শিরোনাম: |
স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল মুজিবনগর সরকার দিবস
|
বাহালুল মজনুন চুন্নূ : পঁচিশে মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদাররা শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে রক্তের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে যে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর গণহত্যা শুরু করেছিল, মৃত্যু-ধ্বংস-আগুন-আর্তনাদের বীভত্স খেলায় মত্ত হয়ে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তার থেকে কেবল পরিত্রাণই নয়, স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মুজিবনগর সরকারের অবদান অনস্বীকার্য। এই সরকার যে দিনটিতে শপথ গ্রহণের মাধ্যেমে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছিল, সেই দিনটিতেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য আনুষ্ঠানিকভাবে উদিত হয়েছিল। এজন্য এই দিবসের মাহাত্ম্য বাঙালি জাতির জীবনে অনির্বাণ শিখার মতো সবর্দা বহমান থাকবে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পঁচিশে মার্চে গ্রেফতারের আগে যেমন ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করে রেখেছিলেন, তেমনি একটি সরকার গঠনের পরিকল্পনাও করেছিলেন। তার সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই পরবর্তীতে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল যা মুক্তিযুদ্ধকে সাংগঠনিক কাঠামোতে রূপদানের মাধ্যেমে বিজয় অর্জনের পথকে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ত্বরান্বিত করেছিল। এই সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ, ইচ্ছা বুকে ধারণই নয়, তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে। তাদের দক্ষ নেতৃত্বগুণেই মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ থেকে ‘জয় বাংলা, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ রণধ্বনি কণ্ঠে তুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন হানাদার বধে আর ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়ের সেই লাল সবুজ পতাকা।
আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে গিয়ে বুঝেছিলেন প্রতিষ্ঠিত কোনো সরকার ব্যতীত আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে দেশের জন্য কেবল সহানুভূতি ও সমবেদনাই তিনি পেতে পারেন। অস্থায়ী সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। কিছু বিরোধিতার মুখোমুখি হলেও তিনি সকল বাধা অতিক্রম করে দশ এপ্রিল ঘোষণা করেন অস্থায়ী সরকার। সেই ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ- রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন। এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। এই সরকারের মূল ভিত্তি ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন যেখানে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল এবং এই নির্বাচনকে ভিত্তি ধরার মধ্যে দিয়ে এই অস্থায়ী সরকার গণতান্ত্রিক রূপ লাভ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নািসবাহিনী ফ্রান্স দখল করে নিলে জেনারেল দ্য গলে লন্ডনে যেভাবে ফ্রান্সের প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন, অনেকটা সেভাবেই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার আদর্শের উত্তরসূরিরা কলকাতার আট নম্বর থিয়েটার রোডে স্বাধীন বাংলাদেশের এই অস্থায়ী সরকার গঠন করেছিলেন। এই সরকারের সঙ্গে কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরোদম সিহানুকের গঠিত সরকারের তুলনা করা যায় যার সদর দফতর দীর্ঘকাল চীনের বেইজিংয়ে ছিল এমনকি কোনো কোনো সময়ে থাইল্যান্ডেও ছিল। অথবা জাপান সাম্রাজ্যের বিপক্ষে গঠিত সাংহাইতে পরিচালিত কোরিয়ার অস্থায়ী সরকার, কিনশাসা থেকে পরিচালিত অ্যাঙ্গোলার রিপাবলিকান সরকার, প্যারিস থেকে পরিচালিত পোল্যান্ডের নির্বাসিত সরকারের সঙ্গেও মুজিবনগর সরকারকে তুলনা করা যায়। সে যা হোক, সময়ের প্রয়োজনে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে অস্থায়ী সরকার গঠিত হওয়ার পর প্রথাগতভাবেই শপথ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছিল। এজন্য চৌদ্দ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করে সেখানে সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদ ঘোষণার ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের গোপন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু খবরটি যে কোনোভাবে হোক পৌঁছে গিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে। তারা তেরোই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বিমান থেকে বৃষ্টির মতো বোমা বর্ষণ করতে থাকে। বাধ্য হয়ে অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পিছিয়ে যায়। এরপর খুবই সতর্কতার সঙ্গে বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে সর্বোত্তম নিরাপদ একটি স্থান হিসেবে মেহেরপুরকে শপথ অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেন তাজউদ্দীন আহমদসহ বিশ্বস্ত কয়েকজন। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এতই কঠিন গোপনীয়তা অবলম্ব্বন করেছেন যে, মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যও ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি যে, কলকাতা থেকে শত শত মাইল দূরে বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসের এক স্বর্ণালি অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে; ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার ঠিক ২১৪ বছর পরে, মেহেরপুরের অখ্যাত ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার এক আম্রকাননে বাংলার সেই অস্তমিত স্বাধীনতার সূর্য আবারও উদিত হতে যাচ্ছে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর হুকুমে ১৭ এপ্রিলের সকালে দমদম এয়ারপোর্টে গোপনে সজ্জিত হয়েছিল ভারতীয় যুদ্ধ বিমান বহর। মেহেরপুর সীমান্তে ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থান করছিল ভারতের সামরিক বাহিনী। মেহেরপুর আম্রকাননের দূর-দূরান্তে ঘাস-পাতা বিছানো জালের ছাউনিতে ভারতীয় বাহিনীর অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান মেহেরপুরের আকাশ নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে দিয়েছিল। আম্রবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরায় ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। গুরুত্বপূর্ণ এই শপথ অনুষ্ঠানের আগের রাতের মুষলধারে বৃষ্টি যেন সেই আম্রকুঞ্জে শুভ্র পবিত্র আবহ তৈরি করে ওই দিনটির মাহাত্ম্যকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। আকাশে মেঘের সঙ্গে আলোর অবিরাম লুকোচুরি খেলা চলছিল। বৈশাখের সোনালি রোদ আর আম্রকুঞ্জের দুরন্ত বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে আগত মানুষজন যেন দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত বিজয়সঙ্গীত শুনতে পাচ্ছিল। কাভার করার জন্য দেশি-বিদেশি প্রায় জনা পঞ্চাশেক সাংবাদিক অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ওই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। শত শত কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, গগন বিদারি স্লোগানে স্লোগানে আম্রকাননের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল সেদিন। খোলা আকাশে চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছিল শপথ মঞ্চ। মঞ্চের সামনে বাঁশের মাঝামাঝি বাঁধা কালোরাতের বিভীষিকার রক্তে রঞ্জিত, অকুতোভয় বাঙালির শৌর্য থেকে উত্সারিত স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজের পতাকা। বেলা এগারোটায় শুরু হয়েছিল শপথ অনুষ্ঠান। মাইকে অনুষ্ঠানের ঘোষণা করছিলেন আবদুল মান্নান। শুরুতেই বাংলাদেশকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রূপে ঘোষণা করা হলো। সেদিন কোরআন তেলওয়াতের জন্য যাতে কোনো ইমাম, মুয়াজ্জিনকে পাওয়া যায়নি। তাই উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা ভিড়ের মধ্যে থেকে মেহেরপুর কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র বাকের আলীকে তুলে আনল ক্বেরাত পড়তে। তার মিষ্টি ক্বেরাতের মধ্যে শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠান। অবশ্য এই ক্বেরাত পড়ার জন্য পাকহানাদাররা পরবর্তীতে তার গায়ে গুড় মাখিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে শরীরে পিঁপড়ের বাসা ঢেলে দিয়েছিল। চারশ চৌষট্টি শব্দে রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটিই হলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান আইনি দলিল যা আমাদের সংবিধান এবং সরকার গঠনের মূল ভিত্তি। প্রজাতন্ত্রের সূচনালগ্নে এই ঘোষণাপত্রটি রাজনৈতিক বৈধতার শক্ত ভিত হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সুদূরপ্রসারী তাত্পর্যের জন্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তা গৌরব বহন করে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র উদ্ভবের প্রেক্ষাপট, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সীমাহীন নিপীড়ন-নির্যাতন-বঞ্চনা, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্য এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির বীরত্ব অভিব্যক্ত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। ঘোষণাপত্রে গণপ্রজাতন্ত্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’- এই তিনটি বিশেষ শব্দ চয়ন করা হয় যা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে চর্চিত হয়ে এসেছে কয়েক সহস্র বছর ধরে। এখানে সাম্য বলতে সব নাগরিকের ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমান অধিকার থাকার কথা বোঝানোর মাধ্যেমে ন্যায়ভিত্তিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কথাই বলা হয়েছে। মানবিক মর্যাদার উল্লেখের মাধ্যেমে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকার কথা বলা হয়েছে এবং সামাজিক সুবিচার বলতে সব প্রকার আর্থ-সামাজিক শোষণমুক্ত সমাজকে বোঝানো হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনই এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তার সেই চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে ঘোষণাপত্রে এই শব্দগুলো যুক্ত করা হয়েছিল যা বাহাত্তরের সংবিধানে বিষদভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্তে মাঝখানে দেশ তার অসাম্প্রদায়িক সেই বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেললেও বর্তমানে বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই সংবিধানকে সমুন্নত রাখার মাধ্যেমে যুগ যুগ ধরে বাঙালির মাঝে প্রবাহমান অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ফিরিয়ে এনেছেন পারঙ্গমতার সঙ্গে। সে যা হোক, ঘোষণাপত্র পাঠ করার পর মঞ্চে ধীর পায়ে উঠে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, কর্নেল ওসমানী। উচ্চারিত হলো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ শপথবাক্য পাঠ করানো হলে মুহুর্মুহু করতালি আর স্লোগান, ফ্লাসলাইটের ঝলসানো আলোই প্রমাণ করে দিচ্ছিল বাঙালির জীবনে নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে, যে সূর্যের আলোয় মাখামাখি হয়ে বাঙালি গেয়ে যাবে নব জীবনের গান। এরপর এঁদের গার্ড অব অনার দেন তত্কালীন মেহেরপুরের এসডিপিও এসপি মাহবুব উদ্দিন বীরবিক্রম। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর তাঁর কন্টিনজেন্ট নিয়ে গার্ড অব অনার দেয়ার কথা থাকলেও দেরি হয়ে যাচ্ছিল বিধায় তত্কালীন এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহীর পরামর্শে মাহবুব উদ্দিন কয়েকজন সৈনিক ও আনসারদের নিয়ে গার্ড অব অনার দিলেন। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হলো। মানচিত্র খোচিত স্বাধীন দেশের পতাকা উড্ডয়ন করা হলো। সবার চোখেই খেলা করছিল পরাধীনতার তমসা হরণের বিস্মিত জ্যোতি যা আম্রকুঞ্জের পত্রপল্লবের ফাঁক দিয়ে বিচ্ছুরিত সোনালি সূর্যের ঋজু রশ্নির সঙ্গে মিশে এক অনবদ্য ঐক্যবদ্ধ শক্তির ইন্দ্রজালের প্রতিচ্ছবি এঁকে দিয়ে জানান দিচ্ছিল বীর বাঙালি পাকিস্তানকে বিদীর্ণ করে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পেরেছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর সেদিনের ভাষণে দৃপ্ত কণ্ঠে পাকিস্তানি জান্তা ইয়াহিয়াকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তানি মিলিটারাি যারা রক্ত ঝরাচ্ছে তাদের ছেড়ে দেয়া হবে না। আমাদের ছেলেরা ধ্বংস করে দেবে। এই যুদ্ধে জয় আমাদের অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিতড়ন করবই। আজ না জিতি, কাল জিতব। কাল না জিতি পরশু জিতবই। পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের সংযোজন হলো তা চিরদিন থাকবে। তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘আমরা যা করছি সবই মুজিবের নির্দেশে। পাকিস্তান কবরস্থ হয়েছে লাখো বাঙালির মৃতদেহের স্তূপে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এ নতুন শিশুরাষ্ট্রকে লালিত-পালিত করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ এক বাস্তব সত্য।’ তাদের সেই দিনের ভাষণ সারা বিশ্ববাসীর কাছে সেই বার্তাই বইয়ে দিয়েছিল যে, বাঙালি তাদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে শুধু প্রস্তুতই নয়, দেশ মাতৃকার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধ পরিকর। প্রকৃতপক্ষে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বাঙালিদের আত্মবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন জুগিয়েছিল। আর মুজিবনগর সরকার হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উত্স। প্রবাসী, বিপ্লবী, অস্থায়ী কিংবা মুজিবনগর সরকার, যে নামেই ডাকা হোক না কেন, যুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনায় দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিল ওই সরকার। মুজিবনগর সরকারের অধীনেই চলেছিল বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মুজিব নগর সরকার ছিল সম্পূর্ণ বৈধ একটি সরকার যা না হলে জনগণ যতই প্রশংসা করুক না কেন আমরা আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা বিদ্রোহী হয়ে পড়তাম। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, স্বাধীনতার সপক্ষে কূটনৈতিক তত্পরতা, গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা, শরণার্থী সমস্যার সমাধানের জন্য সেই সময় এই সরকার গঠন ছিল যুগান্তকারী এক সিদ্ধান্ত। সীমিত সামর্থ্য আর বৈরি পরিবেশে তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যে এই সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব, এক কোটির ওপর শরণার্থীর জন্য ত্রাণ ব্যবস্থা, দেশের অভ্যন্তর থেকে লাখ লাখ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা যুবাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি, স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখা এবং বিশ্বজনমত গঠনসহ বিভিন্ন অবিস্মরণীয় কীর্তি সম্পন্ন করে যা সমকালীন ইতিহাসের বিচারে হয়ে হঠে অতুলনীয় আর সৃষ্টি করে অমর ঐতিহাসিক গৌরবগাঁথা। লেখক: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ |