শিরোনাম: |
সৃজনশীলতা ও শিক্ষার বাস্তবতা
|
জি. কে. সাদিক : মানুষের জ্ঞান ক্রমবর্ধমান ও নতুনত্ব সন্ধানী। শিক্ষা মানুষের আচার-আচরণ ও চিন্তাধারাকে পরিশীলিত করে। নতুনত্বের আকাঙ্ক্ষা মানবসভ্যতাকে ক্রমে উত্কর্ষ অর্জনে প্রেরণা দিয়েছে। এক সময় গ্রামের মানুষ ছিল কৃষিনির্ভর। ক্রমশ কমে আসছে কৃষিনির্ভরতা। কৃষকের ছেলে পৈতৃক সম্পত্তিতে চাষ করবে এটাই ছিল গ্রাম্য প্রথা। কিন্তু এখন এমন মানসিকতা আর নেই। গ্রামীণ জীবনে আসছে পরিবর্তন। এখন গ্রাম-শহর সর্বত্র চলছে শিক্ষা বিপ্লব। পেশা পরির্বতনে ও উন্নত জীবনের সন্ধানের প্রতিযোগিতা চলছে। সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই শিক্ষা বিপ্লব শুরু হয়েছে। প্রারম্ভেই একটা কথা বলেছি যে, ‘মানুষের জ্ঞান ক্রমবর্ধমান ও নতুনত্ব সন্ধানী।’ আর শিক্ষার মাধ্যমেই জ্ঞানার্জন হয়। তাহলে আমাদের জ্ঞান কি বৃদ্ধি পাচ্ছে? আমরা কি নতুন কিছু পাচ্ছি? কারণ মানুষের জ্ঞান ভাণ্ডার সমৃদ্ধি লাভ করে শিক্ষা লাভের মাধ্যমেই। জ্ঞান মানুষকে প্রতিনিয়ত নতুনত্বের সন্ধান দেয়। পুরাতনকে পরিবর্তনের শিক্ষা দেয়। জরাজীর্ণতাকে উপড়িয়ে নতুন করে গড়ার সাহস ও প্রেরণা জোগায়। আমাদের দেশে পল্লী থেকে শহর পর্যন্ত শিক্ষা বিস্তার হচ্ছে, মানুষ জ্ঞানার্জন করছে, কিন্তু নতুনত্ব বা সৃজনশীল কিছু পাচ্ছি না। পুরনো ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন পাচ্ছি না। গতানুগতিতা থেকে বের হয়ে জরাজীর্ণতাকে কাটিয়ে মসৃণ, কল্যাণময় একটা সমাজ গঠন করতে পারছি না। তাহলে কি বলব? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি ব্যর্থ হচ্ছে নতুনত্বের সন্ধান দিতে? না কি আমাদের গতানুগতিক চিন্তাধারা ও প্রথাগত পেশা গ্রহণের প্রবণতা এ জন্য দায়ী। এ নিবন্ধে সে বিষয়েই আলোচনা করার চেষ্টা করব।
আমি শিক্ষা গ্রহণ বা শিক্ষা কথাটা দ্বারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পুস্তক সর্বস্ব যে বিদ্যার ঝুলি বিতরণ করা হয়, সেই প্রথাগত শিক্ষাকে বুঝি না। আমরা পাঠ করি কিন্তু তার মর্মার্থ অনুধাবনে সচেষ্ট নই। যতটা সচেষ্ট মর্মার্থ অনুধাবনে নই তার চাইতে অনেক কম সচেষ্ট তা বাস্তবায়নে। কেন এমনটা হয় সে আলোচনার জন্য এই নিবন্ধন। কবি সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতাটা আমরা পড়েছি ঠিকই কিন্তু তার যথার্থ শিক্ষাটা যতটা বোঝার প্রয়োজন ততটা বুঝতে পারিনি। আর যাও বুঝেছি তা প্রয়োগে আরও বেশি অক্ষম। কবি তার কবিতায় বিশ্বের যাবতীয় কিছুকে শিক্ষক ভেবেছে আর নিজে হয়েছে তার ছাত্র। কবি সূর্যকে, বায়ুকে, পাহাড়কে এমনভাবে গোটা সৃষ্টি জগতটাকেই শিক্ষালয় হিসেবে গণ্য করেছেন। যা শিক্ষার বাস্তব উপকরণ। শিক্ষার অন্যতম একটা গুণ হলো যে, শিক্ষা হবে প্রয়োগধর্মী। শিক্ষা বাস্তবতার চাহিদার আলোকে হবে। আর আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে জীবনের সর্বত্র শিক্ষার প্রয়োগ ঘটাবে। শিক্ষার আলোকে সে হবে সৃষ্টিশীল গুণের অধিকারী। যাকে আমরা বলি সৃজনশীলতা। আর কবি তার কবিতায় সেই কথায় বলেছেন। আমরা এই কবিতা পড়েছি কিন্তু ‘বায়ুর কাছে উদার হওয়ার যে মন্ত্র শিক্ষার কথা বলেছেন তা কি আমাদের জীবনকে স্পর্শ করতে পেরেছে? কোটি টাকার প্রশ্ন। যদি পারে, তাহলে আমরা কি উদার হতে পেরেছি? যদি না পারি তাহলে সমস্যা কোথায় সেটা খুঁজে বের করতে হবে। সমাধানের পথটা বের করতে হবে। তা না হলে আমরা সৃজনশীলতা থেকে, কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবো। আর সৃজনশীলা বাদে জগত্ আলোকিত হতে পারে না। গতানুগতি কাজ সব সময় উন্নয়নের পরিপন্থী। তাই আমাদের শিক্ষার্থীদের গতানুগতি ও প্রথাগত প্রবণতা থেকে রক্ষা করতে হবে তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে সৃজনশীল কাজে লাগাতে হবে। তাদের উত্সাহ দিতে হবে নতুনত্বের প্রতি। শিক্ষাকে যদি আমরা সমাজ থেকে বাহিরে নিয়ে যাই তাহল শিক্ষা তার লক্ষ্যচ্যুত হতে বাধ্য। কারণ মানুষ যে শিক্ষা গ্রহণ করে তার আলো সমাজে বাস্তবায়ন না হলে সে সমাজ শিক্ষার ফল থেকে বঞ্চিত হবে। অজ্ঞতার অন্ধকার ছেয়ে বসবে। একটা অপ্রিয় সত্য কথা হলো আমাদের শিক্ষা সমাজের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে হচ্ছে না। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক শিখছি আর সমাজে অন্যভাবে মিশছি। কারণ যেখান থেকে শিক্ষার উপকরণ সংগৃহীত হয় আমরা সে স্থান থেকে দূরে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি সমাজ বদলানোর শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে গতানুগতিতা আমাদের সমাজকে অচল করে দেবে। সম্প্রতি দেশে বেকারদের সংখ্যা নিয়ে বেশ দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে ২৬ লাখ অন্যদিকে সরকার বলছে ৪ লাখ। তবে আমি বেকার সংখ্যাকে প্রাধান্য দিচ্ছি না। আমি প্রাধান্য দিচ্ছি বেকারত্ব সৃষ্টি হওয়াটাকে। যদি প্রশ্ন করি কেন বেকারদের সংখ্যা বাড়ছে? অনেক উত্তরই পাব। আমিও আমার মতো করে কিছু ভাবেছি। যেমন; একজন শিক্ষার্থী ১২ বছর যে শিক্ষা গ্রহণ করেছে তার সঙ্গে মিল নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ বছর অধ্যয়ন করে যা অর্জন করেছে তার সঙ্গে মিল নেই চাকরির বাজারের। ১২ বছর পড়ে আমার তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। আবার ৫ বছর পড়া শেষ করে আলাদাভাবে চাকরির প্রস্তুতি নিতে হয়। তার মানে একটার সঙ্গে আরেকটার মিল নেই। পেটে ভাত না গেলে সৃজনশীল চিন্তা বের হয় না। নতুনত্বের প্রতি আগ্রহ বোধ হয় না। একদিকে আমরা চাই সুন্দর সমাজ-দেশ আর অন্য দিকে মেধার বিকাশ করে রেখেছি বন্দি। কারণ শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করছে তার মূল উদ্দেশ্য হলো নিজে উন্নত জীবনযাপন করা। মেধা খাটিয়ে তারা আর সমাজ-দেশের জন্য ভাবে না। তারা ক্রমে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। সুন্দর সামাজ গঠনের চিন্তা আর তাদের মাথা থেকে বের হচ্ছে