শিরোনাম: |
চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক হোক বন্ধুত্বপূর্ণ
|
মীর আবদুল আলীম : সেবার শপথ নিয়েই চিকিত্সকদের চিকিত্সা পেশায় প্রবেশ করতে হয়। এ পেশাটি রাষ্ট্রের অন্যান্য পেশার তুলনায় অনেক বেশি সম্মানের। এটা পেশা হলেও, চিকিত্সকরা মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করেন বলে এটি মানব সেবার একটি অংশ। কিন্তু আজকাল এ পেশার মানুষ কেমন যেন রাজনৈতিক আচরণ করতে শুরু করেছেন। আমরা দেখে আসছি, রোগীকে জিম্মি করে হরহামেশাই ধর্মঘটে যান চিকিত্সকরা। এ জন্য ইতোমধ্যে অনেক রোগী চিকিত্সা না পেয়ে মারা যাবার ঘটনাও ঘটেছে। বোধ করি বাংলাদেশে ছাড়া এমন নজির আর কোথাও নেই। রোগীদের জিম্মি করে চিকিত্সকরা এর আগে বহুবার তাদের দাবি আদায় করেছেন। ইন্টার্ন চিকিত্সকরাও বিভিন্ন ঘটনার প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করেন। আবার চিকিত্সকরা রাজধানীতে থাকতে পছন্দ করেন। গ্রামে যেতে চান না। স্বাস্থ্যসেবার স্বার্থে ডাক্তারদের যে কোনো জায়গায় কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে, অন্যথায় নতুন নিয়োগ দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ডাক্তার আমরা নিয়োগ দিচ্ছি। কিন্তু যেই আমরা উপজেলায় পাঠাচ্ছি সেখানে না থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। সরকারি চাকরি হলেই এ সমস্যাটা হয়। যেই আমরা দিয়ে দিচ্ছি, অমনিই যে কোনোভাবে কায়দা-কানুন করে ঢাকায় চলে এসে বসে থাকবে। তিনি বলেন, এভাবেই যদি কেউ চলে আসে তাহলে তো তার আর চাকরি করার দরকার নেই। ঢাকায় বসে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করলেই তো অনেক টাকা পাবে। দয়া করে তারা বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে যাক আমরা নতুন নিয়োগ দেব। শেখ হাসিনা বলেন, স্বাস্থ্যসেবা আমরা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছি। জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’ অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও জনবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য। চিকিত্সকদের একটু দরদি স্পর্শ, একটু সহানুভূতি, একটু হাসিমাখা মুখের কথা এমনকি জটিল ও কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিকেও আশাবাদী করে তোলে, রোগযন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়। চিকিত্সকদের বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো রোগীর পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু চিকিত্সা প্রদান নয়, মুখের একটু কথাতেও অনেক সময় রোগী সুস্থবোধ করেন। এটা নিশ্চিত করেই বলা চলে যে অনেক চিকিত্সক স্বপ্রণোদিত হয়েই এমনটি করেন। তাদের কারণেই দরিদ্র ও অসহায় নারী-পুরুষ হাসপাতালে কিংবা চিকিত্সকের চেম্বারে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকে। স্বাস্থ্যসেবার প্রসারের জন্য সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করছে তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে না পৌঁছলে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্ররা। সচ্ছল জনগোষ্ঠীর জন্য কেবল রাজধানী ঢাকা নয়, অনেক জেলাতেও বিশ্বমানের হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্র গড়ে উঠছে। দরিদ্রদের তো বিকল্প নেই। তাদের সরকারি হাসপাতালেরই দ্বারস্থ হতে হয়। উন্নত দেশগুলোতেও সরকারি চিকিত্সা কেন্দ্রে মানুষ চিকিত্সাসেবা নিচ্ছেন। অসহায় রোগীদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের কৌশল কি মানবসেবার ধর্ম হতে পারে? দেখা যায়, অপরাধ করে সাজা পাওয়ায় পরিবহন শ্রমিকরা যেমন অপরাধী দুই খুনি চালকের পক্ষ নিয়ে দেশজুড়ে ধর্মঘটের নামে নৈরাজ্য করেছে ইন্টার চিকিত্সকরাও তাদের কোনো সহকর্মীকে অপরাধ থেকে বাঁচাতে অনেক সময় একই পথ বেছে নেন। এই হলো আমাদের চিকিত্সকদের মহান পেশা! ‘কসাই আর ডাক্তার দুটোই আজ প্রফেসন...।’ নচিকেতার গানের চিকিত্সকরা তো তাই মনে হচ্ছে। বিখ্যাত এ গায়ক তার গানে কেন কসাইয়ের সঙ্গে ডাক্তারদের গুলিয়ে ফেললেন? কেন এক কাতারে তাদের দাঁড় করালেন এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। চিকিত্সকগণ (সবাই নন) মাঝে মাঝে কসাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। অহেতুক অপারেসন করা, ভুল চিকিত্সা করা, কমিশনের জন্য অহেতুক টেস্ট দেয়া, ভিজিট বেশি নেয়া, রোগীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ- এমন এন্তার অভিযোগ আছে এই মহান পেশার লোকদের বিরুদ্ধে। আমারা প্রায়ই দেখি কিছুনা কিছু হলেই রাজনীতিবিদ আর পরিবহন শ্রমিকদের ন্যায় তারা ধর্মঘট করেন। প্রশ্ন আসে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের জীবন নিয়ে ধর্মঘট হয়কি? এটি কিছুতেই আইনসিদ্ধ হতে পারে না। এটা মোটেও মানবিক নয়। চিকিত্সকের সেবার সঙ্গে মানুষের জীবন রক্ষার বিষয়টি জড়িত। জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কোনোই অধিকার নেই কারও। রাষ্ট্রের কেউ কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেই পারেন। আইনের মাধ্যমেই তাকে লড়তে হবে। চিকিত্সকদের মাঝে নীতিনিষ্ঠা, মানবিকতা, সদাচার, কর্তব্যপারায়ণতা- এসব গুণের বেশি পুজারি হওয়ার কথা। কখনো রাজনৈতিক কারণ, কখনো বা রোগীদের স্বজনকর্তৃক আইনি আশ্রয় নেয়াসহ চিকিত্সকদের লাঞ্ছিত কিংবা মারধরের ঘটনা ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনি আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে চিকিত্সকদের নিরাপত্তায় আইনও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। কোনো দল বা মতের সমর্থন করা দোষের নয়, তবে তাতে যদি চিকিত্সাধীন রোগীর জীবনহানির আশঙ্কা সৃষ্টি হয় কিংবা রোগীদের নিয়ে স্বজনরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন, তবে চিকিত্সকদের প্রতি রোগীর আস্থা হারিয়ে তাদের প্রতি ভিন্ন ধারণার সৃষ্টি হবে। যা চিকিত্সকদের জন্যও যেমন কল্যাণকর হবে না, তেমনি রোগীদের জন্য তো কল্যাণকর নয়ই। চিকিত্সকরা ভুলের ঊর্ধে নন। অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের মতো তাদেরও ভুল হওয়া স্বাভাবিক। চিকিত্সকদের অনিচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃত ভুল যেভাবেই হোক, এর ফলে যদি কোনো রোগীর প্রাণহানি কিংবা অঙ্গহানি হয় তবে স্বাভাবিকভাবেই রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা সেটা মানতে নারাজ হবেন। তাই এক্ষেত্রে চিকিসকদের সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করা বাঞ্ছনীয়। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তাবিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের, নাগরিকের চিকিত্সা সেবা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমরা মনে করি, সরকারি চাকরিজীবী চিকিত্সকদের অবশ্যই অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের মতোই সম্পূর্ণভাবে সরকারি আইন ও বিধিবিধান-শৃঙ্খলা মেনে চলা বাধ্যতামূলক। চিকিত্সকদের কাছে কোনো অশোভন বা সেবাবহির্ভূত আচরণ জনগণ প্রত্যাশা করে না। সমাজে চিকিত্সকরা একটি শিক্ষিত ও সম্মানিত পেশাজীবী মহল। তাদের অমানবিকতা অথবা উদাসীনতার কারণে হারিয়ে যেতে পারে অনেক প্রাণ। চিকিত্সা পেশা একটি মহত্ পেশা- চিকিত্সকদের এটা বিবেচনায় রাখতে হবে। চিকিত্সকদের প্রথম কাজই হচ্ছে রোগীর সেবা দেয়া। মনে রাখতে হবে, চিকিত্সকদের এক মিনিটের কর্মবিরতিতে একটি জীবনহানি ঘটতে পারে। এ কথা সত্য যে, চিকিত্সায় অবহেলার অভিযোগ তুলে রোগীর স্বজন কর্তৃক হাসপাতাল ও ডাক্তারের চেম্বার ভাঙচুরের বিষয়টি বিভিন্ন সময় ঘটছে। ডাক্তারদের মারধরের ঘটনাও ঘটছে। এ ধরনের ঘটনা আশা করা যায় না। প্রশাসনকে এসব ঘটনা রোধে দায়িত্ববান হতে হবে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের চরম অসুবিধার দৃষ্টান্ত অগণিত। এ সব সমস্যার কোনো প্রতিবাদে চিকিত্সক সংগঠনের সোচ্চার হতে হবে। চিকিত্সা পেশাটি মানুষের সেবা করার অসাধারণ এক মহান পেশা। তারাই পারে একজন মুমূর্ষু মানুষকে নতুন জীবন দিতে, পারে অসংখ্য অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ পেশায় মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তবে তাদের মানবিক বোধ বাড়ছে কি-না তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। যারা সত্যিকার অর্থে সেবার মানসিকতা নিয়েই এ পেশাটিকে বেছে নিয়েছেন এবং এখনও নীরবে সাধারণ ও অসহায় মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন, তাদের কাছে চিকিত্সা পেশাটি শুধুই অর্থ বানানোর হাতিয়ার নয়, সেবাটাই প্রধান কর্ম। এ সংখ্যা আনুপাতিক হারে যেন কমে আসছে। অবহেলা, অসদাচরণ ও ভুল চিকিত্সাসহ নানা কারণে দেশের চিকিত্সক সমাজের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে যাচ্ছে। উচ্চবিত্তের পাশাপাশি সামর্থ্যবানরা এখন হরদম বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন চিকিত্সা সেবা নিতে। তাই ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান রাখা দরকার। কেননা ডাক্তাররাই তাদের মেধা ও মানবিকতা দিয়ে রোগীর সেবা করতে পারেন। রোগী-ডাক্তার সম্পর্ক অটুট থাকবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। লেখক : কলাম লেখক। |