শিরোনাম: |
তিস্তা নিয়ে অধীর আগ্রহে বাংলাদেশ
|
স্বপন কুমার সাহা :
২০১১ সাল তত্কালীন ভারত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরটি নানা দিক দিয়ে তাত্পর্যপূর্ণ ছিল। তখন বাংলাদেশ ও ভারতের শীর্ষ নেতৃত্ব তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে জোর আশাবাদী ছিল। ওই সময় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তির একটি খসড়াও তৈরি করেছিল কেন্দ্রে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দোপাধ্যায় চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছিলেন বলে আমরা জানি। এরই মধ্যে ২০১৫ সালের ৬ জুন দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। তার ওই সফরে দু’দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও প্রটোকল সই হয়। যা প্রতিবেশী দেশ দুটির জন্য বিভিন্ন দিক দিয়ে তাত্পর্যপূর্ণ ছিল। ওই সফরে বাংলাদেশ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই ইতিবাচক বাংলাদেশের মানুষ আশা করে, মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পূর্ণ সহযোগিতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বহুল প্রতিক্ষীত তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। চুক্তিটি বাস্তবায়ন হলে প্রতিবেশী দেশ দুটির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিশেষ মাত্রা পাবে, যা যে কোনো পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের পথচলাকে দৃঢ় ও মসৃণ করতে সহায়ক হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৭ এপ্রিল চার দিনের সফরে ভারত যাচ্ছেন, তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত। তার এ সফর ঘিরে দুই দেশেই ব্যাপক উত্সাহ ও আগ্রহ দেখা দিয়েছে। এ সফরে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে, তা এখনই বিস্তারিত জানা না গেলেও এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অভিন্ন নদীর পানিসম্পদের সুষম বণ্টন বিষয়ে বিদ্যমান সমস্যাগুলো প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় অবশ্যই থাকবে। সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে ৪৯টি চুক্তি ও স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে। তবে বাংলাদেশের মানুষের সব দাবির কেন্দ্রে তিস্তা চুক্তির বাস্তবায়ন। এটি বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবি। বাংলাদেশের জন্ম থেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আর এ সম্পর্ক এখন এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। দেশ দু’টির পথচলায় কিছু চড়াই-উতড়াই থাকলেও কখনোই তা বৈরীতায় রূপ নেয়নি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশ-ভারত বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সুরাহার পথে এগোতে থাকে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে নয়াদিল্লিতে ঐতিহাসিক স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিতে সুনির্দিষ্টভাবে স্থলসীমানা চিহ্নিত ও তা সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে বেশ কতগুলো বিষয়ে মতৈক্য হয়েছিল। ইতিহাসে যা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামে পরিচিত। এছাড়া ’৯৬ এর গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তিসহ দেশ দুটির মধ্যে বিনিয়োগ ও ঋণচুক্তিসহ বিভিন্ন বিভিন্ন চুক্তি এবং সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। এছাড়া ২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্ক সুউচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্থল সীমান্ত চুক্তি-১৯৭৪ এবং সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল ২০১১ অনুযায়ী দেশ দুটির মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ চুক্তিটি অনুসমর্থন করলেও ভারত তখন তা করেনি। তারপর ২০১১ সালে সীমান্ত চুক্তির সঙ্গে সই হয় প্রটোকল। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রটোকলসহ সীমান্ত চুক্তি কার্যকর করতে ভারতের সংবিধান সংশোধন জরুরি হয় পড়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বর্তমান সরকার দেশটির পার্লামেন্টে সর্বসম্মতভাবে সংবিধান সংশোধনে সমর্থ হন। এরপরই প্রটোকলসহ সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পথ উন্মুক্ত হয়। এরপর ২০১৫ সালের জুনে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে সীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর করে দুই দেশ। তার আলোকে নির্ধারিত সময় অর্থাত্ ওই বছরের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাস্তবায়ন হয় এ ঐতিহাসিক চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের অংশ হয়ে যায়। অপরদিকে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের মালিকানা পায় ভারত। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, এ চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে ঐতিহাসিক উচ্চতা পেয়েছে। তবে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এত অর্জন থাকা সত্ত্বেও দেশ দু’টির সম্পর্কে কাঁটা হয়ে আছে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি। তিস্তা ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী। এর পানি প্রবাহের ওপর এর তীরবর্তী অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা তথা অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল। ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটির ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। এ নদীর পানি প্রবাহের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প। কিন্তু এ নদীর পানির হিস্যার সুরাহার বিষয়ে বাংলাদেশ-ভারত আন্তরিক হলেও বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে এ চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদীগুলোর পানি ব্যবস্থাপনা ও প্রবাহের সুষ্ঠু বণ্টনের জন্য ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। ওই সালেই তিস্তা নদীর পানি বণ্টন বিষয়টি আলোচনায় আসে। পরে ১৯৮৩ সালে দেশ দুটির মধ্যে একটি খসড়া চুক্তি নিয়ে কথা হয়, যাতে নদীর জন্য ২৫ ভাগ পানি রেখে বাকিটুকু প্রায় সমান ভাগ করার কথা ছিল। তিস্তা অববাহিকার ভারত ও বাংলাদেশ অংশে বসবাসরত জনসংখ্যার আনুপাতিক হার প্রায় সমান, অর্থাত্ ৫০ : ৫০। সে হিসাবে দুদেশরই সমান পানি দরকার। এদিকে সেচ সুবিধার জন্য ১৯৮৮ সালে ভারত তিস্তা নদীর উত্সমুখে জলপাইগুড়িতে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ করে। পরে একই উদ্দেশ্যে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ লালমনিরহাটের দোয়ানীতে নির্মাণ করে তিস্তা ব্যারেজ। তবে এরপরই শুরু হয় পানিপ্রবাহের অসম বণ্টন। গজলডোবা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ নিজেদের ইচ্ছামতো পানি ছেড়ে দেয়া ও বন্ধ করা শুরু করল। উজানের দেশ হওয়ায় ভারত আগেই ব্যারাজ ও সেচ-খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে ফেলায় বাংলাদেশের ব্যারাজটি ধীরে ধীরে কার্যকারিতা হারাতে থাকে। আর এখন তো শুষ্ক মৌসুমে এটি পুরোপুরি অকার্যকর ও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তিস্তা বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। যার আওতায় বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার ৬ দশমিক ৩২ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার পরিকল্পনা সরকারের। বাংলাদেশে নির্মিত তিস্তা ব্যারেজের কাছে ঐতিহাসিকভাবে তিস্তা নদীর সর্বাধিক গড় প্রবাহ ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার কিউসেক এবং সর্বনিম্ন গড় প্রবাহ ছিল ১০ হাজার কিউসেক। ভারতে ক্রমবৃদ্ধি হারে পানি সরিয়ে নেয়ার কারণে বাংলাদেশে এর প্রবাহ এখন ১ হাজার কিউসেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এমনকি খরার সময় তা পাঁচশ কিউসেক হয়ে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রের তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ সালে বোরো মৌসুমে রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তিস্তায় পানির অভাবে সেচ দেয়া সম্ভব হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। অর্থাত্ ওই বছর সেচ সুবিধা থেকে বাদ পড়ে ৪৭ হাজার হেক্টর জমি। ২০১৫-২০১৬ সালে বোরো মৌসুমে আরও কমিয়ে সেচ সুবিধা দেয়া হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। চলতি ২০১৬-১৭ সালে তা আরও কমিয়ে মাত্র আট হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দিনাজপুর ও রংপুরের কমান্ড এলাকা ৫৭ হাজার হেক্টর জমি সেচ কার্যক্রম থেকে বাদ দিয়ে শুধু নীলফামারী জেলার ডিমলা, জলঢাকা, নীলফামারী সদর ও কিশোরগঞ্জ উপজেলাকে সেচের আওতায় রাখা হয়েছে। তিস্তায় পানি স্বল্পতার কারণে চলতি বোরো মৌসুমে রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২ উপজেলাকে তিস্তা ব্যারাজের সেচ সুবিধা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। বাদ পড়া এই জমির পরিমাণ ৫৭ হাজার হেক্টর। সূত্র বলছে, তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৪০০ কিউসেক। কিছুদিন আগেও তিস্তা ব্যারেজে পানির স্তরের পরিসীমা ৭০০ থেকে ৮০০ কিউসেক ছিল। বর্তমানে তিস্তায় পানি সঙ্কটের কারণে বোরো আবাদি কৃষকরা ব্যাপক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তিস্তার পানি বণ্টনে অসমতা শুরু হলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবারই দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। জোরালোভাবে চাপ প্রদানের পর ১৯৯৬ সালে উভয় দেশের সরকার দ্বিপক্ষীয় কোনো চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত একটি সমঝোতায় পৌঁছায়। সে অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে ভারত ৪০ ভাগ, বাংলাদেশ ৩৫ ভাগ এবং স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে ২০ ভাগ পানি থাকার কথা। তবে ওই সমঝোতা কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। সমঝোতার পর বাংলাদেশ ৩৫ ভাগ তো দূরের কথা, ১০ ভাগ পানিও পায়নি কখনো। এসব অনেক পুরনো কথা। এ বিষয়ে ভারতও সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল। তাই তিস্তা ইস্যুর সুরাহা নিয়ে দু’দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনাও কম হয়নি। তবে দুঃখের বিষয় প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে চমত্কার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টিই বরাবর থেকেছে