শিরোনাম: |
চিকুনগুনিয়া: পরবর্তী চিকিত্সা ও পুনর্বাসন
|
ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে শারীরিক অবস্থা কেমন হতে পারে তা সবাই কম বেশি জেনে গেছেন। কিন্তু এর তীব্র ব্যথা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোথাও তেমন একটা উচ্চারিত হয়নি। আমরা চিকুনগুনিয়ার লক্ষণগুলো সংক্ষেপে
জানিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মতো পরবর্তী করণীয় বিষয়গুলো আলোকপাত করতে পারি — - ডা. জাকারিয়া ফারুক চিকুনগুনিয়া কি এটি এডিস মশাবাহিত এক ধরনের ভাইরাস জনিত রোগ। লক্ষণ ও উপসর্গ: এই রোগের লক্ষণগুলো অন্য সব ভাইরাল জ্বরের মতোই। অন্য উপসর্গগুলো হলো- ১. হাড়ের জোড়ায় তীব্র ব্যথাই এই রোগের একমাত্র স্বতন্ত্র উপসর্গ ২. সেই সঙ্গে মাংসপেশীতেও পাকা ফোঁড়ার মতো ব্যথা ও দাঁড়াতে পা ভাঙ্গা ব্যথা অনুভব হতে পারে। ৩. মাথাব্যথা, চোখ জ্বালাপোড়া, বমিভাব, শারীরিক দুর্বলতার সঙ্গে র্যাশ আক্রান্ত হবার লক্ষণ। ৪. জ্বর ব্যথা, র্যাশ ইত্যাদি দুই তিন দিনের ভেতর চলে গিয়ে হঠাত্ তীব্র ব্যথা ও র্যাশ নিয়ে আবার ফেরত আসা ৫. বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিন থেকে চার দিনের মধ্যে জ্বর সেরে গেলেও গিঁট বা জয়েন্ট এর ব্যথা সহজে না সারা। ৬. ব্যথার কারণে রোগীর স্বাভাবিক হাঁটাচলা, হাত দিয়ে কিছু ধরা এমনকি হাত মুঠ করতেও বেশ কষ্ট হওয়া। ৭. শরীর প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পরা। বিশেষ করে বৃদ্ধ, শিশুরা বেশি কাতর হয়ে যায়। পরামর্শ একটানা তিন দিন জ্বর ও হাড় জোড়ায় প্রচণ্ড ব্যথা থাকলে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রথমে জ্বর কমাতে রোগীকে মাথায় প্রচুর পরিমাণে পানি ঢালতে শুরু করুন, শরীর মুছিয়ে দিন, প্রয়োজনে গোসল করিয়ে দিতে পারেন। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করার পাশাপাশি ডাবের পানি, স্যালাইন, লেবুর সরবত ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে। ডায়বেটিস উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি সমস্যাযুক্ত রোগীর স্যালাইন খাবার ব্যপারে সংশ্লিষ্ট চিকিত্সকের পরামর্শ প্রয়োজন। বয়স্ক ও শিশুদের ঠাণ্ডা লেগে যাবার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কীভাবে জানবেন এটি চিকুনগুনিয়া উপরের উপসর্গগুলো দেখা দিলে, ওই ব্যক্তির চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। উপসর্গগুলো শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে ভাইরাসটি পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করার স্থান হলো রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত রোগ তত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআর। এই গবেষণা কেন্দ্রে ‘সেলোরজি’ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব। চিকুনগুনিয়া হলেও চট করেই এন্টিবডি টেস্ট করে ফলাফল সঠিক আসার কথা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ভারতের ‘চিকুনগুনিয়া প্রতিকার, চিকিত্সা ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় নীতিমালা (২০১৬)’তে এর নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হবার ৪-৭ দিনের ভেতর আই জি এম এবং ৭-১৫ দিন সময়ের পর আই জি জি টেস্ট করানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। চিকিত্সা ওষুধ: চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণের চিকিত্সা মূলত উপসর্গ ভিত্তিক। এর কোনো সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা টিকা নেই। প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা পর কিংবা তিনবেলা প্যারাসিটামল খেতে পারেন। সেই সঙ্গে র্যাশ ও চুলকানির জন্যে এন্টি হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ চিকিত্সকের পরামর্শ মতো খেতে হতে পারে। ফিজিওথেরাপি: ব্যথানাশক ব্যবহারে তীব্র ক্ষতির সম্ভাবনা থাকায় চিকুনগুনিয়া নিরাময়ে ফিজিওথেরাপি ব্যথানাশক বা অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি কার্যকর। ইলেকট্রোথেরাপি ও ওয়াক্সথেরাপি এই ধরনের ব্যথা কমাতে খুব কার্যকর। তবে চিকিত্সানির্ভর করবে রোগীর বর্তমান অবস্থার ওপর। চিকুনগুনিয়া পরবর্তী অসুস্থতা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ফিজিওথেরাপি চিকিত্সা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া জরুরি। বাসায় যা করা যেতে পারে ১. মাংসপেশীর তীব্র ব্যথায় ট্যালকম পাউডার বা সামান্য তেলে হালকা ম্যাসাজ করা যেতে পারে। ম্যাসাজের ফলে ওই স্থানের রক্ত চলাচল বেড়ে ব্যথা কমবে। তবে বল প্রয়োগে ও দীর্ঘ সময় ম্যাসাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এর ফলে সফট টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। ২. হাল্কা স্ট্রেচিং বা পেশীর দৈর্ঘ বরাবর খুব সহনশীল চাপে হাত-পা সম্প্রসারণ করে টানটান করা ৩. পেশীতে কম্পন, হাত বা ভাইব্রেটর দিয়ে কম্পন প্রয়োগে পেশীকে রিলাক্স করে দেয়া যেতে পারে ৪. যেহেতু শরীরের তাপ বেড়ে যায় এবং গিঁট ফুলে যেতে পারে তাই গরম তাপ না দিয়ে বরফকুঁচি তাওয়ালে প্যাঁচিয়ে ১০-১৫ মিনিট ঠাণ্ডা স্যাক দেয়া যেতে পারে। বাসায় যারা সেবা যত্ন করবেন তাদের জন্য পরামর্শ ১. রোগীর তীব্র ব্যথা থাকায় তাকে নড়াচড়া করানোর সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন কতে হবে। যে কোন সময় হ্যাচকা টান লেগে প্রচণ্ড ব্যাথা হতে পারে, দাঁড়ানোর সময় অথবা টয়লেট হতে উঠবার সময় পড়ে গিয়ে আঘাত পেলে তা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে। ২. রোগীর মেজাজ প্রচণ্ড খিটমিটে হয়ে যায়। তাই বারবার মাথা ধুয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথা ব্যথার জন্য আলতোভাবে মাথা টিপে দিতে পারেন। রোগীর সঙ্গে উত্তেজিত হবেন না। ৩. বিছানা ও আশপাশ পরিষ্কার রাখবেন ৪. মশার আক্রমণ বন্ধে ও রোগের বিস্তৃতি প্রতিরোধে মশারি টানিয়ে রোগীকে বিশ্রাম দিতে হবে। বিশেষ নির্দেশনা ব্যথাজনিত কারণে চিকুনগুনিয়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে হাড় জোড়া, পেশীর নানা ধরনের ভারসাম্যহীনতা জনিত দুর্বলতা, ব্যথা, ক্ষয় দেখা দিতে পারে। কিছুটা সুস্থ হলে একজন ফিজিওথেরাপি চিকিত্সক/ফিজিওথেরাপিস্টের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কমপক্ষে একমাস পুনর্বাসন ব্যবস্থা হিসেবে ফিজিওথেরাপি গ্রহণ করা যেতে পারে। যেসব পেশার লোকেরা বেশি সাবধান হবেন ১. যারা অনবরত হাতের ক্ষুদ্র গিঁট ব্যবহার করে কাজ করেন যেমন- টাইপরাইটার, কম্পিউটার ব্যবহারকারী, সাংবাদিক, গার্মেন্ট শ্রমিক ২. যারা দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করেন যেমন- পুলিশ, ফটো ও ক্যামেরা সাংবাদিক। সোজা কথায় দীর্ঘ সময় একই ভঙ্গিতে হাতের ক্ষুদ্র গিঁট ও শরীরের ওজন বহনকারী গিঁট ব্যবহার করা পেশাদাররা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হবার পর ক্ষেত্র বিশেষে দুই মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত কাজের পদ্ধতি বদল করে অথবা বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে কাজ করতে হবে। লেখক: বিশেষজ্ঞ ফিজিক্যালথেরাপিস্ট, আল রাজী ইসলামিয়া হাসপাতাল, বনশ্রী, ঢাকা। |