শিরোনাম: |
মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত দলিল বীর মোস্তফা
|
এম. উমর ফারুক : গভীর রাত। হঠাত্ শা শা গুলির আওয়াজ। দু-চারজন দৌড়ে পালালো। মুহূর্তে কান্নার আওয়াজ। বাসর বিছানাতে রক্তের ঢেউ। চারপাশে লেলিহান অগ্নিশিখা। অস্বাভাবিক সময়ের যাত্রা ১৯৭১। সৃষ্টির সেরা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি যে, সবাই সুখে স্বাচ্ছন্দে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। তেমনি চাওয়ার আর পাওয়ার দাবি চিরদিন ছিল এদেশের মানুষের। কারণ এদেশের তথা পাক ভারত উপমহাদেশের মানুষের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল সর্বপ্রথম ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে। পরে যদিও ১৯৪৭ সালে পরাধীনতার হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেয়েছিল, সে স্বাধীনতা এদেশের মানুষের ভাগ্যে সহনশীল হয়ে ওঠেনি। কারন পাক ও ভারত নামের ভিন্য দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। পৃথক দুটি ভূ-ভাগ নিয়ে নতুন রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই সেই দেশের শাসন অর্পিত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকের আওতায়। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভাগ্যে জোটেনি কোন সু শাসন ও উন্নয়ন। ফলে ইংরেজ আমলের মতো আবারও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রাপ্য হয়ে ওঠে শুধু গঞ্জনা আর বঞ্চনা। তাই পূর্ব পাকিস্তানি জনগোষ্ঠী আর শোষণ পীড়ন সহ্য না করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ফলে ১৯৭১ সালে শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। সে যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিল এমন এক বীর সৈনিক মো. গোলাম মোস্তফা সরকার। ১৭টি জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। বৃহত্তর রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহুকুমার উলিপুর থানার তবকপুর ইউনিয়নের সাদুল্যা মৌজার তেলীপাড়া নামক স্থানে তার জন্ম। নিভূতপল্লীর একজন সাধারণ কৃষক ছিলেন তার বাবা মো. নৈইম উদ্দিন শেখ, মাতা মোছা. গোলেনুর বেগম। তার বাবার ছিল সামান্য কিছু লেখাপড়া। মা ছিলেন একজন নিরক্ষর মহিলা। বাবার পারিবারিক অবস্থা তেমন স্বচ্ছলতা ছিল না। গরিব বাবা তিন ছেলে ও এক মেয়ে লালন পালন করতে হাপিয়ে উঠেছিলেন।
সিপাহী গোলাম মোস্তফা সরকার ছিলেন বাবার ২য় সন্তান। পরিবারের বড় ছেলে আবদুল গণি সরকারকে মাত্র ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া পর সংসারের কাজে ব্যস্ত রাখেন। মেয়ে নুরবানুকে সামান্য লেখাপড়া পর বিয়ে দিয়ে পাত্রস্ত করেন তার বাবা। সর্বশেষ সন্তান অর্থাত্ ছোট ছেলেটি মো. গোলাম হোসেন সরকারকেও ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করান। বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. গোলাম মোস্তফা সরকার ১৩৬০ বাংলা সনে ২ মাঘ রোজ শনিবার (১৯৫৪ সালের, ১৬ জানুয়ারি) জন্মগ্রহণ করেন। ছয় বছর বয়সে তার বাবা একই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মরহুম মনসুরের সহোযোগিতায় তার বিদ্যালয় অর্থাত্ থানাহাট ১ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। বিদ্যালয়ের নিকটেই ছিল তার নানার বাড়ি। নানা ও মামা কেউই জীবিত না থাকায় বিধবা নানী ও মামিদের বাসায় থেকে তিনি লেখাপড়া করেন। ১ম শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত কৃতীত্বের সহিত লেখাপড়া