উপেক্ষিত। এদিকে ২০০৪ সালে একবার তিস্তা নিয়ে দু’দেশের মধ্যে চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যায়। তখন চুক্তির খসড়ায় বাংলাদেশের ৪০ ভাগ, ভারতের ৪০ এবং ২০ ভাগ পানি নদীর জন্য রাখা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগের অভাবে চুক্তিটি আলোর মুখ দেখেনি। তবে ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসলে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশায় বুক বাঁধতে শুরু করে বাংলাদেশের মানুষ। আওয়ামী লীগ সরকার এ বিষয়ে বরাবরই তত্পড়তা চালিয়েছে। এরই সূত্র ধরে তত্কালীন ভারতের মনমোহন সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুর করে হাসিনা সরকার। উভয় দেশ তখন এ চুক্তির বিষয়ে মতৈক্যেও পৌঁছেছিল। এরপর ২০১১ সাল তত্কালীন ভারত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরটি নানা দিক দিয়ে তাত্পর্যপূর্ণ ছিল। তখন বাংলাদেশ ও ভারতের শীর্ষ নেতৃত্ব তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে জোর আশাবাদী ছিল। ওই সময় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তির একটি খসড়াও তৈরি করেছিল। খসড়া বণ্টন চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, তিস্তার পানির একটি অংশ স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য রেখে বাকি অংশের ৫২ ভাগ পাবে ভারত, আর ৪৮ ভাগ বাংলাদেশ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় চুক্তিটি মেনে না নেয়ায় এ দেশের মানুষের প্রাণের সেই দাবি সেবার পূরণ হয়নি। মনমোহন সিংয়ের সেই সফরে দুই দেশের উন্নয়ন সহযোগিতায় বেশ কয়েকটি চুক্তি ও রূপরেখা হলেও তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় সফরটি সফল হয়নি। এমনকি তখন বন্ধুপ্রতীম এই দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল। তবে মনমোহনের ওই সফরে তিস্তা চুক্তি সই না হলেও এ বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনা থেমে থাকেনি। এর মধ্যে ভারতের কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার পরিবর্তন হয়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসলেও বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কে কোনো টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়নি। বরং বিজেপি ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও উন্নত হয়। এদিকে কেন্দ্রে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দোপাধ্যায় চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছিলেন বলে আমরা জানি। এরই মধ্যে ২০১৫ সালের ৬ জুন দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। তার ওই সফরে দুদেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও প্রটোকল সই হয়। যা প্রতিবেশী দেশ দুটির জন্য বিভিন্ন দিক দিয়ে তাত্পর্যপূর্ণ ছিল। ওই সফরে বাংলাদেশ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই ইতিবাচক। এমনকি তিনি শেখ হাসিনার ভিশন ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে পাশে থাকারও প্রত্যয় জানান। তবে মনমোহন সিংয়ের সফরের মতো মোদির সফরেও কাঁটা হয়ে থাকে তিস্তা চুক্তিটি। মূলত ওই চুক্তিটি নিয়ে তখন বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। ২০১১ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না আসায় তিস্তা চুক্তি হয়নি। কিন্তু মোদির সফরের একদিন আগেই মমতা ঢাকায় এসেছিলেন। তবুও তিস্তা চুক্তি হয়নি। তখন জানা গেল, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিষয়টির সুরাহা করতে আগ্রহী নয় ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস। পরে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে মমতা আবারও ক্ষমতায় ফিরেন। তাই এবার এ চুক্তি নিয়ে অধীর আগ্রহে রয়েছে বাংলাদেশবাসী। এদিকে গণমাধ্যম সূত্রে যতটা জানা গেছে তিস্তা চুক্তির প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরেই তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার ব্যাপারে উভয় দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব তত্পর রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের অন্যতম এজেন্ডা হলো তিস্তা চুক্তি। এই সফরেই তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আমরা এখনও আশাবাদী।’ পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদও স্পষ্ট করে কিছু না বললেও এ ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারেরর সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনার কথা জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের কেন্দ্র থাকবে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি। এদিকে কয়েক দিন আগে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে, মমতা বন্দোপাধ্যায়কে ছাড়াই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন করে ফেলবে। কিন্তু বিষয়টির সঙ্গে যেহেতু বশ্চিমবঙ্গ ওেপ্রাতভাবে জড়িত, তাই মমতা বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে চুক্তিটি করাই শ্রেয়। আর যদি ব্যক্তি মমতার কথা বলি, তাহলে বলব- তিনিও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক। যতটা