শিরোনাম: |
স্মৃতির পাতায় ভাষা সৈনিক ও নাট্যকার মমতাজ
|
বেগম মমতাজ হোসেন। এটি শুধু একটি নামই নয় যেন অনুপ্রেরণা। যেমনি বেগম রোকেয়া! তাই তো জীবন ভর পেয়েছেন অনেক যশ, অনেক খ্যাতি। রাষ্ট্রও দিয়েছে তাকে সর্বোচ্চ সম্মাননা। পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার‘বেগম রোকেয়া পদক-২০০৯’ সহ আরও অনেক পদক। অনেক গুণে গুণান্বিত এই মহিয়সী নারী জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে রেখে গেছেন বিস্তর শিক্ষার খোরাক। একাধারে বেগম মমতাজ হোসেন একজন ভাষা সৈনিক, শিক্ষাবিদ, লেখক, প্রকাশক, নাট্যকার এবং একজন সফল সংগঠক। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধেও যার রয়েছে বিরল ভূমিকা। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, শিশুদের নিয়ে এবং সমাজ ও দেশ নিয়েও। তার অজস্র গল্প, শিশু সাহিত্য এবং নাটকে উঠে এসেছে সমাজের অনেক অন্তরায় ও সমাধানের পথ। যা কাজে লাগিয়ে হয়তো আরও অনেক নারী নিজেকে মেলে ধরতে সক্ষম হবেন। আর তাই তো তার স্বরণে চারুলতায় আজ রইলো ‘স্মৃতির পাতায় শিশু সাহিত্যিক ও নাট্যকার মমতাজ হোসেন’ কে নিয়ে বিশেষ ফিচার। লিখেছেন- অনিন্দ্য তাওহীদ পুরো নাম বেগম মমতাজ হোসেন। স্বামী প্রয়াত একেএম জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি ১৯৮১ সালে মারা যান, যিনি পুলিশের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। বাবা মরহুম আবু সৈয়দ আহম্মদ এবং মা মরহুমা আমিরুন্নেছা খাতুন। বরিশাল জেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪০ সালের ২৮ মার্চ জন্ম গ্রহণ করেন এবং ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরকালে চলে যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে নানাভাবে আলো ছড়িয়ে গেছেন তিনি। কখনো শিক্ষক, কখনো সমাজসেবক, আবার কখনো লেখনির মধ্যে দিয়ে সমাজ পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে থেকে সাহস জুগিয়েছেন। ’৫২-র ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। তবে শুধু এখানেই থেমে থাকেননি, দীর্ঘ ৯ মাস বাংলাদেশ স্বাধীনের জন্য মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন। সে সময়ে মালিবাগে ক্যাপ্টেন দেলোয়ারের নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন দেলোয়ার হোসেন মুজিব বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়ে তার ঠিকানায় যোগাযোগ করতো। আর তিনি তাদের যাবতীয় সরঞ্জামাদি দিয়ে সহযোগিতা করতো। ওই সময়ে তার প্রধানতম কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাদ্য, ওষুধ, গরম কাপড় সরবরাহ করা। এছাড়াও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিত্সা, রাস্তা পারাপার ও নিরাপদ স্থানে রাখার সংবাদ আদান-প্রদান করা। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম প্রচারের দিন শিশুদের জন্য তার রচিত ‘রক্ত দিয়েছি, স্বাধীনতা পেয়েছি’ নাটকটি প্রচারিত হওয়ায় মমতাজ আরও বেশি পরিচিতি পায়। সেই থেকে নানা চড়াই-উত্ড়াই পেরিয়ে সফলতার শীর্ষে উঠে আসেন বেগম মমতাজ। পরে তার বহুপরূপী গুণের কারণে তার হাত ধরেই ‘শেখ মনি’ সার্টিফিকেট প্রদান করেন, যাতে ভালো কাজে অন্যদের আরও উত্সাহ-উদ্দীপনা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। শিক্ষাজীবনে বেগম মমতাজ হোসেন প্রধান শিক্ষায়ত্রী ছিলেন বরিশালের নাম করা উদয়ন স্কুলের, ঢাকার কচি কণ্ঠ উচ্চ বিদ্যালয়ের। রেক্টর ছিলেন আরব মিশন পাবলিক স্কুলের। প্রিন্সিপাল ছিলেন, বোস্টন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের। প্রতিষ্ঠাতা-অবসরে