শিরোনাম: |
বিবির পুকুর
|
ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল। এভাবেই পরিচিতি ছিল এক সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের এই শহরটির। বরিশালের বালাম-বাসমতি চাল ছিল খুবই জনপ্রিয়। চারপাশেই নদী আর খাল দিয়ে ঘেরা শহরটি ব্রিটিশ, আরব, পারস্য ও পর্তুগীজ বণিকদেরও ব্যবসা-বাণিজ্যের পসরায় পরিণত হয়েছিল। এ কারণে বরিশালের অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল পুরো বাংলার অর্থনীতি। স্বভাবতই বরিশালকে বলা হতো প্রাচ্যের ভেনিস। পর্যটক রালফ ফিস ১৫৮০ সালে বাকলাকে (বরিশাল) অত্যন্ত সম্পদশালী হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন। সুতরাং ভ্রমণের অফুরন্ত স্বাদ আর কালের সাক্ষী হওয়ার অনেক নিদর্শন দেখতে হলে আজই ঘুরে আসতে পারেন বরিশালে। আজ এই অঞ্চল নিয়ে ‘হাওয়া বদল’ এর তৃতীয় পর্বে রইল কয়েকটি স্থাপনা ও জায়গা নিয়ে বিশেষ ফিচার। লিখেছেন - অনিন্দ্য তাওহীদ ও প্রশান্ত কুণ্ডু শুভ
বিবির পুকুর। বরিশাল নগরীর প্রাণকেন্দ্রে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর রোডে (সদর রোড) অবস্থিত। শতবর্ষের পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী কৃত্রিম জলাশয় এটি। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরির পালিত সন্তান জিন্নাত বিবির উদ্যোগে জনগণের জলকষ্ট নিরসনের জন্য নগরীর সদর রোডের পূর্বপাশে ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৮৫০ ফুট প্রস্থ একটি পুকুর খনন করা হয়। পরবর্তীতে এটি তার নাম অনুসারে বিবির পুকুর নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশের অন্য যে কোনো বিভাগীয় শহরের প্রাণকেন্দ্রে এ রকম জলাশয় নেই। বিবির পুকুর বরিশাল নগরীর অন্যতম সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য বলে বিবেচিত হয়। শহরের কোলাহল ছেড়ে এক বিকেল বা সন্ধ্যার আড্ডাটা এখানেই সেরে ফেলেন নগরবাসীরা। জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা (মিশনারি) বরিশালে আসেন। তখন উইলিয়াম কেরি পর্তুগিজ দস্যুদের কাছ থেকে জিন্নাত বিবি নামের এক মুসলিম মেয়েকে উদ্ধার করে তাকে লালন-পালন করেন। পরবর্তীতে এক মুসলিম যুবকের কাছে জিন্নাত বিবিকে বিয়ে দেয়া হয়। উইলিয়াম কেরি জিন্নাত বিবিকে জেনেট বলে ডাকতেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে জিন্নাত বিবি জনগণের জলকষ্ট নিরসনের জন্য জলাশয় বা একটি বড় পুকুর খননের উদ্যোগ নেয় এবং তা করেও ফেলেন। তখন থেকেই পুকুরটি বিবির পুকুর নামে পরিচিতি লাভ করে। এক সময় কীর্তনখোলা নদীর সঙ্গে এ পুকুরের দুটি সংযোগ ছিল এবং এতে নিয়মিত জোয়ার ভাটা হতো। সংযোগ দুটির একটি বরিশাল সার্কিট হাউস হয়ে মৃতপ্রায় ভাটার খালের মাধ্যমে কীর্তনখোলায় এবং অন্যটি নগরীর গির্জা মহল্লার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিলুপ্ত খালের মাধ্যমে কীর্তনখোলা নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এখন আর সেই অবস্থা নেই। হারিয়ে গেছে সংযোগ আর জোয়ার-ভাটাও। বরিশাল পৌরসভা স্থাপনের পর থেকেই বিবির পুকুরটি বিভিন্নভাবে সংস্কার ও পুনর্খনন করা হয়েছিল। ৯০-এর দশকে পৌর চেয়ারম্যান আহসান হাবিব কামাল পুকুরটির ঐতিহ্য রক্ষায় বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে তিনিই বরিশালের মেয়র। তারপরও অযত্ন অবহেলায় বিবির পুকুর। তবে ২০০৮ সালে শওকত হোসেন হিরণ বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বিবির পুকুরের ঐতিহ্য রক্ষা এবং সৌন্দর্য বর্ধনে নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এর মধ্যে পুকুরের চারপাশে ঝুলন্ত পার্ক, বিশ্রাম নেয়ার জন্য বেঞ্চ, অত্যাধুনিক গ্রিল ও পুকুরটির শোভা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের লাইটিং স্থাপন উল্লেখযোগ্য। এর পাশাপাশি বিবির পুকুরের পাশেই উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র পাবলিক স্কয়ার (বর্তমানে হিরণ স্কয়ার নামে পরিচিত) এবং পুকুরের মধ্যে ফোয়ারা স্থাপন করেন। তখন একটু হলেও এর সৌন্দর্য বিকশিত হয়েছিল। ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর জনগণের জন্য পুকুরের চারপাশ ও হিরণ স্কয়ার এলাকায় ফ্রি ওয়াই-ফাই সুবিধা যুক্ত করাও হয়েছিল। বরিশালবাসী খুশি ছিল তার এই উদ্যোগে। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি আর নির্বাচিত না হওয়ায় এবং তার অকালমৃত্যুর পর এখানে নজর পরেনি কারও। যাদের দেখভালের দায়িত্ব তাদেরও গাছাড়া ভাব পরিলক্ষিত হয়। তারপরও বিবির পুকুর একটি নাগরিক বিনোদনের স্থান হিসেবে সুপরিচিত ও ব্যবহূত হচ্ছে। বিকেলে ও সন্ধ্যায় বরিশালবাসী একটু স্বস্তির জন্য এবং আড্ডা-অবসর সময় কাটানোর জন্য পুকুর পাড়ে ও হিরণ স্কয়ারে জড়ো হয়। আপনি এই ঐতিহাসিক পুকুরটি দেখতে চাইলে আজই বরিশাল ভ্রমণ করুন। তাছাড়া, শহরের মাঝে এমন বড় পুকুর আর একটিও মিলবে না এই বাংলায়। তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া |