শিরোনাম: |
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বিস্তৃতির উদ্যোগ প্রসঙ্গে
|
মোতাহার হোসেন : সরকার জনকল্যাণমুখী হলে দেশ জাতি উপকৃত হয়। বিশেষ করে সমাজে অবহেলিত, দরিদ্র, দুস্থ, পঙ্গু, বয়স্কসহ সব রকমের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ উপকৃত হয়। জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড চালু থাকলে অসহায় মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে অনেকটা সুবিধা হয়। আবার কারো কারো জীবনে বাঁচবার পথ প্রশস্ত হয়। মূলত একটি জনকল্যাণকামী সরকারের অন্যতম এজেন্ডা হওয়া উচিত এসব কর্মসূচি। এই গুরুত্ব বিবেচনায়, বর্তমান সরকার এসব কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে রাষ্ট্রকে একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র ও জনগণের বন্ধু সরকার হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সমাজে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য মেগা প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে দেশে মোট বাজেটের বিরাট অংশ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে। বর্তমানে তা আরও বিস্তৃত করার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার।
এখানে একটি কথা নীতি নির্ধারণী মহলের মনে রাখা রাখা উচিত, বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ৫৫ লাখ হতদরিদ্র পরিবারকে ১০ টাকা কেজি দরে বিতরণ, শহরাঞ্চলে ১৭ টাকা দামে আটা এবং ১৫ টাকা দরে চাল বিক্রি কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। চাল আর আটা দেয়া হচ্ছে, শহরের দিনমজুর, দরিদ্র ও বস্তিবাসীর জন্য। এসব কর্মসূচি যাতে শতভাগ সফল এবং প্রকৃতপক্ষে সমাজের বঞ্চিত, অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিতরা পান তার নিশ্চয়তা বিধান করা দরকার। কাজেই এ বিষয়টি গুরুত্বসহ দেখা উচিত। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সমাজের অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত, পঙ্গু, দুস্থ, প্রতিবন্ধী, অটিজম, বিকলাঙ্গ, বয়স্ক, স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবাসহ অসহায় গরিব মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রণয়ন করা হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র। এই কৌশলপত্র বাস্তবায়নে বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাত নামে একটি অংশ থাকছে। এ নিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের নীতি-দর্শনের প্রতিফলন হবে। সেই সঙ্গে তা বাস্তবায়নে বাজেটে মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, সুবিধাবঞ্চিতদের উন্নয়ন ও সুরক্ষা দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল বাস্তবায়নের কর্মসূচি তৈরি করেছে সরকার। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ থাকছে। এই কর্মসূচিকে গুরুত্ব দিয়ে নিরাপত্তা কৌশল বাস্তবায়ন করা হবে। এতে বয়স্ক, বিধবা, দুস্থ মহিলা, দরিদ্র মা, অসচ্ছল, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধা, হিজড়া জনগোষ্ঠী, বেদে সম্প্রদায় ও সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এ সুবিধা ভোগ করবেন। একই সঙ্গে ক্যানসার আক্রান্ত রোগী, কিডনি রোগী, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগী, স্ট্রোকজনিত প্যারালাইজড ও জন্মগত হূদরোগীরাও এ সুবিধা পাবেন। পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল একটি সূত্রের উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয়, ইতোমধ্যেই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা ও ভাতা নির্ধারণসংক্রান্ত কমিটি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করা হচ্ছে। ২০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে। এসব কর্মপরিকল্পনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর পর তা ওই বিভাগ সমন্বয় করে এসব পর্যালোচনা শেষে চূড়ান্ত কর্মকৌশল প্রণয়ন করবে এবং বাজেটে কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে সে সম্পর্কে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে কার্যপত্র জমা দেবে। তারপর তা প্রথমে সরকারের অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে। তারপর তা মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে। এর আগে তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা ও ভাতা নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে কমিটিগুলো কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তা-ও উল্লেখ রয়েছে। পদক্ষেপগুলো হলো- বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৩১ লাখ ৫০ হাজারে উন্নীত করা এবং ভাতার হার ১০০ টাকা বৃদ্ধি করে ৫০০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। বিধবা, স্বামী নিগৃহীতা, স্বামী পরিত্যক্তা, দুস্থ মহিলা ভাতার হার ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা এবং ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে ১১ লাখ ৫০ হাজারে উন্নীত করা হয়েছে। ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) কর্মসূচির উপকারভোগী দুস্থ মহিলার সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজার বাড়িয়ে ১০ লাখে উন্নীত করা হচ্ছে। মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ৯০ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ লাখে উন্নীত করা হবে। দেশের সব পৌরসভায় কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার (দুগ্ধ দানকারী মা) সহায়তা কর্মসূচি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১ লাখ ৮০ হাজার ৩০০ জন দরিদ্র মাকে ভাতার আওতায় আনা হবে। এছাড়া অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতার হার ৫০০ টাকা বাড়িয়ে ৬০০ টাকায় এবং ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার জনে উন্নীত করা হবে। আর নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের তহবিলে আরও ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমের অধীনে বিশেষ ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভাতা ৪০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা, চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ ১০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হবে। এছাড়া ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকজনিত প্যারালাইজড ও জন্মগত হূদরোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি বরাদ্দ ২০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ কোটি টাকায় উন্নীত করার সুপারিশ করা হবে। দেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে এবং জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নে ২০১৫ সালে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রণয়ন করে সরকার। এ কৌশলের মাধ্যমে সব যোগ্য বাংলাদেশির জন্য এমন একটি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে, যা দারিদ্র্য ও ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করবে। এছাড়া বৃহত্তর মানব উন্নয়ন কর্মের সুযোগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে জীবনচক্রভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪৫ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ৩১ শতাংশ। বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বর্তমানে ১৪২টি কর্মসূচি রয়েছে। ২৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র তৈরির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে কার্যপত্রে বলা হয়, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে নিরাপত্তা কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলোকে পাঁচটি বিষয়ভিত্তিক ক্লাস্টার (ভাগ) গঠন করা হবে। এ সম্পর্কে একটি রূপরেখা কার্যকর করতে ইতোমধ্যেই একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। এছাড়া ২৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তাদের এবং ২৬টি মন্ত্রণালয়ের ২৯৬ জন সরকারি কর্মকর্তাকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত কর্মসূচি প্রণয়নের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রত্যাশা জনবান্ধব, দরিদ্রবান্ধব সরকারের মহতী এসব কর্মসূচির শতভাগ বাস্তবায়নে দরকার সংশ্লিষ্ট মহলের আন্তরিকতা। তবেই দেশ, জনগণ উপকৃত হবে, উপকৃত হবে দেশের অবহেলিত, দরিদ্র জনগোষ্ঠী। লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক। |