে। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংঘটন (নিসচা) এর প্রতিবেদনে ২০১৭ সালের দুর্ঘটনার যে পরিসংখ্যান উঠে এসেছে তাতে ইকরামুক হকের মতো নিরাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না আমাদের আমজনতার। ২০১৬ সালে ২৩১৬টি দুর্ঘটনায় ৪১৪৪ জন মারা গেলেও ২০১৭ সালে ৩৩৪৯টি দুর্ঘটনায় ৫৬৪৫ জন মানুষ নিহত হবার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মানুষ মরার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। শুধু তাই নয় ১ বছরের ব্যবধানে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩১ শতাংশ ও নিহতের সংখ্যা ২৭ শতাংশ বেড়ে গেছে; দিনে গড়ে ১৫ জন প্রাণ হারাচ্ছে। এ পরিসংখ্যানে আমাদের জীবনের নিরাপত্তাকে কতটা সংশয়ের মধ্যে ছুড়ে দেয় তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই উপলব্ধি করতে সক্ষম। আমরা সার্বিক দিক দিয়ে উন্নয়নের পথে ধাবিত হওয়ার প্রচেষ্টা চালালেও সড়কে দুর্ঘটনায় নিয়ে ঊর্ধ্বতন মহল, পরিবহন মালিক ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্বিগ্নতা পরিলক্ষিত হয় না। আর পরিবহন মালিকেরা অধিক বিত্তের লালসায় যেনতেনভাবে পরিবহন ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করে মানুষের জীবন নিয়ে যেন খেলছে। এ নিরেট সত্য সাধারণ কথার অন্তরালে যে কত বেদনা, ক্ষোভ ও হতাশা বিদ্যমান তা অকালে দুর্ঘটনায় অকালে প্রয়াণ হওয়া ব্যক্তির পরিবার মাত্রই জানে। প্রতি বছর আমাদের সড়ক উন্নয়নের জন্য কোটি কোটি টাকা বাজেট হয়। অথচ দেশের অধিকাংশ রাস্তার অবস্থা আজও সম্পূর্ণ নিরাপদ হয়ে উঠেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে দেশের শাসক শ্রেণির অবদানকে অগ্রাহ্য করাও সম্ভবপর নয়। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে, রাষ্ট্রের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষের শ্রম। কেননা, তাদের চাষ করা ফসলে যেমন সবার অন্ন জোটে তেমনি পোশাক বা এ ধরনের শ্রমিকের গায়ের ঘামেই আমাদের বৈদেশি মুদ্রা অর্জিত হয়। কিন্তু এ সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তায় রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার চরম অবহেলা সব সরকারের আমলেই পরিলক্ষিত হয়। প্রতি বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক মানুষ নিহত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এটা বড় কোনো ইস্যু হিসেবে ধরা পড়ে না। অথচ এটাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে নিয়ে এর উত্তরণে সর্বত্মক প্রচেষ্টা চালানো রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্ব বলে বিবেচিত হওয়া উচিত বলে মনে করছি। কেননা, আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের জীবন রক্ষার অধিকারকে নিশ্চিত করতে সব ধরনের দায়বদ্ধতা আরোপিত হয়েছে। অতি বাস্তবতা হলো দুর্ঘটনার এ হার বজায় থাকলে উন্নয়নের মহাসড়কের শেষ প্রান্তে পোঁছাবার আগেই সব মানুষের জীবনাবসান ঘটবে, টিকে থাকবে পরিবহন খাতের সাম্রাজ্যবাদীদের বিত্ত ও অট্রালিকার আধিপত্যতা। আমাদের জনসংখ্যার যাতায়াতে অধিক যানবাহন দরকার। সে তুলনায় আমাদের রাস্তার প্রশ্বস্ততা অনেক কম বলে প্রতি বছর বাজেটের বিশাল অংশ এ খাতের উন্নয়নে বরাদ্দ হয়। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের চেয়ে এ দেশের রাস্তা নির্মাণে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ব্যয় হয়। দুর্ঘটনার অনেক কারণ বিদ্যমান। পরিবহন শ্রমিক তথা গাড়ি চালক নিয়োগে যোগ্যতা ও সুস্থ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় না। অধিকাংশ চালকের মাদকাসক্তি কিংবা দায়িত্বহীনতা জীবনের প্রতি দরদবোধটা একবারেই ক্ষীণ। মানবিক গুণাবলির সঙ্গে তাদের সুম্পৃক্ততা না থাকায় যেনতেনভাবে ড্রাইভিং করে বা অধিক টাকা কামানোর ধান্দায় অসুস্থ ও মাদকাসক্ত শরীরে নিরবচ্ছিন্নভাবে গাড়ি চালায়। এছাড়া মালিকদের আইন না মানার মনমানসিকতার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বিদ্যমান বিধায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি যাত্রী পরিবহনে ব্যবহূত হচ্ছে। দেখা যায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ও সড়কের যানবাহন নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় বেহাল ও রুগ্ন দশা। সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে জনবল নিয়োগে দক্ষতা যাচাই করা হয় এবং কর্মের প্রতি নিষ্ঠার স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কৃত করা হয়। সে তুলনায় পরিবহন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের ইতিবাচক কাজের কোনো মূল্যায়নের বা পরস্কৃত করার কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। চালকদের পেশার দক্ষতার প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মানবিক দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে হবে। মানুষের জীবন যে অনেক মূল্যবান সে বোধ সৃষ্টি এবং নেশার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার অবসানের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মালিকপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কোনো শ্রমিককে অর্থের প্রলোভন দেখায়ে অতিরিক্ত সময়ে ড্রাইভিং করার কাজে ব্যবহার করতে না দেয়া হয় সেজন্য আইনের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। ভালো ড্রাইভিংয়ের জন্য সরকারি সম্মাননা ও পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চালকদের প্রলুব্ধ করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করে মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। রাষ্ট্রের কাছে অনন্ত এটুকু সবিনয় নিবেদন কারও জানাজায় অংশগ্রহণ করতে যানবাহনে যাবার সময় নিজেকেই যেন লাশ হয়ে ফিরতে না হয়। লেখক: কলামিস্ট |