করেন প্রথম বিভাগে প্রাথমিক স্তর পাস করেন। ঠিক এ মুহূর্তে দারুণ অভাব এসে ছোবল মারে তার জীবনে। যেমন ছোবল মেরেছিল অন্যান্য ভাই বোনদের বেলায়ও। বাবা মাধ্যমিক শিক্ষার খরচ জোগাতে পারবেন না। তার আর লেখাপড়া করা হবে না। ইহা শুনে তিনি বিহব্বল হলেন, তবে ভেঙে পড়লেন না। ভাবতে লাগলেন কিভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া যায়। বাবাকে তিনি বোঝাতে লাগলেন, মা কে বোঝাতে পারলেও এমন অভাবী সংসারে কিছুই করার ছিল না তার। মা শুধু সবকিছু লক্ষ্য করে চোখের জলে বুক ভাসাতে লাগলেন। পার্শ্ববর্তী গ্রাম মাটিয়াল। হিন্দু জমিদার ঘোষের বাড়ি ছিল সেখানে। সেজন্য মাটিয়ালের আরেক নাম ছিল ঘোষপাড়া। সেখানে ঘোষ জমিদার দের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল একটি জুনিয়র বা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ঠিক সেই সময়ে অত্র বিদ্যালয়টি ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রসারণ করা হয়। গোলাম মোস্তফা সরকারের একমাত্র ফুফুর বাড়ি ছিল সেই এলাকায়। মধ্য গোছের পরিবার ছিল। ফুফু নিঃসন্তান। ফুফাজিও ছিলেন উক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কার্য নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য। পিতা ও পুত্র উভয়ই শরণাপন্ন হলেন সেই ফুফু ফুফাজির কাছে, তাদের উদ্যোগে ও সহযোগিতায় তিনি ভর্তি হলেন সেই বিদ্যালয়ে। দীর্ঘ পাঁচ বছর অনেক কষ্টে অধ্যায়ন করার পর রাজশাহী মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, রাজশাহীর অধীনে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার জন্য ফরম পূরণ করেন তিনি। প্রথম পরীক্ষার তারিখ ছিল ১১ এপ্রিল ১৯৭১ রোজ বৃহস্পতিবার। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি আমল। পূর্ব পাকিস্তানি মানুষের ভাগ্যাকাশ ঢেকে গেল এক গাড় কালো মেঘের আড়ালে। পূর্ব পাকিস্তানি আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল সংসদ নির্বাচনে। পাকিস্তানি ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য না অজুহাত ও পায়তারার আশ্রয় নেয়। এদেশের মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শেখ মজিবুর রহমানকে বাগে নিতে না পেরে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্য রাতে তাকে বন্দি করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়, এবং সেনাবাহিনী কে লেলিয়ে দেয় নিরীহ মানুষের ওপর। যুবকদের গুলি করে মারতে থাকে এবং ঘরবাড়ি জ্বালাতে থাকে। লুটে নিতে থাকেন মা বোন দের সম্ভ্রম। ক্ষোভে ফেটে পড়তে থাকেন এদেশের মানুষ। স্থবির হয়ে যায় দেশের সব কর্মকাণ্ড। ঢাকা শহরসহ সারাদেশের শহর বস্তিগুলোতে চলছিল পাক সেনাদের হানাহানি। রংপুর সেনানিবাস থেকে সেনা বাহিনীর সদস্যরা কুড়িগ্রাম মহকুমায় মোতায়েন হয় ১০ এপ্রিল বুধবার। পরের দিন ১১ এপ্রিল। এসএসসি পরীক্ষা শুরুর প্রোগ্রাম। এমন জীবন হননের মাতামাতির মেলায় কে বা কারা যায় পরীক্ষা দিতে? তবুও সেনা বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় পরীক্ষার্থী খুঁজে খুঁজে ধরে নিয়ে গিয়ে মারপিট শুরু করে। এমতবস্থায় গ্রাম ছেড়ে প্রত্যন্ত ও নিভৃত পল্লী কাশিম বাজারে গিয়ে রাত কাটাতে থাকেন। এবং সুযোগ বুঝে দিনের বেলা এলাকায় আসেন। তারপর শুরু হলো পরীক্ষার্থীর অবিভাবক পিতা ও মাতাকে ধরার পালা। এবার সপরিবারে আশ্রয় নিলো কাশিম বাজারে। কাশিম বাজার ছিলো এমন একটি নদী ঘেরা গ্রাম, যেখানে সেনা বাহিনী সহজেই যেতে পারতো না। নিজ গ্রামে এসে গ্রাম টির নিশ্চিহ্ন অবস্থা দেখে ক্ষোভে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল তার মন। মাঝে মাঝে পাক সেনাদের অত্যাচার ঝোপে-ঝাড়ে পালিয়ে থেকে স্বচক্ষে দেখে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিবেন বলে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন। তার ব্রত ছিল যেভাবেই হোক পাকসেনাদের রুখতে হবে। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। মা বোন দের ইজ্জত রক্ষা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে নিরীহ জনসাধারণের তাজা প্রাণকে ঘাতক পাক বাহিনীর হাত থেকে। স্বাধীনতা দিতে হবে এদেশের মাটি ও মানুষ কে। নচেত্ এ বাংলা মায়ের কোলে জন্ম নেয়া বৃথা যাবে। শোধ হবেনা জন্মভুমির ঋণ। এমন কি মৃত্যুর পর আল্লাহর কাটগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাব দিতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হবার জন্য। এসব চিন্তা করে তিনি এবার একজন সেনা সদস্যের মতো মনে শপথ নিলেন যে তিনি অবশ্যই অবশ্যই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিবেন। থাকলেন শুধু সুযোগের অপেক্ষায়। কারন পুত্র স্নেহে অন্ধ মা বাবা কেউই তাকে মুক্তিবাহিনীতে যেতে দিতে নারাজ। তিনি তার মাকে বোঝাতে লাগলেন, মাগো তোমার ছেলের মত কত ছেলে যে এভাবে মারা যাচ্ছে, তাদের কি তোমার মতো মা নেই? খালি হয়নি কি তোমার মতো কত মায়ের বুক? মাগো তারা যদি পুত্র হারার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে তুমি কেন পারবে না আমাকে হারানোর ব্যথা সইতে? তাহলে তুমি কি চাও মা এমনি করে এদেশের লাখো লাখো মায়ের বুক এভাবে খালি হোক? তুমি তোমার আদরের সন্তান কে বুকে জাপ্টে ধরে রাখবে? তা হয় না মা। একজনের বিপদে অন্যজনকে এগিয়ে আসতে হয়। তোমার ছেলে কে যদি সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করে তখন তোমার কেমন লাগবে মা? লক্ষ্মী মা আমার, দয়া করে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার অনুমতি দেও মা। এভাবে তিনি মা কে অনেক বুঝালেন, কিন্তু কিছুতেই মা রাজি হলেন না ছেলেকে মুক্তিবাহিনীতে যেতে দিতে। মন গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগলো গোলাম মোস্তফা। হাজারো হাজারো চোখ ধাঁধানো ঘটনা স্বচক্ষে অবলোকন করার পর মো. মনির উদ্দিন মেম্বারের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় ১৩ ভাদ্র ৩০ আগস্ট ৮ রজব রোজ সোমবার দিবাগত রাতে বাবা মাকে ফাঁকি দিয়ে বিছানা ছেড়ে একটিমাত্র বুলেট কে বুকে নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মেনে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য স্বদেশের মাটি ও মানুষের নিকট বিদায় নিয়ে রেক্রুডিং ও ট্রেনিং কেন্দ্র রৌমারীর উদ্দেশ্যে পা বাড়ান। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন- শাওনও রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, বাহিরে ঝড়ো বহে, নয়নে বারি ঝরে। ষড় ঋতুর এদেশে এক ঋতুর সঙ্গে অন্য ঋতুর গভীর মিতালী। কবি উল্লেখ করেছেন বর্ষার বিদায়ের সংকেত ধ্বনি ও বর্ষার বিদায়ের পদচিহ্ন বা বর্ষা ঋতুর বিদায়ী দৃশ্য শরতের শুরুতেও যে লক্ষ্য করা যায় তা আবহকাল ধরেই সত্য। ঠিক বর্ষার ঋতু বুঝি ওইদিন মেতে উঠেছিলো মুসুল ধারার বৃষ্টি নামিয়ে শরত কে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। এমন প্রবল বর্ষনের মধ্য দিয়ে তিমির অন্ধকার পাড়ি দিয়ে সহযোগীদের সঙ্গে সকাল সাত ঘটিকায় গিয়ে পৌঁছলেন নিরাপদ খেয়া