শিরোনাম: |
জাতিসংঘের জরিপ
দুর্ভিক্ষের শিকার বিশ্বের ৩ কোটি মৃত্যুঝুঁকিতে ১ কোটি মানুষ
|
বর্তমান ডেস্ক : ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কটের মুখে পড়েছে আফ্রিকার তিন দেশ দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া ও নাইজেরিয়া। একই পরিস্থিতি যুদ্ধপীড়িত ইয়েমেনেরও। জাতিসংঘের সবশেষ তথ্য বলছে, ওই চার দেশের তিন কোটি মানুষ রয়েছেন ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কটে। দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছেন এক কোটি মানুষ। বিশ্বজুড়ে এই খাদ্য সঙ্কটের কারণ প্রাকৃতিক নয়, মানুষের সৃষ্টি। একদিকে গৃহযুদ্ধের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট। অন্যদিকে মার্কিন আগ্রাসন। দুইয়ে মিলে এই সঙ্কট তৈরি করেছে। আফ্রিকার সোমালিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের ইয়েমেনে চলছে মার্কিন আগ্রাসন। নাইজেরিয়া আর দক্ষিণ সুদানে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা ও মার্কিন আগ্রাসন। এর বাইরে রয়েছে খরার প্রকোপ। দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে খরা আর এল নিনোকেও দায়ী করা হচ্ছে। তবে এই কথিত প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর নেপথ্যেও রয়েছে মানুষের ভূমিকা, শিল্পোন্নত দুনিয়ার কার্বন পোড়ানোর মুনাফাবাজী। মধ্যপ্রাচ্যের ইয়েমেনে দুই বছরের চলমান গৃহযুদ্ধ থামছে না কোনওভাবেই। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সৌদি জোটের বিমান হামলাও অব্যাহত। জাতিসংঘের মতে, দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে দেশটি। দুর্ভিক্ষের হুমকিতে রয়েছে দেশটির অন্তত ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। ২১ লাখ শিশুসহ অন্তত ৩৩ লাখ মানুষ ভুগছেন অপুষ্টিতে। ৫ বছরের নিচের ৪ লাখ ৬০ হাজার শিশু অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। মোট নাগরিকের ৫৫ শতাংশই ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। যত দিন যাচ্ছে, অবস্থা ততই শোচনীয় হয়ে পড়ছে। ইয়েমেন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জরুরি ভিত্তিতে ১ কোটি ৯০ লাখ নাগরিকের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। যা দেশটির মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি। অর্ধেকেরও বেশি মানুষের চিকিত্সা সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে। দক্ষিণ সুদানের ইউনিটি স্টেটের ২টি কাউন্টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। দেশটির সরকার ও জাতিসংঘের তিনটি সংস্থা মিলিতভাবে এ ঘোষণা দেয়। গত ৬ বছরের মধ্যে এটাই বিশ্বের কোথাও দুর্ভিক্ষ ঘোষণার প্রথম ঘটনা। জাতিসংঘ বলছে, দক্ষিণ সুদানে এক লাখ মানুষ খাদ্যাভাবের মধ্যে রয়েছেন। আরও এক লাখ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। জাতিসংঘের মতে, দেশটির ৪০ লাখ লোকের জরুরি খাদ্য, কৃষি ও পুষ্টি সহায়তা প্রয়োজন। যা দেশটির জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে বেশি মানবিক বিপর্যয়ে রয়েছে। হাজারও মানুষ সেখানে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতিতে রয়েছেন। তাদেরও জরুরি সহায়তা প্রয়োজন। জাতিসংঘের তথ্য মতে, ডিসেম্বর মাসে ৭৫ হাজার শিশু খাদ্যাভাবজনিত মৃত্যুঝুঁকিতে ছিল। নাইজেরিয়া ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আরও ৭০ লাখ মানুষ খাদ্য অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, সমগ্র শাদ হ্রদ অঞ্চলকে সঙ্কট থেকে উদ্ধার করতে অন্তত ১৫০ কোটি ডলার প্রয়োজন। যার অর্ধেকের বেশিই প্রয়োজন ধুঁকতে থাকা নাইজেরিয়ার জন্য। নয়তো স্রেফ খাদ্যাভাবে মারা যাবেন কয়েক লাখ মানুষ। সবচেয়ে ঝুঁকিতে এসব দেশের শিশুরা। আর সোমালিয়া গত ২৫ বছরের মধ্যে টানা তৃতীয়বারের মতো দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ল। সবশেষ ছয় বছর আগে ২০১১ সালের দুর্ভিক্ষে দেশটিতে অন্তত ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষ মারা যায়। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসেব বলছে, সোমালিয়ার ২ কোটি ৯০ লাখ মানুষ খাদ্য সঙ্কটের মুখোমুখি। পানি সঙ্কটে আছেন প্রায় ৬২ লাখ মানুষ। দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির কারণে আফ্রিকার ওই তিনটি দেশ ও ইয়েমেনে প্রায় দুই কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার প্রধান নির্বাহী স্টিফেন ও’ব্রেইন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি এমন পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জানিয়েছেন, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান ও ইয়েমেনে ক্ষুধা ‘বিপর্যয়’ এড়াতে মার্চের শেষ নাগাদ কমপক্ষে ৪.৪ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় তহবিলের মাত্র ১০ শতাংশ অর্থ পাওয়া গেছে।
দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির নেপথ্য কারণ: চার দেশের এই ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কটের নেপথ্যে প্রকৃতি নয়, রয়েছে মানুষ-সৃষ্ট কারণ। আটলান্টিক কাউন্সিলে আফ্রিকা সেন্টারের প্রধান জে পিটার ফাম বলেন, ‘নাইজেরিয়া, সোমালিয়া ও দক্ষিণ সুদানের ক্ষুধা সঙ্কট আরও বেশি বেদনাদায়ক, কারণ এগুলো মনুষ্যসৃষ্ট। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন সোমালিয়া ও নাইজেরিয়ার পরিস্থিতিতে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে।’ ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া ও নাইজেরিয়ায় দীর্ঘ লড়াই ও যুদ্ধ পরিস্থিতিকে দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। দুর্ভিক্ষ কবলিত সবগুলো দেশেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে: ব্যাপক বিপর্যয়ের পরও হর্ন অব আফ্রিকান অঞ্চলে সামরিক অভিযান জোরালো করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্র দেশগুলো। গৃহযুদ্ধ ও মার্কিন আগ্রাসনের সম্মিলিত অভিঘাতে ভয়াবহ বিপন্নতায় সেখানকার মানুষ। ২৯ জানুয়ারি নাইরোবি ঘোষণা দেয় তারা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত দক্ষিণ সুদান সরকারকে সহায়তার জন্য তারা শিগগিরই সেনা পাঠাবে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি’র কাছে ফাঁস হওয়া জাতিসংঘের একটি গোপন প্রতিবেদনে দেখা গেছে ‘বেসামরিক জনগণের জন্য দক্ষিণের গৃহযুদ্ধ বিপর্যয়পূর্ণ মাত্রায় পৌঁছেছে’। একই বাস্তবতা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনেও। গৃহযুদ্ধে বাড়তি উসকানি তৈরি করেছে মার্কিন অস্ত্র এবং তাদের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিমান হামলা। হামলার কারণে দেশটির নাগরিক ছাড়াও পালিয়ে আসা সোমালিয়ানরাও আটকা পড়েছে। এদিকে জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা জানান, এটি তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মানবিক সঙ্কট। তবে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীরা ঠিকই সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছেন। গত ডিসেম্বেরে মিডিয়া বেঞ্জামি লেখেন, ‘সৌদি সাম্রাজ্যের এই নির্যাতনের পরও মার্কিন সরকার শুধু তাদের সমর্থনই দেয়নি বরং তাদের কাছে ১১৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে।’ দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সহযোগিতা পায়নি জাতিসংঘ: নাইজেরিয়া ও সোমালিয়ায় চরমপন্থি গ্রুপ বোকো হারাম ও আল-শাবাব পরাজয়ে অনমনীয় তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে এবং এখনও এই উভয় সংগঠনের দখলে অনেক অঞ্চল রয়েছে; যা সহায়তা প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করেছে। পাশাপাশি তাদের দমন করতে রয়েছে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ। ত্রাণ সহায়তা নিয়েও রয়েছে আইনি জটিলতা। আল-শাবাব গোষ্ঠীর কারও হাতে ভুল করে ত্রাণ দিয়ে ফেললেও ত্রাণকর্মীকে ১৫ বছর পর্যন্ত কারাভোগ করতে হতে পারে। তাই ত্রাণ কার্যক্রম স্বতস্ফূর্ত থাকে না। আর ২০০৮সাল থেকে সোমালিয়ায় আল-শাবাব দখলকৃত অঞ্চলে ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইউনাটেড স্টেট এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি)। আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ কবলিত দেশগুলোতে খরার বাইরে দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে শনাক্ত হয়েছে এল-নিনো, যা প্রাকৃতিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট। ঋতু পরিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করে পৃথিবীকে ভয়াবহ উষ্ণ করা এই প্রাকৃতিক পরিবর্তন নিয়ে আগেই সতর্ক করেছিল জাতিসংঘ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং দুর্ভিক্ষের আগাম সতর্কতাবিষয়ক নেটওয়ার্ক এর দেয়া এক যৌথ বিবৃতিতে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বলা হয়, ‘২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফসল উত্পাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এল নিনোর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।’ বর্তমান দুর্ভিক্ষকে সেই প্রভাব হিসেবেও দেখছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তবে জার্মানভিত্তিক এক সমুদ্র গবেষণা সংস্থা জিও-মার ২০১০ সালে বলেছিল, মানুষের সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীতে এল-নিনোর স্থায়ী প্রভাব সৃষ্টি করবে। বিপরীতে অনেক বিজ্ঞানীই অবশ্য এই প্রভাবকে সামান্য মনে করছেন। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, আফ্রিকার ক্রমবর্ধমান খরা ও দুর্ভিক্ষ সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলবে। নতুন করে অভিবাসীদের মিছিল ইউরোপে ধাবিত হবে। শঙ্কা বাড়বে আরও বেশি মানুষের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার। |