না। আর বের হবেই বা কি করে। বিশ্বময় চলতে উন্নয়নের প্রতিযোগিতা। কেউ এমন কিছু করতে চাইবে না যাতে সে উন্নয় প্রবাহ থেকে পিছিয়ে পড়ে একঘরে হয়ে থাকবে। প্রত্যেক মানুষই চায় নিজের উন্নত অবস্থান। কথা হচ্ছে উন্নত অবস্থান লাভের আশায় আমরা একমুখী হয়ে উঠেছি। পড়ালেখা শেষ করে আশা একটাই যে, সরকার চাকরি নিয়ে বসে আছে। আমি সে চাকরি করব তা যেভাবেই হোক। প্রয়োজনে মামা-খালু-চাচা থেকে শুরু করে যত টাকার প্রয়োজন হয় দিব। পরে তো শুধ করে নিতে পারবোই। একটা বিষয় আমরা কখনও ভাবি না যে, আমি স্বনির্ভর হতে পারি কি না। মেধা, সৃজনশীলতা দিয়ে স্বনির্ভরতা অর্জন ও তা থেকে সমাজ আরও মানুষের কর্মস্থান সৃষ্টির চিন্তা আমাদের দেশে তরুণ সমাজের মধ্যে খুবই কম। আর তরুণদেরকে সৃষ্টিশীল ও স্বনির্ভর হয়ে উঠতে প্রেরণা, প্রণোদনা দিতে আমাদের সমাজপতিদের আগ্রহও বেশ তলানিতে। অন্যদিকে চাকরির বাজারে চৈত্রখড়া চলছে। দুয়ে মিলে মেধাবীরা ক্রমশ হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। যেখানে হতাশার উদয় হয় সেখানে সৃজনশীল চিন্তা অস্ত যায়। আমাদের দেশে এমনটাই হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান শাখা থেকে পড়ালেখা শেষ করে তার মেধা অনুযায়ী ওই শাখায় কিছু করার মতো সুযোগ না পেয়ে সে যখন অন্য পথে জীবিকার অন্বেষণে বের হয় তখন তার অর্জিত জ্ঞান আর কোনো উপকার দিতে পারে না। আমরা বিজ্ঞান শাখার প্রতি সবাই আগ্রশীল, কিন্তু বিজ্ঞানকে প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য ঠিক ততটাই পিছিয়ে আছি। তাহলে একজন শিক্ষার্থীর ১৭ (প্রাথমিক থেকে মাস্টার্স) বছরে অর্জিত মেধার কতটা অবমূল্যয়ন হচ্ছে তা বুঝতে আর বাকি নেই। যখন কেউ এমন নিগ্রহের চিত্র প্রত্যক্ষ করে তখন তার মাথায় ১৭ বছরে অর্জিত বিদ্যা দিয়ে কিছু করাবর চিন্তা আর থাকে না। সে শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই গতানুগতিক ও নাম সর্বস্ব শিক্ষা নিতে থাকে, প্রস্তুত হতে থাকে উন্নত জীবিকা জন্য। তাই তো বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীকে ব্যাংকের চাকরির প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। আমার এক নিকটাত্মীয় সে পড়ালেখা করেছে বিবিএ’তে আবার এমবিএ করেছে। আর এখন একটা কোম্পানিতে আইটি সেক্টরে চাকরি করছে। তার কাছ থেকে বাণিজ্য শাখায় কোনো গবেষণাধর্মী জ্ঞান বা সৃজনশীল কিছু আশা করা বোকামি ছাড়া কিছুই হবে না। এমনইভাবে নানা অসংঘতি বিদ্যমান আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও চাকরির বাজারে। বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটা দেশ পরিচালনার মূল কর্ণধার উত্পাদনের স্থান। সব শ্রেণির মানবসম্পদ উত্পাদনের স্থান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর মানবসম্পদ উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নেই। কথিত বিসিএস, ব্যাংক জব, শিক্ষকতা, আইন পেশার কর্মী উত্পাদনের কারখানার রূপ নিয়েছে। এর বাহিরে নতুন কিছু করা বা সৃজনশীল কোনো বিষয়ে ভাবনা আমাদের শিক্ষার্থীদের মাথায় উপস্থিত হতে পারছে না। আর উপস্থিত হলেও তা প্রয়োগের স্থান পাচ্ছে না। একটা উদাহরণ দেই, ধরুন; একজন শিক্ষার্থী মাছ চাষের প্রচলিত অনুন্নত পদ্ধতি থেকে বের হয়ে নতুন একটা প্রজেক্ট স্থাপন করবে যাতে তার নিজের কর্মসংস্থান হবে পাশাপাশি আরও ৫০ জন সাধারণ মানুষ বা অল্পশিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থা হবে, কিন্তু প্রজেক্ট করবার জন্য তার যে আনুসঙ্গিক জিনিস লাগবে তার জন্য প্রয়োজনী অর্থ বা ক্ষমতা তার নেই। এর জন্য তার সাহায্যের প্রয়োজন। আর সে ক্ষেত্রেই আমাদের মূল দুর্বলতা। আমি বলছি না যে কোনো ধরনের ব্যবস্থা সরকারে পক্ষ থেকে নেই। আছে কিন্তু তা অনেকটা আমাবশ্যার চাঁদ। ‘খাজনার চাইতে বাজনাই বেশি।’ মাছ চাষে যে নতুন ও উন্নত ব্যবস্থা সৃষ্টি হতো যাতে হয়তো উত্পাদন বৃদ্ধি ও এই খাতটা আরও সমৃদ্ধি হতো কিন্তু তা আর হলো না। আমরা নতুন কিছু থেকে খুব সহজেই বঞ্চিত হলাম। তেমনি অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। একজন শিক্ষার্থী অর্থনীতি বিষয়ে নতুন কোনো পরিকল্পনা করেছে যেটা আমাদের প্রচলিত বাজার বা ব্যবসায়ী পদ্ধতির চাইতে ভালো কিছু দিতে পারবে। কিন্তু সে সেবা প্রদান ও গ্রহণের মতো মানসিকতা ও সুযোগ দুটারই অভাব রয়েছে আমাদের। তেমনি মানবকি শাখার অবস্থাও একই রকম। যখন একটা বিষয়ে কেউ নতুন কিছু ভাবে এবং বাস্তবায়ন করতে চায়, কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার দরুন সেটা আর বাস্তবায়ন হয় না। তখন সে আর সৃজনশীলতার প্রতি আগ্রবোধ ধরে রাখতে পারে না। তাই কোনো শিক্ষার্থী গতানুগতিক বিসিএস, ব্যাংক জব, আইন পেশা, শিক্ষকতা আর কোম্পানি জবের প্রস্তুতি ছাড়া সৃজনশীল কোনো কাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে চায় না। কারণ ব্যর্থতার গ্লানি বড় কঠিন। তাই আমাদের ভাবতে হবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে, আর শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রস্তুত করতে হবে বাস্তবতার আলোকে। প্রয়োগমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখেই চাকরির বাজারকে সাজাতে হবে। আবার শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজাতে হবে উন্নয়নের জন্য যা প্রয়োজন সে আলোকে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতার প্রতি উত্সাহের সঞ্চার করতে হবে। সে কাজে অনুপ্রেরণা, প্রণোদনাসহ যা প্রয়োজন তা সহজলভ্য করতে হবে। যেন একজন শিক্ষার্থীও তার সুপ্ত সৃজনশীলতা প্রকাশে বাধাপ্রাপ্ত না হয়। মনে রাখতে হবে সৃজনশীলতা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। একটা দেশ নয় পৃথিবীকে রাঙাতে সৃজনশীলতা প্রকাশ ও বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ। লেখক : কলাম লেখক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। |