শিরোনাম: |
স্মৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
|
সিরাজুল ইসলাম খান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে আমি যে সময়টাতে ভর্তি হয়েছিলাম তখন দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই টালমাটাল। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে টিএসসি চত্বর, মধুর কেন্টিন, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ, কলাভবন চত্বর এলাকার পাশাপাশি কার্জন হল, সাইন্স এনেক্স এবং বিভিন্ন হল প্রাঙ্গণ তখন সবসময়ই রাজনৈতিক স্লোগান, মিছিল-মিটিং আর পুলিশের গুলি, রাবার বুলেট আর টিয়ার গ্যাস শেলের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ইট পাটকেলের অ্যাকশনে আমার মত নবীন, ভীতু ছাত্র এবং গ্রাম থেকে আসা অনভ্যস্ত হাবাগোবার মনে আতঙ্ক তৈরি করত। ঢাকায় কোনো আত্মীয় পরিজন না থাকায় আমার কলেজে অধ্যয়নকালীন বড় দুই ভাই মিহির দা আর রিপন দা’র আশ্রয়ে তাদের কাছে সাময়িকভাবে থাকার সুযোগ পাই জগন্নাথ হলের পূর্ব হাউসের ৩০৮নং কক্ষে। যদিও আমি ফজলুল হক হলের এটাস্ট ছাত্র ছিলাম। কিছুদিন পরই (নভেম্বর, ১৯৮৯) ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙা ইস্যুতে দেশের কয়েকটি স্থানে মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা এবং তেপ্রক্ষিতে সাম্প্রদায়িক কিছু সংঘর্ষের ঘটনার সংবাদ জগন্নাথ হলে আসতে থাকলে হলের আবাসিক ছাত্ররা গগনবিদারী স্লোগান দিয়ে রাস্তায় এসে গাড়ি ভাঙচুর শুরু করে। হলের ভেতরে লাইট পোস্ট ভেঙে ফেলে এবং ফাঁকা গুলি, ককটেল, বোমা ফাটিয়ে এক ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা হয় সে রাতে। এর মধ্যে প্রায় তিন মাস ধরে একজন মুসলমান ছাত্র হয়ে জগন্নাথ হলে থাকা এই আমার অবস্থান করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
অবস্থা তখন এতটাই খারাপের দিকে চলে যায় যে আমি হল থেকে বেরও হতে পারছিলাম না। কারণ, এরই মধ্যে অনেকের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠায় এ রকম একটা উত্তপ্ত পরিবেশে বিশেষ করে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের বিষয় জড়িত থাকায় আমি খুব ভীত হয়ে পড়ি। তবে, মিহির দা ও রিপন দা- দুইভাই লাইটের সুইচ অফ করে ৩০৮নং কক্ষে আমাকে তালাবদ্ধ রেখে রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ তারাও মিছিল-স্লোগান আর ককটেল বর্ষণের কর্মসূচিতে চলে যান যেন কেউ বুঝতে না পারে যে আমি ভিতরে অবস্থান করছি। মুহুর্মুহু স্লোগান, মিছিল, ককটেল-ইটপাটকেল আর বোমাবাজি-গাড়ি ভাঙচুরের শব্দ এবং সারা হলজুড়ে ভুতুড়ে অন্ধকার পরিবেশের কারণে হাবাগোবা আমার সে রাতটা যে কি আতঙ্কে কেটেছে তা বর্ণনা করতে আমি পারব না। ভোর ৪টারও বেশ খানিকক্ষণ পরে মিহির দা কক্ষের অন্যদেরসহ ফিরে এসে আমার অবস্থা দেখে শুধু বললেন ‘নিরাপত্তার স্বার্থেই তোমার এ হল থেকে চলে যাওয়া উচিত এবং সেটা আজই’। তাদের পরামর্শে অনেক কষ্টে হলের এক কর্নার দিয়ে অত্যন্ত গোপনে আমার একমাত্র সম্বল কালো ব্যাগটিসহ দেয়াল টপকে সকাল ১০টা নাগাদ লুকিয়ে ৯০ দিন বসবাসের স্মৃতিসহ জগন্নাথ হল থেকে বের হয়ে আসি। বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা পেরিয়ে আমার সহপাঠী হাবিব যার অবস্থা আমারই মতো- দুজনে কয়েকদিন মসজিদ, গাছের নিচে আর রাস্তায় ঘুরাঘুরি করে একরকম বিরক্ত হয়ে বিকল্প কি করা যেতে পারে তাই যখন ভাবছি তখন জানতে পারলাম ফজলুল হক হলের বর্ধিত ভবনের ৪০০৬ এবং ৪০০৩নং কক্ষে সাময়িকভাবে দুটো সিট ফাঁকা আছে। আমরা পুটলা-পুটলি নিয়ে সেখানে অন্য সিটগুলোতে যারা সত্যিকারের আবাসিক বড়ভাই থাকেন তাদের অনেকটা ধোঁকা দিয়ে দুজন দুই সিটে উঠে পড়ি। বলে রাখা দরকার হাবিব ছিল শহীদুল্লাহ হলের এটাস্ট ছাত্র। আমরা তিন-চারদিন থাকতে পারলেও সমস্যার সমাধান হয়নি কারণ আর দু’দিন পরই সিট দুটির সত্যিকার মালিক বড় ভাইয়েরা চলে আসবেন এবং তখন আমরা ধরা পড়ে যাব। ইতোমধ্যেই তারা তাবলিগ থেকে ফিরে আসার সংবাদ এলে আমি আর হাবিব আগেভাগেই ওখান থেকে কেটে পড়ি এবং আবার রাস্তায় ঘুরাঘুরি শুরু করি। হাঁটাহাঁটি আর ঘুরাঘুরির এক পর্যায়ে ফজলুল হক হলের মূল ভবনের পশ্চিম ব্লকের ১০২নং কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে কক্ষের বড়ভাই কী চাই জিজ্ঞাসা করলে আমার নাম পরিচয় দিয়ে নিজের থাকার সমস্যার কথা বলি। ভাগ্যগুণে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সেই নূরু ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হবার সুবাদে তিনি আপাতত তিন-চারদিন তার দুই সিটবিশিষ্ট কক্ষের একটি সিটে থাকার সুযোগ করে দেন। সিটটি যার নামে বরাদ্দ সে সোবহান ভাই বাড়িতে গেছেন বলে আপাতত এটি ফাঁকা আছে। তিন চারদিন পর হঠাত্ এক বিকেলবেলা সোবহান ভাই রুমে এসে আমি যে চেয়ারে বসেছি সেখানেই কাছাকাছি দাঁড়ালেন। তখন নূরু ভাই রুমে ছিলেন না বলে আমার খুব ভয় হচ্ছিল। তবে তিনি নিজেও যে খুব হতচকিত হয়েছেন এটা বুঝতে বাকি রইল না আমার এবং আমি তত্ক্ষনাতই সালাম ও নিজের পরিচয় দিয়ে কীভাবে কেমন করে এ রুমে আমি ঢুকলাম এবং আছি তাই তাকে বললাম। নূরু ভাইয়ের সম্মানার্থে এবং আল্লাহর অপার মহিমায় তিনি বললেন, উঠেই যখন পড়েছ, তাহলে তুমিই থাকো। আমি বাসায় যাব, আর মাঝে মধ্যে আসব যাতে কর্তৃপক্ষ সিট বরাদ্দটা বাতিল করে না দেয়। তারপর জানতে পারলাম পাশের ১০৩নং রুমটাই হাউস টিউটরের কক্ষ। বিপদটা এখানেই বুঝতে পেরে আমার দুর্গতির বৃত্তান্ত দিয়ে পড়ালেখার স্বার্থে আমাকে একটা সিট বরাদ্দ দেয়ার দরখাস্ত লিখে হাউস টিউটরের কাছে দিতে গেলে বললেন, তোমার সাহস তো কম না? আমার অফিসের পাশের রুমেই না বলে না কয়ে তুমি থাকছ? অনেক বলেও আমি তাকে ম্যানেজ করতে পারিনি এবং তিন দিনের মধ্যে রুম থেকে বের হয়ে মেসে চলে যেতে বললেন। মেসে থেকে খরচ মিটানোর সামর্থ্য আমার নেই বলার পর জামায়াত সমর্থিত অধ্যাপক ফজলুল হক স্যার বললেন, টাকা নেই তো পড়ালেখার দরকার কী? এরই মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে এক সপ্তাহ পার করে দিয়েছি আমি। হঠাত্ এক দুপুরে আবার সোবহান ভাই এলে তাকে একটা দ্বৈত পারমিশন দিতে অনুরোধ করলাম। তিনি দিবেন বললেও সেটা আর হয়নি। এরই মধ্যে একদিন রাত ১১টা নাগাদ সহকারী হাউস টিউটর আনোয়ার স্যার- শুনেছিলাম তিনি নাকি কর্নেল তাহেরের ভাই এবং চেহারা দেখেও তাই মনে হয়েছে- আমাকে রুমের ভেতরে পেয়ে আমার নামে সিট বরাদ্দ না থাকলেও কীভাবে আছি জানতে চান। আমি কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি বিধায় খুব কর্কশ কণ্ঠে বললেন, শার্ট-প্যান্ট পরো, বই খাতা আর ব্যাগ নাও, বের হও এবং তালা মারো, আর চাবিটা আমার কাছে দাও। আমি ভয়ে কম্পমান এবং শুধু বললাম যে নূরু ভাই আছেন, হয়তো অন্য কোনো রুমে গেছেন। আর সোবহান ভাই আমাকে একটা দ্বৈত পারমিশন দেবেন বলে তাকে আমি রাজি করিয়েছি, তবে তার জন্য দু’দিন সময় লাগবে। আনোয়ার স্যার দু’দিনের সময় দিয়ে চলে গেলেন। একদিন আমি ঘুমালাম পশ্চিম ব্লকের একটা রুমে আর সকাল বেলা উঠে দেখি আমি পূর্ব ব্লকের একটি রুমের ভিতর থেকে বের হচ্ছি। খোঁজ নিয়ে জানলাম যে, নেতা-পাতি নেতারা নাকি ৮/৯ জন আমি যে রুমে থাকতাম সে রুমে একত্র হয়ে উচ্চৈঃশব্দের গান বাজিয়ে রাতভর আনন্দ ফুর্তি করেছে। তাদের ফুর্তি করার সুবিধার্থে ঘুমের মধ্যেই দুজন মিলে আমাকে পশ্চিম ব্লকের রুম থেকে পূর্ব ব্লকে তাদেরই একজনের রুমে পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসে। ক্লান্ত-শ্রান্ত আমি সেটা টেরও পাইনি। বেশ ক’দিন পর আমার সাময়িক থাকার কক্ষ নং ১০২ থেকে নূরু ভাই আর সোবহান ভাই বরাদ্দ বদল করে অন্য একটা ভালো রুমে চলে যান। প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এবং হল সংসদের লুত্ফুল কবির রিপন ভাই আর পদার্থ বিজ্ঞানের আবদুল্লাহ ভাই নতুন বরাদ্দ পেয়ে এ রুমে আসলেন। রিপন ভাই ছাত্র রাজনীতি করেন এবং নিজেদের মধ্যে অনেক গ্রুপিং আছে বলে রুমে নিয়মিত থাকেন না। ফলে আমার থাকার কিছু সুযোগ থেকেই যায় এবং আমার নিজের স্বার্থে তার সঙ্গে বেশ ভালো খাতির জমাই, তার ফুট-ফরমাশও কিছু শুনি। তবে কখনই কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে, তাদের মিছিলে বা অন্য কোন কর্মসূচিতে আমি যাইনি। আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগালো যখন দেখলাম, হলের গেটে পাহারাদারদের মতো করে বসে থাকা পাতিনেতারা পকেট থেকে অস্ত্র বের করে ফাঁকা গুলি করে আবার নিজেরাই স্লোগান ধরে ক্যাম্পাসে গুলি কেন খুনি এরশাদ জবাব দে। দুই বছর ভাসমান থাকার পর চরম অনিশ্চয়তা কাটিয়ে অবশেষে নিজের নামে একটা সিট বরাদ্দ পেলাম ফজলুল হক হলের বর্ধিত ভবনের চার সিটবিশিষ্ট ৪০১০নং কক্ষে। তো সেখানে একবার একটা সিট সাময়িক ফাঁকা হলে