ঘাট বনগ্রামে। ঠাণ্ডায় দাত খট খট করে বাজতে লাগলো, আর বীর সৈনিক গোলাম মোস্তফা সরকার মনে মনে স্মরণ করতে লাগল বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম কে স্মরণ হতে লাগলো তার কবিতার লাইনগুলো, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে, দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাপার, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুঁশিয়ার যাক, ঘাটে পৌঁছানোর পর দেখা গেল ঘাট ছিল জনশূন্য। এখন মহাবিপদ! কেমন করে পাড়ি দিবেন এই বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ। নৌকার জন্য সবাই এদিক ওদিক ছোটাছুটি শুরু করলেন, কোন ব্যবস্থা খুঁজে পেলেন না। সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে সবারই মনে উত্কণ্ঠা বেড়েই চলছে। সুদুর উলিপুর ও চিলমারী থেকে প্রতিদিন উক্ত খেয়া ঘাট এলাকায় টহল দেয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। কখনো কোনো মুহূর্তে যেন সেনাবাহিনী সেখানে গিয়ে তাদের ধরে ফেলে। যদি সেনাবাহিনীর কাছে তারা ধরা পড়ে তাহলে তাদের মৃত্যু অবধারিত। এই ভেবে সবাই যখন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল, সেই মুহূর্তে দলের সবাইকে উদ্দেশ্য করে মোস্তফা সরকার বলেন, তোমরা কেউই ভয়ে ভেঙে পড়ো না। তোমরা সবাই হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর হিজরতের কথা স্মরন করো। রাসুল (সা.) হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কে শান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, আবু বকর আমরা মাত্র দুজন নই আল্লাহ আমাদের সঙ্গেই আছেন। তোমরা সবাই আল্লাহকে স্মরন কর ,আর পানাহ চাও,আর বলো হে আল্লাহ তুমি আমাদের কে সম্রাট নেপোলিয়ন এর মতো এই ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দেয়ার উপায় সৃষ্টি করে দাও। সবার মনোবল চাঙ্গা হয়। হঠাত করে চোখে পড়লো, বর্ষায় ডুবে বাড়ির পাশে জনহীন অবস্থায় কলাবাগানের ভিতর একখানা ছোট ধরনের নৌকা দেখা গেলো। এবার সবাই একটু আশ্বস্থ হলো যে, নৌকাটি নিয়ে মাল্লা যোগাড় করে নদী পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে। সকাল ৮ ঘটিকার সময় মাল্লা যোগাড় করার জন্য প্রচেষ্টা শুরু হলো আর বেলা ১১ ঘটিকা পর্যন্ত বহু তালাশের পর নৌকার প্রকৃত মালিক কে খুজে পাওয়া গেলো। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, প্রকৃত পক্ষে আসল মাল্লা না থাকায় অল্প বয়সী তিনজন ছেলেকে মাল্লা বানিয়ে নদী পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যাত্রা শুরু করতেই দুপুর ২ টা বেজে গেলো। যাত্রা শুরুতে নদী ছিলো খুব শান্ত। তবে পাড়ের বিস্তৃতি ছিলো বহুদুর। এক কথায় বনগ্রাম থেকে সুদুর রৌমারী বাজার। পারের লক্ষ্য ছিলো বনগ্রাম থেকে পাড়ি জমিয়ে পেড়ার চর ধরা। সেখান থেকে গুন টেনে উক্ত চরের উজানের মাথায় নৌকা নিয়ে পাড়ি ধরা হবে ঘুঘুমারীর চরের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে কুটির চর হয়ে খঞ্জন মারা নালা বেয়ে রৌমারী ক্যাম্প। বিকাল ৩ ঘটিকার পর নৌকা প্রায় পেড়ার চরের নিকটে গেলে শুরু হলো কঠিন পরীক্ষা। উত্তর পূর্ব দিক থেকে শুরু হল বল বাতাস। বাতাসের চাপে নদীর পানি উত্তাল তরঙ্গে রুপ নিলো। ক্ষেপে উঠলো নদী। মাল্লারা আর নৌকা সামলাতে পারল না। নৌকা পাক খেতে খেতে ভেসে চলল দক্ষিণের বাণ্ডালের চরের পূর্ব ধার বেয়ে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকা হয়তো এসে পড়বে কোদালকাটির চরে অবস্থানরত পাকসেনার গানবোট এর সামনে। তখন হয়তো সব শেষ হয়ে যাবে। বিপদসমূহের সম্ভাবনা চিন্তা করে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলেন ও বললেন যে, সবাই বৈঠা ও কাঠের লাঠি, খড়ির চ্যালা দ্বারা দাড় টানা শুরু করো। তার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই দাড় টানতে লাগলেন। বন্ধু ও সহযাত্রী আবদুর রশিদ ধরলেন হাল ও গোলাম মোস্তফা সরকার ধরলেন পাল। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সন্ধ্যা ৭টার সময় নৌকা নিয়ে তারা ঘুঘুমারীর চরে পৌঁছেছিলেন, সেখানেই একটু বিশ্রাম নেয়ার পর তারা আবার কঠিন অন্ধকারে বাকি যাত্রা শুরু করলেন। কুঠির চর, খঞ্জনমারা হয়ে রৌমারী থানার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে গিয়ে পৌঁছলেন রাত ৮ টায়। নৌকা ঘাটে ভিড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ৩০ সদস্য বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার ক্যাম্প প্রহরীর দায়িত্বে নিয়োজিত দুটি দল এসে তাদের নৌকা থেকে নামিয়ে একটি গৃহে গার্ড ফাইলের অধীনে বন্দী করে রাখা হলো। প্রহরায় নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের ধারনা হয়তবা তারা রাজাকার কিংবা কোন ধরনের প্রতিপক্ষ হবে। সারারাত ধরে এক এক জনকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলো। এবং নানা রকম ভয় ভীতি ও দেখাতে লাগলেন। সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা মো. মনির উদ্দীন মেম্বার সাহেব এর ও পাত্তা পাচ্ছিলেন না। গোলাম মোস্তফা সাহেব মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ডেকে নিয়ে বললেন, ভাই আমরা সত্যি সত্যি অপরাধী। কারন আমরা নিষিদ্ধ সময়ে আপনাদের ক্যাম্প এলাকায় ঢুকে পড়েছি। ঠিক আছে আগামী প্রাতে আপনারা যাচাই বাচাই করে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন এ অঙ্গীকার আমি আপনাদের কে দিচ্ছি। তবে দুঃখের বিষয় যে, আমরা মাল্লা ৩ জনসহ মোট ২২ জন লোক ৩০ ঘণ্টা ধরে অনাহারী আছি। আমরা টাকা দিচ্ছি, আপনারা কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে দিন। আগে খেয়ে জীবন বাচাই। তারপর সারারাত বন্দি করে রাখেন তাতে আমাদের কোন দুঃখ নাই। যাক, আল্লাহ পাকের রহমতে আটককারী মহলের মনে একটু দয়া হলো তারা কিছু রুটি বাজার থেকে এনে দিয়েছিলেন। তাই খেয়ে তারা রাত কাটালেন। এদিকে সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা মনির উদ্দিন মেম্বার সাহেব কর্তৃপক্ষকে জানালেন যে, চিলমার, রৌমারী আসনের সংসদ সদস্য সাদাকাত হোসেন (ছক্কু মিয়া) এর সঙ্গে সাক্ষাত করে ছেলেদেরকে মুক্তি বাহিনীতে ভর্তি করার উদ্দেশ্যে নিয়ে এসেছি। আপনারা দয়া করে আমাকে অনুমতি দিলে আমি এমপি সাহেবের নিকট থেকে সুপারিশ নামা আনতে পারি। যেহেতু এমপি সাহেব ভারতের মাইনকার চরে থাকেন, সেহেতু কতৃপক্ষ মনির উদ্দিন মেম্বার কে প্রভাত হবার আগেই মাইনকার চরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেন। সারাদিন পার হয়ে গেলো মনির উদ্দিন মেম্বার সাহেবের কোন খোঁজ নেই। অবস্থা বেগতিক দেখে সবাই চিন্তায় আর কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সবচেয়ে শারীরিক বেহাল অবস্থা হয়েছিল গোলাম মোস্তফা সরকারের। বিকেল ৩ টার পর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগন নির্দোষ বিবেচনা করে মনির উদ্দিন মেম্বারের ফিরে আসার পূর্বেই সবাই কে ভর্তি করে নিলেন। কিন্তু গোলাম মোস্তফা সরকার শারীরিক ভাবে অযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় ছাটাই হয়ে গেলেন। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ভর্তি কারী কর্মকর্তার নিকট অভিযোগ জানাতে লাগলেন যে, স্যার যদি আমাকে ভর্তি করে না নেন তাহলে আমার যাবার কোন ঠাঁই নেই। কারণ দেশের ভেতরে হানাদার বাহিনীর অত্যাচার আর এখানে এসে ভর্তিতে প্রত্যাহার এর কোনটিই আমার জন্য প্রাপ্য নহে,এর চেয়ে বিষ পানে আত্মহত্যা করাই শ্রেয়। এ কথা শুনে ভর্তি অফিসার দয়া করে মোস্তফাকে ভর্তি করে নেন। পরের দিন ১৫ ভাদ্র ৩১ আগস্ট থেকে শুরু হলো ওনার মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষন। বীর গোলাম মোস্তফা সরকার ছোটবেলা থেকেই নম্র ভদ্র ও বিনয়ী ছিল। তাছাড়া খেলাধুলা গানবাজনায় তিনি অনুরাগী ছিলেন। তিনি জীবনে অনেক যাত্রা ও মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানি জাতীয় সঙ্গীতসহ অন্যান্য সঙ্গীত গেয়ে ছাত্র জীবনে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীদের মন জয় করেছিলেন। এ প্রতিভা তিনি চেপে রাখতে পারেন না। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যে কোন ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তৃতা, গান, গজল, কৌতুক, ব্যঙ্গ কাহিনী, রোমাঞ্চকর কাহিনী, এমনকী তাত্ক্ষণিক যুক্তি টেনে বক্তৃতার বিষয় বস্তুর সঙ্গে মিল দিতে প্রশংসা অর্জন করেন তিনি। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রতিদিন পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে তিনি শপথ পত্র পাঠ করাতেন ও জাতীয় সঙ্গীত গাইতেন। সামরিক বিষয়ের প্রশিক্ষণ ক্লাসের প্রতি তিনি ছিলেন খুব মনোযোগী। প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু তিনি যথাযথভাবে লিখে নিতেন। প্যারেড ক্লাসে তিনি সময় মেপে চলতেন। গার্ড বা প্রহরার দায়িত্বে থাকলে তিনি কঠিন ভাবে সে দায়িত্ব পালন করতেন। ফলে ঊর্ধ্বতন অফিসারগন গোলাম মোস্তফাকে খুব স্নেহ করতেন ভালোবাসতেন। এমনকি প্রায় প্রতিটি কাজে তাকে পাশে রাখতেন। ক্যাম্পের সুবাদার, মেজর, হাবিলদার ও অন্যান্য কমান্ডার গন একটু অবসর পেলেই মোস্তফার কাছে গল্প গান শুনতেন। অনেক সুনামের মধ্য দিয়েই তিনি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ শেষ করেন। শুরু হলো তাদের শত্রু পক্ষের সঙ্গে মোকাবিলা করার পালা। সামরিক বিভাগের গোয়েন্দা বিভাগের কাজের দায়িত্বভার খুব কঠিন বিষয়। গোয়েন্দা বিভাগের খবর অফিসার রাই রাখেন। কিন্তু সাধারণ সিপাহীরা সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অজানা থাকেন। হঠাত্ এক সন্ধ্যায় মোস্তফাদের কোম্পানির সবাইকে আগেই খাবার কক্ষে নেয়া হলো। সবার আগে তাদের ভালোভাবে খাওয়ানো হলো। খাওয়া শেষে সবাইকে বিছানাপত্র গোছানোর হুকুম দেয়া হলো। পরে স্টোর রুমে নিয়ে কাউকে রাইফেল, কাউকে এসএম জিও কাউকে শুধু গ্রেনেড দিয়ে লাইনে দাঁড় করানো হলো এবং বলা হলো সামনে নৌকা সাজানো আছে তাতে উঠে বসো। আমরা আজ একটা নতুন জায়গায় যাবো। কোথায়? কেন যেতে হবে? তাদের কে সেসব কিছুই বলা হলো না। ‘উপায় নাই গোলাম হোসেন’ নবাবের নাটকের সেই ভাস্য সবারে মনে পড়লো। তবুও ওনারা সবাই গিয়ে উঠে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে অফিসারগন ও নৌকায় উঠে বসলেন। নৌকা মোট পাঁচ খানা। একসঙ্গে সবাই পৌঁছালো নদীর অপর প্রান্তে। নৌকা থেকে নামিয়ে আবারও সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বলা হলো যে, আমরা এখন সবাই চিলমারী থানার বনগ্রাম খেয়া ঘাটে এসে পৌঁছে গেছি। আমরা একটা নতুন উদ্দেশ্যে