শিরোনাম: |
সমৃদ্ধির পথযাত্রায় পাশে দাঁড়াতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান প্রসঙ্গে কিছু কথা
|
মোতাহার হোসেন : সম্প্রতি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের ৩ দিনের সম্মেলন। এই সম্মেলন মূলত দেশের উন্নয়ন, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সেনিটেশনসহ প্রভৃতি খাতে আন্তর্জাতিক দাতা, সহযোগী সংস্থাসমূহ কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ, দান, অনুদান প্রদানকারীদের নিয়ে সরকারের নীতি নির্ধারকদের বৈঠক হয়। একে সংক্ষেপে বিডিএফ বৈঠক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই বৈঠকে সরকারের, তথা দেশের পরবর্তী উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে কতটুকু আর্থিক সহায়তা, ঋণ, অনুদানের প্রয়োজনীয়তা, চাহিদা, বিগত সময়ে প্রদত্ত ঋণ, দান, অনুদানে বাস্তবায়িত প্রকল্পসমূহের অগ্রগতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এই ফোরামে। সদ্য সমাপ্ত এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য সময়োচিত, প্রাসঙ্গি, অর্থবহ এবং যৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এর আরও একটা কারণ আছে, তা হচ্ছে আজ থেকে এক যুগ আগের অথবা, দুইযুগ বা তারও আগের তিন বা সাড়ে তিনযুগ আগের বাংলাদেশ, আর আজকের বাংলাদেশ এক অবস্থানে নেই। পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুই। মানুষের গড় আয়ু, গড় আয়, রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, দেশের অর্থনীতির আকার, বাজেটের আকার, পরিমাণ সব কিছুতেই পরিবর্তন হয়েছে, উন্নতি হয়েছে কয়েকগুণ। দেশের বহু উন্নয়, অর্জন বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের তথাকথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশ বাংলাদেশ এখন উপচেপড়া ঝুড়িতে রূপান্তরিত হয়েছে। খাদ্য সঙ্কটের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে এখন উদ্ধৃত্ত খাদ্য শস্য রফতানির পথে। অর্থনীতিসহ সামাজিক বহু সূচকে রীতিমতো অভাবনীয় সাফল্যে অবাক বিস্ময়ে বিশ্ব তাকিয়ে থাকে বাংলাদেশের দিকে। বিশ্বব্যাংক, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্যে বিস্ময় প্রকাশ করে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বকে শিক্ষা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এই সম্মেলনে বর্তমান সরকারের বিগত সময়ের কর্মকাণ্ড, উন্নয়নের ফিরিস্তি, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যত্ করণীয় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে তাঁর সরকারের উন্নয়ন দর্শ, রূপকল্প-২০২১ সালসহ একটি সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের গাইডলাইন বলা সঙ্গত। বাংলাদেশের বিস্ময়ক উন্নয়নের মহাযজ্ঞের এই সময়ে বিডিএফ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রদত্ত ভাষণ প্রাসঙ্গিক, গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তিনি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহের উদ্দেশ্যে, ‘সমৃদ্ধির পথ যাত্রায় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) বৈঠক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি দেশের বর্তমান চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বলেন, ‘পরিবেশের পরিবর্তন ও জলবায়ুসংক্রান্ত হুমকি মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করা। এজন্য উন্নত দেশগুলোকে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আমরা আন্তর্জাতিক সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোসহ ব্যক্তি খাতের অংশীদারিত্বকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।’ তার এই বক্তব্য ও আহ্বানের সূত্র ধরে বলা প্রাসঙ্গিক যে, হাল জামানায় তথা প্রযুক্তি, জ্ঞান, বিজ্ঞানের এই যুগে কোনো দেশ এখন এক বা একা নয়, তাকে চলতে হয়, অন্যদেশ, বন্ধু, ভ্রাতৃপ্রতিম দেশসমূহ ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহকে সঙ্গে নিয়ে। আর সে কারণে প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বান যৌক্তিক, প্রাসঙ্গিক এবং সময়োপযোগী। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (বিডিএফ) একটি উচ্চপর্যায়ের ইভেন্ট যেখানে সরকার এবং তার উন্নয়ন অংশীদারদের নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য আরও অংশীদারিত্ব আবিষ্কার করতে কাজ করে। এখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এজেন্ডাগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অংশীদারিত্ব বজায় রাখার বিষয়ে আলোচনা করতে বিভিন্ন গবেষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সরকারি নীতিনির্ধারক এবং সহযোগী উন্নয়ন সংস্থাগুলোর নেতারা সমবেত হন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রথমবারের মতো ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ইউএনসিডিপির ত্রি-বার্ষিক পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা লাভ করবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমকক্ষ হবে। তবে এলডিসি হিসাবে বাংলাদেশ বর্তমানে যেসব সুবিধা ভোগ করে, গ্র্যাজুয়েশনের পর তা বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং কার্যক্ষেত্রে প্রস্তুতির মাধ্যমে তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে অমিত সম্ভাবনার দেশ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘বিশ্বের বুকে একটি গতিশীল অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার প্রত্যয় ও উপকরণ আমাদের রয়েছে। আশা করি বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের এ বৈঠক দারিদ্র্যমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য যৌথ কর্মপন্থা নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশকে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।’ এ জন্য প্রয়োজন কর্মপরিকল্পনা। ‘উত্পাদনশীলতাকে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি করে বিনিয়োগের সীমাবদ্ধতাগুলো আংশিকভাবে পুষিয়ে নেয়া যেতে পারে। শিক্ষা ও দক্ষতার সঠিক ব্যবহারের ফলে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নসহ রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগকে উত্সাহিত করবে।’ ইতোমধ্যে ‘স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। সারাদেশে ১৮ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি মাধ্যম হিসেবে এ উদ্যোগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।’ ‘নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতার অন্যতম দুটি প্রধান কারণ হচ্ছে, দারিদ্র্য এবং জেন্ডার-বৈষম্য। আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর ক্ষমতায়ন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশ জেন্ডার বাজেট প্রণয়নে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে নেতৃস্থানীয় দেশ। ‘শহরে টেকসই পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে বড় বাসের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ র্যাপিড মাস ট্রানজিট, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং রেলভিত্তিক মাস ট্রানজিট সিস্টেম চালু করা হয়েছে। প্রাইভেট সেক্টর এবং এনজিওগুলোকেও হাউসিং এবং অন্যান্য সার্ভিস ডেলিভারি যেমন স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদির ক্ষেত্রে অংশগ্রহণে উত্সাহিত করা হচ্ছে।’ প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের সঠিক বাস্তবায়ন দরকার। তবে ইতোমধ্যে এ জন্য প্রয়োজন অধিকতর বৈদেশিক বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রমও সরকার বাস্তবায়ন করছে। তার বক্তব্যে ওঠে আসে ‘কৃষিতে জলবায়ু ও দুর্যোগসংক্রান্ত ঝুঁকি প্রতিরোধ এবং হ্রাস করার জন্য আমরা টেকসই ও উত্পাদনমুখী কৃষি পদ্ধতির ওপর গুরুত্বারোপ করেছি। গবাদিপশু উত্পাদনের পদ্ধতি ও পরিবর্তিত গ্রেইজিং পদ্ধতি প্রবর্তন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। একই সঙ্গে আমরা জলবায়ু সহনীয় খাদ্য উত্পাদন পদ্ধতি, লবণাক্ত পানি এবং বন্যা সহনীয় শস্যাদি উত্পাদনের চেষ্টা করছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত এক দশকে আমাদের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.২৬ শতাংশ। গত অর্থবছরে এ হার ৭.২৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে আমাদের রফতানি আয় ও বিদেশ থেকে প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় নয়গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।’ তার বক্তব্যে ওঠে এসেছে ‘১৯৯১ সালে যেখানে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ, এখন সেই হার ২২ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। অতি দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৯ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দারিদ্র্যের হার ১৪ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিরন্তর কাজ চলছে। জিডিপির ভিত্তিতে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ৪৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ আর ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে এর অবস্থান ৩২তম উল্লেখ করেন তিনি। তাতে ফুটে ওঠে আন্তর্জাতিক আর্থিক বিশ্লেষকদের মতে ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ জিডিপি ও ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে বিশ্বের যথাক্রমে ২৮ ও ২৩তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্থান করে নিতে সক্ষম হবে। বক্তব্যে ওঠে আসে ‘চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রেমিট্যান্স এসেছে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিদ্যুত্ উত্পাদন দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট। শতকরা ৮৩ ভাগ মানুষ বিদ্যুত্ সুবিধার আওতায় এসেছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ বছর হয়েছে।’ ‘২০৪১ সালে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে আমাদের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, রূপকল্প-২০২১ এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জন করতে হবে। দেশকে সামনের দিকে এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। রূপকল্প-২০২১-এর লক্ষ্য হচ্ছে- বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করা।’ এ জন্য ৭ম, ৮ম ও ৯ম- এ তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ২০৩০ বাস্তবায়ন করা এখন জরুরি। জাতিসংঘের ২০৩০ এজেন্ডা নির্ধারণের যখন প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল তখন ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়- যার ফলে বিশ্ব উন্নয়ন এজেন্ডা প্রণয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছি। একই সঙ্গে আমাদের জাতীয় পরিকল্পনায় তার প্রতিফলন ঘটাছে সাফল্যজনকভাবে।’ সদ্য সমাপ্ত এ ফোরামে এজেন্ডা বান্তবায়নে সব লক্ষ্য ও কৌশল বিডিএফ নেতাদের সামনে তুলে ধরা হয়। এ উন্নয়ন পরিকল্পনার লক্ষ্য ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগী, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও বেসরকারি খাতসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’ লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক |