শিরোনাম: |
পাটের ব্যবহার বাড়াতে হবে
|
মো. ওসমান গনি : এক সময় পাট বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল ছিল। তখন পাটকে বলা হতো সোনালি আঁশ। সে সময় বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে পাটের চাষাবাদ করা হতো। তখন দেশে ছিল যথেষ্ট পরিমাণ পাটকল। পাটের অতিরিক্ত চাষাবাদ ও পাটকলের কারণে সে সময় যেমনিভাবে হয়েছিল কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ঠিক তেমনিভাবে আয় হতো আমাদের জাতীয় অর্থনীতির আয়ের একটি বিরাট অংশ। মাঝখানে কিছু সময়ের জন্য কর্তৃপক্ষের তদারকিতে অবহেলার কারণে পাটের চাষাবাদ কিছু কমে গেলেও বর্তমানে আবারও পূর্বের মতো ব্যাপক আকারে পাটের চাষাবাদ বৃদ্ধি করার জন্য সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। পাট চাষ করে চাষিরা যাতে পাটের ন্যায্যমূল্য পায় সেই হিসাব করে বর্তমান সরকার দেশে ও বিদেশে পাটপণ্যের ব্যবহার আর বিস্তৃত করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করছে। দেশের মধ্যে পাটপণ্য ব্যবহারের জন্য বাধ্যতামূলক কিছু ক্ষেত্র নির্ধারণ করছে। অদূর ভবিষ্যতে দেশের সর্বক্ষেত্রে পাটপণ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে বহুমুখী পাট পণ্যের রফতানি দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশের পাটের তৈরি আধুনিক বিলাস সামগ্রী এখন বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন ব্যবহূত হচ্ছে ব্রিটিশ রাজপুত্র প্রিন্স চার্লসের বাসায়। স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের রানীর হাতে পৌঁছে গেছে বাংলার তৈরি পাটের তৈরি ব্যাগ। ২০১১ সালে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উত্সবে ১৫ হাজার অংশগ্রহণকারীর হাতে যে আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাটের ব্যাগ তুলে দেয়া হয়েছিল সেগুলো গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিও তাদের বার্ষিক সম্মেলনে প্রতিবছর পাটের ব্যাগই সদস্যদের উপহার দিয়ে আসছে। বলা হয়েছে, পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে বিশ্বের বেশিরভাগ পরিবেশ বিষয়ক সম্মেলনে পাটের ব্যাগ ব্যবহূত হচ্ছে। এগুলো বেশিরভাগই যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশে পাটের সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে বলার নেই। এক সময় দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে যে কটি খাতকে বিবেচনায় নেয়া হতো তার মধ্যে পাট ছিল অন্যতম।
পাটের ব্যাপারটি ছিল বহুমাত্রিক। এটি একদিকে যেমনি কৃষকের জন্য অন্যদিকে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলের কর্মসংস্থানের জন্যই এক বিশাল ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সাবেক পাকিস্তান আমল পর্যন্ত পাটের এই বাস্তবতা ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশের একশ্রেণির লুটেরার হাতে পড়ে সেই যে পাট খাত তার স্থানচ্যুত হলো, আজও পাট সেই মর্যাদায় অসীন হতে পারেনি। এই না পারার পেছনে নানামাত্রিক কারণ কাজ করছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেমনি পাটের বিকল্প ব্যবহার বৃদ্ধি করতে পারেনি, তেমনি দেশীয় বাজারেও পরিবেশসম্মত এই পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে পারেনি। পাটের বিকল্প পলিথিনকে কোনো অবস্থাতেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। পাট রফতানিতেও সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা এবং অবস্থান সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে বলা হয়েছে ২০১০ সাল পর্যন্ত যেখানে ৪৮টি দেশে কাঁচাপাট রফতানি হয়েছে সেখানে ২০১১ সাল থেকে ২৩টি দেশে রফতানি বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশ পাট রফতানিতে এগিয়ে আসতে শুরু করছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে এক সময়ে দড়ি, চট, বাজারের ব্যাগ বা বস্তার মতো সস্তা পণ্যের মধ্যে পাটের ব্যবহার সীমিত থাকলেও সেই পাট এখন বিশ্বের নামি-দামি গাড়ি তৈরির কোম্পানি বিএম ডব্লিউর সর্বাধুনিক আইথ্রিডেলের ইলেকট্রিক গাড়ির ভেতরে বক্স বডি ও অন্যান্য উপাদান তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। জার্মানির ভক্সওয়াগন জাপানের নিশান ও টয়োটা গাড়ির কাঁচামাল হিসেবেও বাংলাদেশের পাটের সমাদর রয়েছে। পাটের শপিং ব্যাগ বাসাবাড়িতে আসবাব সামগ্রী বাগানে ব্যবহূত শৌখিন সামগ্রী থেকে শুরু করে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, স্যুট, শার্ট-প্যান্ট, চাদর এমনকি ডেনিমও পাট থেকে তৈরি হচ্ছে। সুতরাং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে পাটের ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে। পরিবেশবান্ধব ইতিবাচক এই পরিবর্তনকে কার্যত এগিয়ে নিতে যে ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন তা না থাকলে পাটের টিকে ধাকার ব্যাপারটি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের পাটকে ঘিরে নিকট প্রতিবেশির নানা চক্রান্তের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। এক সময়ে বাংলাদেশের পাট দিয়েই তারা তাদের পাটকলগুলো চালু রেখে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পাটের বাজার তারা দখল করতে তত্পর ছিল। বাংলাদেশের উপর দিয়ে তারা প্রায় বিনা শুল্কে পণ্য পরিবহন করলেও বাংলাদেশের পাটজাত সেখানে যাতে বৈধভাবে ঢুকতে না পারে সেজন্য করেছিল বিভিন্ন রকম ফন্দি। তাত্ত্বিকভাবে আমরা পাটের নানাদিকে হয়ত এগিয়েছি কিন্তু পাটের প্রাণ যে কৃষক সেই কৃষকের আস্থা অর্জনে আমরা মোটেও সফল হতে পারিনি। পাটকে কাজে লাগাবার দুটো পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, আগে আমাদের দেশীয় বাজারে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি বৃদ্ধি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো পাটজাত পণ্যের রফতানি হয়ত বেড়েছে কিন্তু সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাটের চাহিদা কমছে। এটা কোনো বিবেচনাতেই ইতিবাচক নয়। আমাদের বৈদেশিক আয়ে ভাটা পড়তে শুরু করছে। রফতানি আয় বাড়ানো না গেলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সে জন্যই পাটের উত্পাদন এবং বিপণনের উপর সর্বাধিক নজর দেয়া জরুরি। বাংলাদেশের পাট এখনও বিশ্ববাজারে বিশেষভাবে সমাদৃত। দেখা যাচ্ছে, পাটের উপযোগিতা ইতিবাচক ধারায় বৃদ্ধি পেয়েছে। গাড়ির কাঁচামাল হিসেবে পাটের ব্যবহারের দিকটি নিঃসন্দেহে সম্ভাবনা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই বাজার যাতে বাংলাদেশের হাত ছাড়া না হয়ে যায় সেদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। একটি তৈরি বাজার যদি আমাদের অবহেলার কারণে হাত ছাড়া হয়ে যায়, তাহলে হয়তো আমরা আবারও পাটপণ্যের দিক দিয়ে পেছনে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আর যারা আমাদের হাত থেকে চলে যাবে তারা হয়তো আবার নতুন নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টা করবে। তাই যে কোনো মূল্যে হোক আমাদের পাটের আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখতে হবে। সেখানে বাজার ধরে রেখে দেশের মধ্যে ব্যাপক আকারে পাট চাষের জন্য দেশের কৃষকদের আগ্রহী করে তোলতে হবে। কৃষকরা যাতে চাষের পর তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাট চাষের জন্য কৃষকদের মধ্যে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। লেখক: কলাম লেখক |