শিরোনাম: |
পরিবেশ দূষণ এবং আমরা
|
রিশিত খান : শব্দ দূষণ রাজধানীসহ সারাদেশে নাগরিকদের জন্য বিরক্তিকর এবং মারাত্মক একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই দূষণের ফলে নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের এক কোটিরও বেশি লোক শব্দ দূষণজনিত রোগে ভুগছে। শব্দ দূষণে প্রতি হাজারে একজন বধির হয়ে জন্মায় এবং জন্মের পর আরও একজন বধির হয়ে যায়। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দূষণ একটি শিশুকে বেড়ে ওঠার আগেই বধির হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাকে করে তুলছে অমনোযোগী ও বিকারগ্রস্ত। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ সমস্যা এখন বৈশ্বিক সমস্যাও বলা যায়। সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশু তহবিল-ইউনিসেফ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি বছর বায়ু দূষণের কারণে পাঁচ বছর বয়সী ছয় লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটে। ম্যালেরিয়া এবং এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত হয়ে যত শিশুর মৃত্যু হয়, এ সংখ্যা তার চেয়ে বেশি।
ইউনিসেফের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া ‘ক্লিয়ার দ্য এয়ার ফর চিলড্রেন’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ৩০ কোটি শিশু এমন এলাকায় বাস করছে, যেখানকার বায়ু অত্যধিক দূষিত। এসব এলাকার বায়ু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিত নিরাপদ সীমার ছয় গুণ বেশি দূষিত। ইউনিসেফ কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বায়ু দূষিত এলাকার তথ্য এবং এসব এলাকায় বাস করা শিশুর সংখ্যাকে সমন্বয় করে গবেষণাটি করেছে। ডব্লিউএইচও নির্ধারিত সীমার ছয় গুণ বেশি মাত্রায় দূষিত এলাকায় যে ৩০ কোটি শিশু বাস করছে, তার মধ্যে ২২ কোটির বাস দক্ষিণ এশিয়ায়। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের সংখ্যা ভারতেই বেশি। আর সাত কোটি শিশু বাস করে পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষত চীনে। এ গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের ৯০ শতাংশ (২০০ কোটি) শিশু বাস করে এমন জায়গায়, যেখানে বাইরের বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি। যানবাহনের দূষণ, জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার, ধুলা এবং বর্জ্য পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া বাইরের দূষণের মূল কারণ। দক্ষিণ এশিয়ার ৬২ কোটি শিশু এমন পরিবেশে বাস করে। বিশ্বের অন্য অঞ্চলগুলোর তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাইরের বায়ু দূষণের হার অনেক বেশি। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ু দূষণের কারণে শিশুরা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ, তারা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের তুলনায় দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। এছাড়া শিশুদের ফুসফুসের কোষের স্তর দূষিত কণায় অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি ক্ষুদ্র দূষিত কণা মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহের ঝিল্লি ভেদ করে। এতে শিশুর বুদ্ধির বিকাশে স্থায়ী ক্ষতি সাধিত হয়। এমনকি দূষিত বায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ভ্রুণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৪ সালের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৯১টি দেশের ১ হাজার ৬০০টি শহরের মধ্যে দূষণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। সংস্থাটি এ জরিপ চালায় ঘরে ও বাইরের দূষণের ওপর। জরিপে বলা হয়, অতিদূষিত ২৫টি শহরের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের অবস্থান ১৭তম। গাজীপুর ২১ এবং ঢাকার অবস্থান ২৩তম। দিল্লি হচ্ছে সবচেয়ে দূষিত নগরী। ঢাকায়ও শব্দ দূষণ বাড়ছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন ছাড়াও দ্রুত নগরায়নের ফলে যত্রতত্র শোনা যায় ইট, বালু, সিমেন্ট মেশানোর মেশিনের গড় গড় বিরক্তিকর শব্দ। শিল্প-কারখানার যান্ত্রিক শব্দ ছাড়াও বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টার ও দোকানের উচ্চমাত্রার মিউজিক, মাইক, যানবাহন চলাচলের শব্দে প্রতিনিয়ত বাড়ছে শব্দ দূষণ। অভিযোগ রয়েছে, মোটর যান ও মেট্রোপলিটন অধ্যাদেশ ঠিক মতো মানা হচ্ছে না বলেই বেড়ে চলেছে শব্দ দূষণের মাত্রা। বিশেষ করে শব্দ দূষণ রোধে আইনের ধারাগুলো যেমন ‘বাংলাদেশ মোটরযান অধ্যাদেশ’ ১৯৯৭-তে বলা হয়েছে, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক এলাকাগুলোর ১০০ মিটারের মধ্যে গাড়ির হর্ন বাজানো নিষেধ। এ আইনগুলো যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না বলেই প্রতিনিয়ত বাড়ছে ওই শব্দ দূষণের মাত্রা। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়। রাজধানীতে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়ে শব্দের গড় মাত্রা দৈনিক ৭৬ ডেসিবেল, নাবিস্কো মোড়ে ৮১ ডেসিবেল, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকায় ৮২ ডেসিবেল, ফার্মগেট পুলিশবক্স এলাকায় ৮৫ ডেসিবেল, নিউমার্কেট বলাকা সিনেমা হল এলাকায় ৮২ ডেসিবেল, শাপলা চত্বরে ৮৫ ডেসিবেল, শ্যামলী সিনেমা হল এলাকায় ৮০ ডেসিবেল এবং বাংলামোটর মোড়ে ৯০ ডেসিবেল। ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বলা হয়, ৩০ থেকে ৬৫ ডেসিবেল শব্দ নার্ভাসনেস এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, ৬৫ ডেসিবেলের ওপরে শব্দ হূদরোগ, ৯০ ডেসিবেলের ওপরে শব্দ আলসার, শ্রবণে ব্যাঘাত, স্নায়ুতন্ত্রের পরিবর্তন এবং ১২০ ডেসিবলের বেশি শব্দে শ্রবণযন্ত্রে ব্যথা এবং স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তিহীন করতে পারে। এদিকে শব্দ দূষণ বিধিমালায় আবাসিক এলাকায় ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন বা মিক্সার মেশিনের ব্যবহার সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ‘ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গত বছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘শব্দ দূষণ : জনসচেতনা এবং করণীয়’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গাড়ির হর্ন এবং শব্দ দূষণের ফলে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকা শহরের ৩৩টি স্কুলের ১৩ থেকে ১৯ বছরের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, শব্দ দূষণের ফলে ছাত্রদের মধ্যে বিরক্তিবোধ, মাথাধরা এবং মনোসংযোগ সমস্যা সৃষ্টি হয়। এতে তাদের মধ্যে উত্তেজনা ও বিরক্তিবোধের মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সাধারণ জনগণের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনে তাদের মতামত তুলে ধরে বলা হয়, শব্দ দূষণে হার্টের সমস্যা, ঘুমের অসুবিধা, শিশুর মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হওয়ার মতো সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মোটর গাড়ির হর্ন, সংকেত কিংবা মাইকিং করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের তথ্য মতে, শব্দ দূষণ মানুষের স্নায়ুগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে কানের টিস্যুগুলো আস্তে আস্তে বিকল হয়ে পড়ে। তখন সব সময় এক ধরনের অস্বাভাবিক শব্দ হতে থাকে। ডাক্তারি ভাষায় এটাকে টিনিটাস বলে। কানের যন্ত্র নিয়েও সে ভালো শুনতে পারে না। শুধু যে কানের সমস্যা হয়, তা নয়। এটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে শিশুদের। হঠাত্ গাড়ির শব্দে তারা লাফিয়ে উঠছে এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তারা মানসিকভাবে ভীতু হয়ে পড়ছে। এতে করে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শব্দ দূষণের কারণে মনোসংযোগের বিঘ্ন ঘটে। যার কারণে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্রমাগত সব ধরনের উচ্চ শব্দই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। শব্দ দূষণ নীরব ঘাতক। অনেক বিলম্বে হলেও সরকার বিষয়টি বুঝতে পেরে সাড়া দিয়েছে। শব্দ দূষণ রোধ করতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন করতে হবে, বিভিন্ন সামাজিক-পরিবেশবাদী সংগঠন ও প্রচার মাধ্যমগুলোকে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। |