শিরোনাম: |
স্বপ্নবিলাসী মেগা বাজেট
বাস্তবায়নে সক্ষমতা দরকার
|
মোতাহার হোসেন : একটি সরকারের উন্নয়ন এবং জনকল্যাণে এবং সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ রোড ম্যাপই হচ্ছে বাজেট। অবশ্য জনমানুষের কল্যাণকামী রাষ্ট্র ও সরকারের বেলায় প্রযোজ্য। এটি মূলত: স্বপ্নবিলাসী মেগা বাজেট আখ্যা দিলে ভুল হবে না। কারণ একজন মানুষ, একটি পরিবার, একটি গৌষ্ঠী কিংবা একটি জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে- সবাই যাকে পরিকল্পনা বলে, আমি তাকে স্বপ্ন বলি। স্বপ্ন ছাড়া ভিশন-মিশন ছাড়া সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না। সেই বিবেচনায় স্বপ্নবিলাসী বাজেট আখ্যা দেয়া। অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোর বাজেট ঘোষণা এবং সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের খতিয়ানে অন্তত: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের জনকল্যাণমুখী উন্নয়ন ও অগ্রগতির খানিকটা চিত্র মেলে। এরই ধারবাহিকতায় এবারের বাজেটে এমন আশা করা যেতে পারে। তবে চূড়ান্ত বিচারের প্রস্তাবিত এই বাজেট সংসদে পাস হওয়ার পর বোঝা যাবে মূলত: এই বাজেট কতটুকু জনকল্যাণে কাজ করবে। ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত বাজেটের ব্যাংক আমানতের ওপর বিশেষ করে সর্বন্নিম ১ লাখ টাকা লেনদেন করলে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক কর্তন, শতকরা ১৫ ভাগ ভ্যাট নির্ধারণের প্রস্তাবসহ বেশ কিছু প্রস্তাবের ব্যাপারে সরকারের ভেতরে, সংসদে, সংসদের বাইরে, বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় বইছে।
অবশ্য, বাজেট ঘোষণার সময় এবং বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, জনকল্যাণ, দেশের সামগ্রীক উন্নয়ন, মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে উচ্চাভিলাষী বাজেট দেয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রুপান্তর করতে হলে উচ্চাভিলাষী বাজেট অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, এবারের বাজেট আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট। বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের দক্ষতা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক ভালো দাবি করে সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, গত আট বছরে বাজেটের আকার পাঁচগুণ বেড়েছে। ওই সময় বেড়েছে সরকারের আয়ও। যদিও অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর করা হলেও জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না। কারণ, অনেক পণ্যে ভ্যাট ছাড় দেয়া হয়েছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ভ্যাট বাড়লে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করবে না। এ প্রসঙ্গে মরমি কবি ও গবেষক ইবনে সালেহ মুনতাসির রচিত ‘সময় এখন বাংলাদেশের’ শীর্ষক লিরিকটি যৌক্তিক বলে প্রতিয়মান হয়েছে। ‘সময় এখন বাংলাদেশ/আরও এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন সামনে রেখে’ জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট/ উন্নয়নের মহাসড়কে দ্রতগতিতে/ধাবমান গর্বের বাংলাদেশ মেগাপ্রকল্পের ভিড়ে/ মধ্যম আয়ের দেশের নীড়ে যাবে শেষমেশ/কতো যে স্বপ্নের বাহারি কত যে উন্নয়নের রকমারি সুযোগ্য কাণ্ডারি/বানাচ্ছে কতো রেলপথ গড়ছে যতো রাজপথ চালু হচ্ছে কত আকাশ পথ/ফুটপাথের কতো বাহারি নকশা সবুজায়নের যতো ঝাপসা সুন্দর ব্যবসা/নিরাপত্তার বলয়ে ঢাকা উন্নয়নের চাদরে আঁকা প্রত্যাশিত জীবনঙ্খানে রাখা জলপথ স্থলপথ আকাশপথ আজ কম্পমান ব্যবসা বাণিজ্যে/জিডিপির আকার বাড়ছে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, হচ্ছে কর্মসংস্থান ভাসছে রেমিট্যান্স/দেশ আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আগাচ্ছে প্রতিকূলতা মাড়িয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে/সক্ষমতায় আজ পরম্পর দক্ষতায় আর সফলতায় ইবনে সালেহ মুনতাসির বলেন, সুশাসনের জন্য প্রয়োজন আজ গুণগত দীর্ঘস্থায়ী টেকসই উন্নয়ন/দীর্ঘমেয়াদি সুষ্ঠু পরিকল্পনা রাজনৈতিক অঙ্গিকার আজ বড় বেশি প্রয়োজন/আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞানার্জন আধুনিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন/স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা ন্যায়ের জন্য বিশেষ প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক আইন প্রণয়ন সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের বাজেট ঘোণার আগেপরে দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে, এটি ছিল ২০০৭ সালের আগের চিত্র। কিন্তু পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯৬ থেতে ২০০১, ২০০৮ থেকে ২০১৬ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে বাজেট ঘোষণার পর বাজারে এর কোনো নীতিবাচক প্রভাব পড়েনি। কিন্তু এবার দেশের হাওর অধ্যুষিত জেলাসমূহে পাকা ধান ঘরে তোলার ঠিক আগমুহূর্তে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার বাজারের এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। যদিও এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু তাতেও বাজার পরিস্থিতি বিশেষ করে চালের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী ভাব অব্যাহত থাকায় নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। এরি