লেখাপড়া (সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও নারীদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান)। শিক্ষাবিদ, নাট্যকার এবং সাহিত্যিক বেগম মমতাজ হোসেনের জীবদ্দশায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ছিল পরিবারের গল্প নিয়ে ৫৮ পর্বের ‘সকাল সন্ধ্যা’ ও ২৬ পর্বের ‘শুকতারা’ মহান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক। তিনি এই দুটি নাটকের নাট্যকার ছিলেন। এছাড়াও তার রয়েছে অসংখ্য লেখা নাটক। যার মধ্যে অন্যতম: থেমে নেই জীবন, অতন্দ্র প্রহরী, বকুল ঝরার দিনে, সেকেন্ড হ্যান্ড এবং ত্রয়ী। আরও আছে ধারাবাহিক ও সাপ্তাহিক নাটক। যেমন: ১৬ পর্বের ‘বড় বাড়ী’ ও ‘বেলা অবেলা’। জানা যায়, ধারাবাহিক ও সাপ্তাহিক প্রায় ৪০টি নাটকের অধিকাংশই বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার (রেডিও) এ প্রচার হয়েছে। এসবে ফোকাস হয়েছে যাপিত জীবন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী অধ্যায় আর শিশুদের জন্য করণীয় বা শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু। শিশুদের জন্যও ছিল তার লেখা অনেক ধারাবাহিক ও সাপ্তাহিক নাটক। যার মধ্যে অন্যতম ছিল- ‘রোজ রোজ’ যেটি সাড়ে তিন বছর টেলিভিশনের পর্দায় প্রচার হয়েছে, ‘জুঁই জোনাকী’ ও ‘আপন জন’ চলে এক বছর এবং ‘সবার সাথে’ চলে ছয় মাস। এছাড়া ‘কাঠ বিড়ালী ও লিচু চোর’ শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে মুক্তি পায়। আর সাপ্তাহিক নাটক হিসেবে চলে ‘সোনা ভাই’ যেটিতে মূলত শোভা পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশর জীবনের গল্প। শিশু শিক্ষার মান উন্নয়নে তার লেখা শিশুতোষ পাঠ্যবই সোনামনিদের পড়া (১ম ভাগ) ১৯৭৮-২০০৪, ৬ষ্ঠ সংস্করণ চলছে এবং সোনামনিদের পড়া (২য় ভাগ) ২০০৯, প্রকাশক-মওলা ব্রাদার্স। আবার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথের ‘পরিচয়ের’ কবিতায় ও জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’, ‘খুকি ও কাঠবিড়ালী’ কবিতার নাট্যরূপও দিয়েছেন তিনি। এছাড়াও তার প্রকাশিত অনেক গ্রন্থের মাঝে অন্যতম ‘স্বপ্নের বন্ধু’ প্রকাশক, ধানশীষ প্রকাশনী-১৯৮০, যেটির কারণে পরে তিনি ১৯৮৩ সালে অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার পান। ‘রঙধনুর রঙ’ প্রকাশক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী-১৯৮৪। এটিও ১৯৮৭ সালে অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার ছিনিয়ে নেয়। আরও আছে তার রচিত, হিজল তলীয় গাঁয়ে (মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন বিষয়ক) প্রকাশক, ধানশীষ প্রকাশনী-১৯৮৫, ও আঁধার রাজ্যের রাজা (রূপকথা) প্রকাশক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি-১৯৯২। বেগম মমতাজ হোসেন সমাজের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন বহুবার বহুভাবে। বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য, বধির কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, মহিলা সমিতি, ন্যাশনাল উইমেন্স ফেডারেশন এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন- ঢাকা শিশু নাট্যমের। জ্ঞান আহরণ ও দেশকে এবং দেশের মানুষকে আরও কিছু বাড়তি দিতে তিনি একাধিকবার দেশ-বিদেশ ভ্রমনও করেছেন। অংশ নিয়েছেন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ নানা বর্ণিল অনষ্ঠানে। উল্লেখ্য, প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবীরের বোন এবং প্রয়াত চিত্রশিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা খালিদ মাহমুদ মিঠুর মা। |