শিরোনাম: |
অনন্য ও শ্রেষ্ঠতর মাস রমজান
|
এম. শামসুদদোহা তালুকদার : বরকতময় মাসদ্বয় রজব ও শাবানের পরই রমজানের সূচনা। চান্দ্র বছরের নবম মাস রমজান, ফজিলতের দিক দিয়ে সকল মাসের মধ্যে অনন্য ও শ্রেষ্ঠতর। বহু কারণে রমজান মাসটি মাহাত্ম্যপূর্ণ ও পবিত্রতর। সবচেয়ে বিখ্যাত এ জন্য যে, এ মাসেই সর্বপ্রথম কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, এ মাসের মাঝেই রয়েছে শবে কদর যা হাজার রাত্রির চেয়েও মহামূল্যবান। এছাড়া বান্দা সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার আর স্ত্রীর গভীর সহচর্য থেকে সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে নিজেকে সংযম করে। রমজানের প্রতিটি দিনই বরকত ও রহমতের। বান্দার গুনাহ মাফ ও সাওয়াব অর্জনের বষন্তকাল। রমজান মাসের সিয়াম সাধনাকে আল্লাহ ফরজ করেছেন। ইসলামের মৌলিক পাঁচটি ভিত্তির তৃতীয়টি সাওমকে ধরা হয়। সিয়াম-সাধনা শুধু আল্লাহর নির্দেশ পালন করাই নয় এর মধ্যে রয়েছে অফুরন্ত পার্থিব খাইরিয়্যাত বা কল্যাণ। আল্লাহ বলেছেন- ‘তোমাদের সাওম তোমাদের জন্য কল্যাণকর।’ (সূরা বাকারা: ৩৮৪)। সিয়াম সাধনার সঙ্গে ধর্মীয় সম্পৃক্ততা সৃষ্টির আদিকাল থেকেই ভিন্ন নামে ও ভিন্ন আঙ্গিকে উপবাস করার প্রচলন ছিল তখনকার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে যা এখনও তারা পালন করে যাচ্ছে। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (স.) পর্যন্ত নবী-রাসুলগণ সিয়াম পালন করেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিনদিন রোজা পালনের বিধান ছিল। ফরজ ঘোষিত হলে তা রহিত হয়ে পূর্ণ মাসে পরিবর্তিত হয়। (তাফসিরে শামী)। ইয়াহুদীরা আশুরার দিন উপবাস করত। একদিন পর পর রোজা পালনের বিধান ছিল হযরত দাউদ (আ.) এর জমানায়। প্রাচীর মিসরীয়, গ্রিক ও ফার্সি ধর্মেও সাওমের উল্লেখ আছে। সনাতন সংস্কৃতিতেও উপবাস পালন করার প্রথা চলে আসছে।
প্রচলিত সব ধরনের রোজা বা উপবাস প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিকর্তার মনোরঞ্জনের জন্য যথেষ্ট কিনা সেসব বিতর্কে না গিয়েই বলা যায়- চারিত্রিক মহত্ত্ব, নৈতিক পরিচ্ছন্নতা, চিন্তার বিশুদ্ধতা, আত্মিক পবিত্রতা সর্বোপরি আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে মাহে রমজানের ফরয রোজা সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। মহান আল্লাহর বাণী- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছে। যাতে তোমরা তাকওয়া হাসিল করতে সক্ষম হও।’ (বাকারা-১৮৩)। আখেরাতের পাথেয় উপার্জনের মৌসুম হিসেবে রমজান মাসটি বিশেষ মহার্ঘ্যের। ইবাদত ও তওবা কবুলের জন্য রমজান মাস একটি দারুণ উছিলা। আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন: যখন রমজান মাস আসে, তখন আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। এক রেওয়ায়েতে আছে- ‘জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং দোযখের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানদের শিকলবদ্ধ করা হয়।’ অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে- ‘রহমতের দরজা খুলে দেয়া হয়।’ (বুখারী ও মুসলিম)। পবিত্র রমজানে সিয়ামকারীর প্রতি অনেক করণীয় রয়েছে- যা পালনে মনোযোগী হতে হবে প্রত্যেককে। সালাতকে হেফাজত করতে হবে, বহু রোজাদার আছেন যারা সালাতকে অবহেলা করে। সালাত দ্বীনের প্রধান ভিত্তি, তা ত্যাগ করা কুফরিতুল্য। সিয়াম পালনকালে ফাসেকি কাজ কর্ম যেমন- মিথ্যাচার করা, ব্যবসায়ে দুর্বৃত্তায়ন করা, অন্যকে গালি দেয়া বা খারাপ ব্যবহার করা প্রভৃতি থেকে বিরত থাকা। এক কথায় মুখকে সংযত রাখা প্রকৃত রোজাদারের বৈশিষ্ট্য। কেউ সিয়ামকারীর সঙ্গে বাড়াবাড়ি বা খারাপ ব্যবহার করলে রাসুল (স.) এর পরামর্শ অনুযায়ী সিয়াম পালনকারী বলবেন যে, ‘আমি একজন রোজাদার।’ এভাবেই সিয়াম নফসকে সুসামঞ্জস্য করে তোলে। আর চরিত্রের খারাপ দিকটা দূরীভূত করে। এ বরকতময় মাসটিতে নিজের আত্মীয়স্বজন ও আত্মীয়দের দান-সাদ্কা করা বড়ই নেকির কাজ। বেশি বেশি আল্লাহর যিকির ও কুরআন তেলাওয়াত করা অন্যথায় তা শ্রবণে বহু ফায়দা। বিনোদনের মাধ্যম অর্থাত্ রেডিও, টিভি, কম্পিউটার প্রভূতিতে সময় ব্যয় না করে ইবাদতে মশগুল থাকতে হবে। এ মাসে ধূমপান ত্যাগে অগ্রণী হলে পরবর্তীতে ধূমপানের ফলে শারীরিক রোগ-বালাই থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। শুধু একটু দৃঢ়চেতা মনোবলই যথেষ্ট। এ মাসের রাত্রিগুলোত বেশি বেশি জাগরণ করা ঠিক নয়। ফলে সেহির খাওয়া ও ফজরের সালাত ছুটে যেতে পারে। সিয়াম পালনকারী নিজ সন্তানদের সিয়াম যখনই ফরজ হবে তখন থেকে তাদের নিয়ে সিয়াম সাধনায় অভ্যস্ত হতে হবে। রমজানে বিনা ওযরে সিয়াম ত্যাগ করার ব্যাপারে সন্তানদের সাবধান করতে হবে। সাবধান থাকতে হবে রোজা ভঙ্গের ক্ষেত্রে। আর কোনো ওযর বশত: এটা করলে অন্যের সামনে নয়। কারণ, সিয়াম ভঙ্গ করা আল্লাহর সামনে বাহাদুরি দেখানোরই সমতুল্য। ইসলামকে করা হয় হেয় ও তুচ্ছ। রাসুল (স.) এর বাণী- ‘যে ব্যক্তি শরিয়তি ওযর ছাড়া এ মাসে একটি রোজাও ছেড়ে দেবে, সে যদি এর বদলে সারা জীবনও সিয়াম পালন করে তবু তার পাপের খেসারত হবে না।’ (সহীহ বুখারী)। আর যে ব্যক্তি সিয়াম আদায় করল না তার কিন্তু ঈদও নেই। কারণ সিয়াম পূর্ণ করার পর ঈদ হলো আনন্দের দিবস। এটা সিয়াম পালনকারীর জন্য প্রযোজ্য আর এ দিনটা এবাদত কবুলের দিবসও বটে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিয়ামের মাসকে সুযোগ মনে করে বাড়তি ফায়দা হাসিলের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। বাড়তি মুনাফা, ওজনে কম দেয়া ও মজুদদারি করা ইসলামে জঘন্যতম অপরাধ বলে বিবেচিত। আর সিয়ামের মাসে এসব জঘন্য কাজে লিপ্ত থাকলে আল্লাহ ওইসব বান্দাকে নির্ঘাত অভিশাপ দিবেন আর যথোপযুক্ত শাস্তি দেবেন। অতএব কৃত্রিমভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লাভ করা থেকে জড়িতদের বিরত থাকতে হবে তাকওয়া হাসিলের লক্ষ্যে কারণ রোজার দ্বারা মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি এবং তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি হয়। সাওমকে প্রাণবন্ত করতে হলে জিহ্বার হেফাজতের পাশাপাশি চোখ, কান এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রতঙ্গাদিও সংযমি হতে হবে। হারাম জিনিস দেখা, শ্রবণ করা এবং হারাম কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এর ফলে রোজার প্রকৃত স্বাদ অনুভূত হবে। আর সিয়াম পালনের মাসে অবারিত খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল থাকলে রোজা বিশুদ্ধ হবে না। রিযক হালাল পন্থায় উপার্জিত হতে হবে। হারাম খেয়ে সিয়াম পালনের কোনো ফল বয়ে আনে না। রোজার কাঙ্ক্ষিত ফায়দা হাসিল করতে হলে, শরিয়ত পরিপন্থী কোনো কাজ করা যাবে না। সুতরাং মাহে রমজানের রহমত বিতরণের এ বসন্তকালে রোজাদার ব্যক্তিকে ইবাদত, তিলাওয়াত, যিকর ও তাসবীহে মগ্ন থেকে পরকালীন কল্যাণ কামিয়াবির পথ প্রশস্ত করার প্রতি মহান আল্লাহ ও প্রিয় নবী (স.) পবিত্র কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে সবাইকে তাগিদ দিয়েছেন। লেখক : ইসলামী গবেষক। |