মধ্যে প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্কারোপ ও বিদ্যুত্ পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আশা করছি জনবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনগণের সুবিধা-অসুবিধাকে গুরুত্ব দিয়ে যৌক্তিক বিষয়গুলো সমাধানে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকবে। চালের দাম বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, হাওর এলাকায় অকাল বন্যার কারণে চালের দাম বেড়ে গেছে। তবে চালের মজুদ পর্যাপ্ত রয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তিনি বলেন, এবার সাতটি জেলার হাওর এলাকায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া আবহাওয়াজনিত কারণেও ধানের ফলন হয়নি। এসব কারণে সরকার ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানির চুক্তি করেছে। একই সঙ্গে ওএমএস কার্যক্রম চালু, ফেয়ার প্রাইসে ১০ কেজিতে চাল বিক্রিসহ সরকারি অন্যান্য কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। আবার আউশ ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে সরকার। আশা করছি, সরকারি এসব উদ্যোগের ফলে ভবিষ্যতে চালের দাম আর বাড়বে না। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা ও আলোচনার ঝড় ওঠে ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক ইস্যুতে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র আমানকারিরা এই প্রস্তাব কার্যকর হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার এর ফলে মাঝারি আমানতকারীরা তথা ১ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারিরা এতে যথেষ্ট লাভবান এবং উপকৃত হবেন। এই অর্থে যে, আগে সর্বনিন্ম ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকার আমানতকারীরা আবগারি শুল্ক দেবেন ৮০০ টাকা। এখ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা থাকলে আবগারি শুল্ক দিতে হবে না। এই বিষয়টি আলোচনায় আসছে না। বাজেট উত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাংকে যাদের এক লাখ টাকা রাখার সর্ঙ্গ্যে আছে তারা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্পদশালী বলেই বাজেটে তাদের ওপর বাড়তি কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে, বছরের যে কোনো সময় ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকার বেশি লেনদেনের ওপর আবগারি শুল্ক বিদ্যমান ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হয়েছে। নতুন বাজেটে আবগারি শুল্ক আরোপের সীমা ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ টাকা করা হয়েছে। বিদ্যমান বাজেটে ২০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনে বিদ্যমান ১৫০ টাকা আবগারি শুল্ক কর পরিশোধন করার বিধান ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে এখন সেটা আর দিতে হবে না। নতুন বাজেটে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন ১ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে হতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিদ্যমান ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা, ১০ লাখ টাকার ঊর্ধ্ব হতে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার ৫০০ টাকা, ১ কোটি টাকার ঊর্ধ্ব হতে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ৭ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ১২ হাজার টাকা এবং ৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে বিদ্যমান ১৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বেড়েছে বলে বাজেট বক্তব্যে উঠে এসেছে। দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশ বেসরকারি খাতে আর সেখানে সরকারের হাতে রয়েছে মাত্র ২০ ভাগ। তাই বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া উচিত। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে এই বাজেটে। মোট বাজেটের প্রায় ৫৪ শতাংশ ব্যয় হবে দারিদ্র্যবিমোচনে। তবে আশার কথা হচ্ছে দেশ রাজনীতির নামে আইন-শৃঙ্খলাভঙ্গের দিন শেষ হয়ে আসছে। জ্বালা-পোড়াও করে এদেশে আর কোন রাজনীতি হবে না। এই অপরাজনীতির দিন শেষ হওয়ায় দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করা হয় বাজেট বক্তব্যে। বিগত সাড়ে আট বছরে দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন সমান তালে এগিয়ে যাওয়ায় সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের জিডিপি গ্রোথ এক বিস্ময়। বাংলাদেশ হচ্ছে এশিয়ান টাইগার। বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের এ সাফল্য বড় করে প্রচার হয়। ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে। বিদেশিরা যেমন এদেশে বিনিয়োগ করতে আসছেন, আবার আমাদের এখান থেকে বিদেশেও বিনিয়োগ করা হচ্ছে। আফ্রিকা, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন। প্রত্যাশা থাকবে বাজেট পাস করার সময় প্রস্তাবিত বাজেটের যেসব প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, আপত্তি উঠেছে, সমালোচনা হচ্ছে সে সব বিষয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার সুবিবেচনায় নেবেন। একই সঙ্গে বাজেট ব্যবস্থাপনা, বাস্তবায়নে অধিকতর দক্ষতা, স্বচ্ছতা, যোগ্যতার সমন্বয় ঘটবে। তবেই উচ্চাভিলাষী বাজেট সত্যিকার অর্থেই জনকল্যাণে, দেশের সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক। |