জানি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তার সম্পর্ক যথেষ্ট উষ্ণ। এছাড়া তিনি বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে, তাদের চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কেও যথেষ্ট খোঁজখবর রাখেন। বাংলাদেশের ব্যাপারে তিনি যে আন্তরিক তার সাম্প্রতিক একটি প্রমাণ উল্লেখ করতে চাই। সম্প্রতি স্থানীয় একটি সংগঠন কলকাতার বেকার হোস্টেল থেকে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ সরিয়ে দেয়ার দাবি জানালে তার প্রতিক্রিয়ায় মমতা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের দুই বাংলার প্রেরণা। তার ভাস্কর্য সরানোর প্রশ্নই ওঠে না। কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন এবং এর আগেও বহুবার বাংলাদেশে এসেছেন, এ দেশের মানুষের সুখ-দুঃখের খোঁজ নিয়েছেন। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলটির আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন মমতা দিদি। তখন তিনি মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন না। ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের অতি জনপ্রিয় নেত্রী। আমি তখন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। তখন প্রয়াত সাংবাদিক বেবি মওদুদ আমাকে বললেন মমতা দিদিকে প্রেসক্লাবে আমন্ত্রণ জানাতে। তাকে আমন্ত্রণ জানালাম মধ্যাহ্নভোজের। আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করে মমতা দিদি আসলেন, মধ্যহ্নভোজে অংশ নিলেন এবং দীর্ঘ সময় আড্ডা দিলেন আমাদের সঙ্গে। সেদিন তিনি শুনিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সুখ-দুঃখের কথা, শুনেছিলেন আমাদের কথা। একই সময়ে তিনি অনানুষ্ঠানিক রূপরেখা দেখিয়েছিলেন কীভাবে সমন্বিতভাবে দুই বাংলার উন্নয়ন করা যায়। তখন তার বক্তব্যে এতটুকু বোঝা যায়নি যে তিনি ভিন্ন একটি দেশের রাজনীতিক। মনে হয়েছিল তিনি যেন সহোদর বড় বোন, যে অন্যদেশে থাকলেও ভাইদের মনের না বলা সব কথাগুলোই জানেন। সেদিন তার কথাবার্তায়, দূরদর্শিতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম এবং ভেবেছিলাম তিনি একদিন না একদিন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় অবশ্যই আসবেন। কারণ এমন দূরদর্শী নেত্রীকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চিনতে ভুল করবে না। আজ মমতা দিদি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। একবার নয়, পরপর দুইবারের নির্বাচিত নেতা। এসব কথা বলার একটাই কারণ মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশকে কখনোই দূরদেশ হিসেবে ভাবেন না। তিনি ভারতের ২৮টি রাজ্যের একটির মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি সবার মন রক্ষা করতে পারবেন না, এটা অস্বাভাবিক নয়। তবে আমি মনে করি তিনি তার এপার বাংলার ভাইদের দুঃখ কষ্টের কথাও ভুলে যাননি। তিনি নিজেদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি এপারের ভাই-বোনদের স্বার্থ তথা ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবেন। তিস্তার পানির অভাবে বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ-কষ্টের তিনি অগ্রাহ্য করে যাবেন, এটা বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। তিনি জানেন তিস্তার পানি নিয়ে আমাদের যে দাবি, তা অন্যায্য নয়। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার দাবি। ইতোমধ্যে তিস্তার বাংলাদেশ অংশের বেশিরভাগ ধূ ধূ বালুচরে পরিণত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এই ছোট বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ হেক্টর আবাদি জমিতে যদি চাষাবাদ না করা যায় তাহলে আমরা কেমনে বাঁচব? তাই আশা করছি তিস্তার পানির ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের ব্যাপারে এবার মমতা দিদি আগ্রহী হবেন। মমতাময়ী দিদি, আপনি এ উদ্যোগ নিলে এপার বাংলার মানুষ আপনাকে আজীবন মনে রাখবে, তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। সবশেষে আনন্দবাজার পত্রিকার সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে তিস্তা চুক্তি হলে পশ্চিমবঙ্গের যে সম্ভবনার রূপরেখা দেখানো হয়েছে তা উল্লেখ করতে চাই। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, তিস্তা চুক্তি করা গেলে ওই নদী সংস্কার এবং পানি সরবরাহের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ পেতে পারে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ফলে তিস্তা সংলগ্ন এলাকার চাষাবাদ আরও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই বাংলাদেশের মানুষ আশা করে, মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পূর্ণ সহযোগিতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বহুল প্রতিক্ষীত তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। চুক্তিটি বাস্তবায়ন হলে প্রতিবেশী দেশ দুটির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিশেষ মাত্রা পাবে, যা যে কোনো পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের পথচলাকে দৃঢ় ও মসৃণ করতে সহায়ক হবে। লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক- দৈনিক বর্তমান; সাবেক সাধারণ সম্পাদক- জাতীয় প্রেসক্লাব; সাবেক প্রেসমিনিস্টার- বাংলাদেশ দূতাবাস, যুক্তরাষ্ট্র। |