নতুন একজনের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়। সংশ্লিস্ট হাউস টিউটর গণিতের অধ্যাপক মোবারক স্যার জাকির নামের অত্যন্ত ছোটখাট একটি ছেলেকে খুব সকালবেলা আমাদের রুমে নিয়ে এসে আমাকে বললেন, এ তোমার বিভাগের এক ছোট ভাই। ফজরের আজানের সময় সে প্রভোস্ট স্যারের বাংলোর গার্ডদের ফাঁকি দিয়ে বাংলোর ভিতরে ঢুকে বারান্দায় ঘটি বাটি সব ফেলে রেখে সিটের জন্য বসেছিল। উপায় না দেখে প্রভোস্ট স্যার তাকে সরিয়ে আপাতত কারও সঙ্গে ডাবলিং করে দিতে বলেছেন। পরে জাকিরের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম সে একটা মেসে থাকত। ওখানে অন্য মেস মেম্বারদের বাড়ি সিলেট এলাকায় এবং তারা সবাই মোটামুটি ধনী পরিবারের সন্তান। সকালে নাস্তার সময় একেকজনের চার-পাঁচটা করে ডিম না হলে নাস্তা হয় না। দুপুর এবং রাতে গরুর গোস্ত, মুরগির মাংস কিংবা মাঝে মাঝে খাসির রেজালা না হলে তারা ভাত খেতে পারে না। ফলে মাস শেষে শুধু খাবার ও নাস্তা বাবদ জনপ্রতি বিল আসে চার-পাঁচ হাজার টাকা। এর বাইরে সিট ভাড়া, বুয়ার বেতন, বিদ্যুত্, পানি ও গ্যাস বিলের অংশ এবং ব্যক্তিগত অন্যান্য খরচতো আছেই। সব মিলিয়ে সেখানে জাকিরের পক্ষে কুলানো সম্ভব হচ্ছিল না বলেই উপায় না দেখে তার এমন নাটকীয় কাণ্ড। কিন্তু ১৫-১৬ দিন পরে সেই মোবারক স্যারই এক সকালে এসে জাকিরকে দেখে বললেন, কি ব্যাপার তুমি এখনও এখানে আছ? তুমি তো এতদিন ধরে এখানে অবৈধভাবে থাকার কথা না? জাকির বলল যে, সে একটা সিটের জন্য আবেদন করলেও তাকে দেয়া হচ্ছে না বলে যেতে পারছে না। মোবারক স্যার তাকে শাসিয়ে বললেন যে এসব তিনি আর শুনতে চান না এবং জাকিরকে সিট ছেড়ে চলে যেতে হবে। জাকির প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তেজিত হয়ে মোবারক স্যারকে বলল, এটা স্বাধীন বাংলাদেশ, এখানে দুর্নীতি চলবে না। মোবারক স্যার এবং আমি জাকিরের এমন আচরণে অবাক হয়ে যাই। তবে পরক্ষণেই মোবারক স্যার তার চেহারা পাল্টে ধমক দিয়ে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম একটি এলাকায় মুজিব বাহিনীর কমান্ডার। তখনই যুদ্ধের ময়দানে কুকুরের মতো মরে যেতে পারতাম। দেশ স্বাধীন আমরাই করেছি। এখন আমি দেখতে চাই তুমি কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়। আমি আজই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তোমার ভর্তি বাতিলের ব্যবস্থা করব। মোবারক স্যারের হুঙ্কারে ভয় পেয়ে জাকির আস্তে আস্তে তার বই, খাতা আর কাপড়-চোপড় নামাতে শুরু করে। যখন আমি সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তখন ফজলুল হক হলের মূল ভবনের পশ্চিম ব্লকের ২১৪নং কক্ষে থাকি। গান শোনার প্রচণ্ড শখ ছিল বলে আমি বিভিন্ন জায়গায় গান শুনতে যেতাম। তবে বাংলা একাডেমির বইমেলা উপলক্ষে তখনকার সময়ে সন্ধ্যাবেলার অনুষ্ঠানগুলো এবং পহেলা বৈশাখের বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখতে যাবার নেশা অন্যগুলোর চেয়ে একটু বেশি ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও আমি ছোটবেলা থেকেই মোটামুটি বেশ ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে এবং একটু-আধটু গান গাইতে পারতাম বলে আমার সহপাঠী এবং অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুমনের হারমোনিয়াম এনে নিজেই ওটা বাজিয়ে মাঝে মাঝে গান গাইতাম। এ রকমই একবার এক পহেলা বৈশাখে সকালে হলের কক্ষ থেকে বৈশাখী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাবার আগে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানটি গাইতে শুরু করতেই আমার বন্ধু এবং সহপাঠী ইমরান শাহরিয়ার এসে হাজির। এত সকালবেলায় তেজগাঁ পলিটেকনিকের টিচার্স কোয়ার্টার থেকে আমার রুমে তার হাজির হয়ে যাওয়াটা আমার কোনো হিসাবে মিলছিল না। তবে যখন রুম থেকে বের হবার জন্য রেডি হলাম তখন সে আমাকে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল যে, আগামীকাল থেকে ফার্মগেটে সোমাদের বাসায় আর পড়াতে যেতে হবে না। সে আরও বলল, এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখ হলেও খামের মধ্যে টিউশানির পুরো মাসের টাকা দিয়েছেন সোমার আম্মু। টিউশনটা আমাকে ইমরানই দিয়েছিল এবং আমি সে বাসায় সোমার ফুফাতো বোন কলিকে পড়াতাম। এর আগে সোমাকেও কয়েক বছর পড়িয়েছি। পহেলা বৈশাখে সকালবেলা ইমরানের বৈশাখী উপহারটা আমার দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছিল এ জন্য যে টিউশননির্ভর এই আমি তখন অন্য কোথাও পড়াতাম না। তবে এ রকম একটা ঘটনা আমি কিছুটা আঁচ করতে পারছিলাম এ কারণে যে সোমার আম্মু সপ্তাহখানেক আগেই আমাকে বিয়ের একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন যেটাতে আমি রাজি হইনি। কারণ আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় আমি তখনও এ রকম কিছু একটা করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। আমি যখন প্রথম বর্ষে পড়ি তখন একবার শীতের সময় বিকেলে আসরের নামাজের পর সহপাঠী হাবিব আর ভূগোল হিভাগের বন্ধু লতিফ একসঙ্গে বের হলাম বাইতুল মোকাররম যাব বলে। ফুটপাত থেকে আমরা তিনজনই তিনটা সুয়েটার কিনে মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে জিপিও পার হলাম এবং আবদুল গণি রোড ধরে হেঁটে হেঁটে হলে ফিরে আসতে গিয়ে দেখি ওসমানী মিলনায়তনের সামনে বিরাট বিরাট ব্যানার লাগানো যে পণ্ডিত রবি শঙ্কর সেতার বাজাবেন। অনেক সাজগোজও ছিল যা চোখে পড়ার মতো। বাইরে গেটের সামনে স্যুট-টাই পরা বড় কর্মকর্তারা দাঁড়িয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করছেন। আমরা তিনজন গেটের সামনে কর্তাদের শুনিয়ে নিজেরা নিজেদেরকেই বললাম যে, এ রকম অনুষ্ঠানে আমরা কেন ঢুকতে পারি না? একজন ভদ্রলোক আমাদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা জানো যে এখানে কি হবে?’ আমরা বললাম লেখাই তো আছে পণ্ডিত রবি শংকর সেতার বাজাবেন! তিনি জানতে চাইলেন, পণ্ডিত রবি শংকরকে চিনি-জানি কি না। প্রশ্নটা আমার কমন পড়ে যাওয়ায় আমি বললাম যে হ্যাঁ! রবি শংকর একজন বিশ্ববিখ্যাত সেতার বাদক। শুধু তাই নয়, তিনি ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর মেয়ের জামাই। ভদ্রলোক আবার প্রশ্ন করলেন ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর মেয়ের নাম কি। এবারও প্রশ্ন কমন এবং খুবই সহজ জবাব দিলাম যে তার নাম অন্নপূর্ণা দেবী। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাদের হাতের প্যাকেট খুলে সুয়েটার গায়ে দিয়ে গেটের ভেতরে আসতে বললেন। পরে তিনি সংশ্লিস্টদের সঙ্গে আলাপ করে আমরা তিনজনকে মিলনায়তনের ভিতরে নিয়ে গ্যালারির মাঝখানে এক জায়গায় বসিয়ে দিলেন। তখনকার সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ দিদার বখত অনুষ্ঠানস্থলে আসার পরই সুন্দর চেহারার রবি শংকর মঞ্চে আসেন। সেদিন তিনি রাগ ইমন কল্যাণসহ কয়েকটি রাগে সেতার বাজান। অপূর্ব সেই সেতার বাদনের রেশ নিয়ে আমরা তিন বন্ধু সেদিন রাতে হলে ফেরার সময় অনুষ্ঠানটি দেখতে পারার আশ্চর্যরকম সুযোগ লাভের হিসাব মিলাতে পারিনি। টিউশানির টাকায় চলতাম বলে মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে ডাইনিংয়ের মাসিক বিল আগাম জমা দিতে প্রায়ই একটা ঝামেলা হতো। কারণ যে বাসায় পড়াতাম সে বাসার কর্তার তাদের বাসার মাসিক লাখ টাকা খরচের সমস্যা না থাকলেও প্রাইভেট টিচারের বেতন দিতে খামোখাই কেন জানি গড়িমসি করতেন। মাস শেষ হলে দুই, তিন কিংবা চার তারিখের মধ্যে টাকা না পেলে মনটা খারাপ হয়ে যেত এ জন্য যে পাঁচ তারিখে ডাইনিংয়ের টাকা জমা দেব কীভাবে সেটা একটা দুশ্চিন্তার বিষয়। বাড়ি থেকে কোনো টাকা পয়সা আনতে পারতাম না বলে হাতে বাড়তি টাকাও থাকতো না। এমনি অবস্থায় একবার টিউশনির টাকা না পেয়ে ডাইনিংয়ের টাকা জমা করতে না পারায় আমার খাবার বন্ধ করে দেয়া হলো। কারো কাছ থেকে টাকা ধার করতে মন চাইল না বিধায় ক্লাস থেকে দুপুরে রুমে ফিরে কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। তবে পেটের ক্ষুধায় ঘুমের খবর হয় না। বেশ কতক্ষণ পর হঠাত্ করে রসায়ন বিভাগের ফখরুদ্দিন ভাই আমার রুমে ঢুকে বললেন, ‘কী ব্যাপার, আজকে তোমাকে জোহরের নামাজে দেখলাম না যে?’ আমি শরীরটা ভালো নয় বলে আসল বিষয় চেপে গেলাম। কিছু সময় আমার সঙ্গে কথা বলে পকেট থেকে বের করে আমাকে ৫০ টাকা দিয়ে বললেন, ‘অনেক দিন হয়ে গেল তোমার কাছ থেকে এটা ধার নিয়েছিলাম। সেটা আর ফেরত দেয়া হয়নি। আজকে মনে পড়ল তাই দিয়ে গেলাম। আমি শেষ বেলায় জোহরের নামাজ পড়ে ৫০ টাকা পকেটে নিয়ে খেতে গেলাম আর মনে মনে ভাবলাম, আল্লাহই রিজেকের মালিক।’ আমি একজন নিরীহ ছাত্র হওয়ায় ছাত্রদল অধ্যুষিত এ হলের নেতারা প্রায়ই আমার কাছে তাদের অস্ত্র রাখতেন। নিরুপায় হয়ে এবং তাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কিছুই করতে পারবে না বিধায় এটাকে নিয়তি মেনেই আমি বিভিন্ন সময়ে আমার কাছে অস্ত্র জিম্মা রেখেছি। একবার আমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই যিনি ডাকসুর বিজ্ঞান মিলনায়তন সম্পাদক ছিলেন সেই খালেক ভাই রাত সাড়ে এপারটা নাগাদ আমার রুমে এসে তার একটা অস্ত্র দিয়ে বললেন, এটা তোমার কাছে রেখে দিও, আমি সকালে এসে নিয়ে যাব। রুম থেকে বের হয়ে কিছুদূর গিয়ে তিনি আবার ফিরে এসে বললেন, আজকে একটু সতর্ক থাকো, কারণ রাতে পুলিশ রেইড করতে আসতে পারে। তিনি এ কথা বলে দ্রুতই কেটে পড়লেন। আমি তো ভয়ে অস্থির এবং কী করতে হবে তাও বুঝতে পারছিলাম না। অনেকক্ষণ একা একা বসে দুশ্চিন্তা করেছি এ জন্য যে আমার রুমমেটও দেশের বাড়িতে গেছে, আমি যে কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে ভাবলাম, আমি তো এসব করি না, তাহলে এ ধরনের ঝামেলা আমার কাছে আসবে কেন? এ রকম একটা বোকামির জন্য আমি চিস্তায় পড়লাম। বাঁচার চেষ্টা করি। আমার খাটে দুইটা তোষক আর চারটা বালিশ ছিল- একটা তোষক আর দুইটা বালিশ আমার নিজের। অন্যগুলো এক সিনিয়র ভাই আমাকে দিয়েছিলেন। রাত প্রায় ২টার দিকে হুড়মুড় করে তালা ভেঙে ৪০-৫০ জন পুলিশ হলগেটের ভিতর ঢুকে পড়ল। বাইরে আরও অনেক পুলিশ এবং একই সময়ে নাকি শহীদউল্লাহ হলেও রেইড শুরু হয়েছে। আমার সারা গায়ে কম্পন শুরু হলো আর গলা ও জিভের পানি শুকিয়ে গিয়ে শরীর কাঁপতে থাকল। চার-পাঁচজন পুলিশ আমার রুমে ঢুকে হাতে থাকা লাঠি আর রড দিয়ে এখানে ওখানে গুতাতে থাকে। একজন আমার ট্রাঙ্ক ও লকারের তালা খুলতে বলল। আরেকজন লাঠি দিয়ে তোষক পায়ের দিক থেক উল্টিয়ে মাথার দিকে ফেলল। আমি ভয়ে কাঁপতে থাকায় চাবি দিয়ে তালা খুলতে দেরি হচ্ছিল। ফলে পুলিশ রড দিয়ে তালা ভেঙে ফেলে। লকার এবং ট্রাঙ্কে আমার বই, খাতা, কাপড় এবং এ ধরনের ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র ছাড়া আর কিছুই পায়নি পুলিশ। অন্যদিকে তোষক উল্টে দেয়াতে অস্ত্রটা আরও ভালোমতো ঢেকে গেল। তারা কিছুক্ষণ গুতোগুতি করে এ রুমে কিছু নেই বলে মন্তব্য করে বের হয়ে গেল। ভোর ৪টায় যখন রেইড শেষ হলো তখন আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সকাল ৭টার দিকে খালেক ভাই এসে আমাকে বলল, কী ছোট ভাই, কেমন আছ? কোনো সমস্যা হয়নি তো? আমি শুধু বললাম, আপনার জিনিসটা নিয়ে যান, আর আমার সঙ্গে কোনো দিন এ জাতীয় কাজ করবেন না। আজও চিস্তা করি, কি বাঁচাটাই না সে দিন আমি বাঁচলাম। কারণ, বইটা (পিস্তল) পেলে পুলিশ আমাকেই ধরে নিয়ে যেত, আর আমি তখন জেলে থাকতাম। আর আমাকে ছাড়িয়ে আনতে তো নেতারা কেউ যেতেন না। এ রকম কত ঘটনারই স্মৃতিচারণ করা যাবে। যার জন্য হয়তো পাতার পর পাতা লিখতে হবে। আজ আর কোনো ঘটনা না লিখে ভবিষ্যতে কোনো এক সুযোগে লেখার প্রত্যাশায় এ পর্বের ইতি টানলাম। |