এপারে এলাম। ৫টি নৌকায় ৫ টি প্লাটুন। প্রতিটি প্লাটুনের জন্য একটি করে পাক সেনার ক্যাম্প বরাদ্দ রয়েছে। বরাদ্দকৃত ক্যাম্পসমূহে এখন আমরা অপারেশন করবো। সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে প্লাটুন কমান্ডারের সঙ্গে যথা সময়ে গন্তব্য স্থলে পৌঁছবেন। হুঁশিয়ার! এটা সকলের রণাঙ্গন। এসব উপদেশ দিয়ে সবাইকে বিদায় করলেন অফিসারবর্গ। গোলাম মোস্তফা সাহেবের দলপতি বা প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন মো. নজরুল ইসলাম, মো. আবদুস সাত্তার ও মাহবুবুল আলম চন্ডুল। তাদের কমান্ডে দলটি গিয়ে রাজারভিটা মাদ্রাসা ক্যাম্প ঘেরাও করলো। এভাবে সব দলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সব দল নিজ নিজ গন্তব্য ক্যাম্পে যথা সময়ে হাজির হয়েছিল। তারপর সংকেত আকাশে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচটি নির্ধারিত ক্যাম্প একসঙ্গেই আক্রমন করা হলো। এতে চিলমারী (লাইনের মাথা) ও রাজারভিটা ক্যাম্প ব্যতীত তিনটি ক্যাম্প সহজেই দখল হয়েছিল। রাজারভিটা ক্যাম্পটিও পরের দিন সকাল ১০ ঘটিকায় সম্পূর্ণভাবে দখলে এসেছিল। কিন্তু চিলমারি লাইনের মাথার ক্যাম্প দখল করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। খবরা খবর ও যোগাযোগের অভাবে রাজার ভিটা মাদ্রাসার দলটি ২ দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থা করে। এ অপারেশনের পর পরবর্তী সময়ে উক্ত এলাকায় এদেরকে সেকশন ওয়ারী বিভিন্ন মহল্লায় ডিফেন্সে রাখা হয়। এ সময় বীর সৈনিকদের মধ্যে ওবাইদুল হককে উক্ত প্লাটুনের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরেরদিন সকালে খবর পেয়ে গোলাম মোস্তফা সরকারের বৃদ্ধ পিতা তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। পিতা-পুত্রের চোখাচোখি হলেও কথা বলার কোন সুযোগ ঘটেনি। এমন সময় বাহক এসে খবর দিলো এখানে আর এক মুহূর্ত আপনাদের থাকা ঠিক হবেনা কারন পাক সেনারা ট্রেন যোগে সামনে এসে গেছেন। সত্যি ক্যাম্প থেকে ট্রেন দেখা মাত্রই কমান্ডারের হুকুমে সবাইকে পিছু হটতে বাধ্য হতে হলো। তখন সকাল ১০ ঘটিকা। সবাই প্রানের ভয়ে ছুটতে শুরু করলো। নিরাপদ এলাকা বনগ্রামে ছুটে পালিয়ে গেলো মুক্তিযোদ্ধার দলটি। এলাকার জনসাধারণ প্রাণ রক্ষার জন্য অজানার দিকে ছুটে চলল। এমন হইচই পরিবেশে আর সম্ভব হলো না পিতা পুত্রের সাক্ষাত ও কথা বলা। জানা হলো না বাবা মা ভাই বোন ও অন্যদের কুশলাদি। দুঃখে ক্ষোভে ওনার বাবা নিরাশ হয়ে কত দূর পথ অতিক্রম করে কত কষ্ট করে ,কিভাবে কখন,আশ্রয় স্থলে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি তা জানেন না। তার দলটি আরো ২ দিন পর ফিরে গিয়েছিলো রৌমারী ক্যাম্পে। পৌঁছামাত্র আবার তাদের দলটিকে মার্চ করানো হলো সেই শত্রুঘেরা এলাকা ফকিরের হাটে। সেখানে এনে ওনাদের ডিফেন্স এ লাগান হলো। সেই দিন থেকেই ওনাদের দল শত্রু এলাকায় অবস্থান করে। রাতারাতি শত্রুর ঘাটির ওপর চোরাগুপ্তা আক্রমণ শুরু করলেন। তখন থেকে ওনারা রানীগঞ্জের নাপিতপাড়ায় পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে তাদের কে হটিয়ে দলেন। তারা দিনের পর দিন ধরে রাজারভিটা, লাইনের মাথা থানাহাট বাজার বালাবাড়ির হাট রেলওয়ে স্টেশনের ২ পাশে ব্রিজের ওপর তিনতি ফাঁড়ি, তবকপুর রেল ঘুণ্টি ফাঁড়ি, উলিপুর ডাকবাংলো ও রেল স্টেশনের ঘাটি গুলো পর্যায়ক্রমে আক্রমণ করা শুরু করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় ছিল অনন্তপুরের গনহত্যা, যে ঘটনায় পাক সেনাদের সাঁজোয়া বাহিনীর আক্রমষে প্রান হারিয়েছিল এলাকার নিরীহ সাত শত এর ও অনেক বেশি মানুষ। তাদের দল ও আরও ২টি দলের যৌথ অভিযানের ফলে সেখান থেকে পাক সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এছাড়া ছোট বড় বহু যুদ্ধ ঘটে এই এলাকায়। জনাব আবুল কাশেম চাঁদের কোম্পানির জোয়ানদের প্রতিবন্ধকতার ফলে এ এলাকা থেকে পাক হানাদার রা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফলে উল্লেখিত কম হারে এ এলাকার মানুষ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। তারপর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের মধ্য রাতে পাক বাহিনীর সেনাধীনায়ক নিয়াজি খানের নির্দেশে এই এলাকা থেকে পাক সেনারা রাতারাতি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তবুও এলাকায় কিছু রাজাকার আলবদর আল শামস বাহিনীর সদস্য সক্রিয়ভাবে আত্মসমর্পণ করতে অসম্মতি জানালে তাদের শক্তি প্রয়োগ করে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়। বিজয় অর্জিত হবার পর সর্বপ্রথম এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর এ দলটিকে থানাহাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থান দেয়া হয়। কিছুদিন পর এদের গাইবান্দা ও কুড়িগ্রামের মালয়শিয়া ক্যাম্পে রাখার পর সাধারণ সিপাহীদের ছাড়পত্র প্রদান করে ছেড়ে দেয়া হয়। অফিসার পদের সবাইকে ১১ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ময়মনসিংহ থেকে ছাড়পত্রসহ বিদায় দেয়া হয়। গোলাম মোস্তফা সরকার গাইবান্দা হেড কোয়ার্টার থেকে ছাড়পত্র নিয়ে মাতৃকোলে ফিরে আসেন। কিছুদিন পর মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানী কতৃক প্রদত্ত মুক্তিযোদ্দা সনদপত্র লাভ করেন। কেটে গেল ১৯৭১ সাল। জন্ম নিল বাংলাদেশ। পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ থেকে সরে গেল কাল বৈশাখীর ঘন কাল মেঘ। অর্জিত হল কাঙ্ক্ষিত নতুন স্বাধীনতা। স্বজন হারানোর ব্যথা, সম্পদ হারানোর ক্ষোভ, রক্ত মাখা দেশের মাটি, ঝিঝি পোকার থেমে যাওয়া নিস্তব্দতা নিয়ে শুরু হলো এদেশের সব মানুষের পথযাত্রা। নব গঠিত সরকার ধ্বংসস্তূপকে সরিয়ে সাজাতে শুরু করেন প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড। মার্চ ১৯৭২ সাল। নব গঠিত সরকার ঘোষণা দিলেন যে আগামী এপ্রিল মাসে ১৯৭১ ইং শিক্ষাবর্ষের বাতিলকৃত পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হবে। আগের ফরম পূরণের রেকোর্ডের মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে। নতুন করে ফরম পূরণের প্রয়োজন হবে না। সেই পরীক্ষায় চর্চা ছাড়াই অংশগ্রহণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা সরকার ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পারিবারিক দৈন্যতার কারণে তিনি আর সামনে অগ্রসর হতে পারেননি। তবে তিনি উচ্চ মাধ্যমিকের কোর্স উলিপুর কলেজ থেকে করেছিল, কিন্তু পরীক্ষা দিতে পারেননি আর্থিক কারনে। এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ না করে তিনি গিয়ে ভর্তি হন কুড়িগ্রাম শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৭৪-৭৫ শিক্ষা বর্ষে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এতটুকু তার শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিধি। ছাত্রজীবন থেকে সব বিষয়ে ভালোভাবেই লেখাপড়া করেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি আর্থিক অনটনের কারণে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। ভাগ্যের সিঁড়িতে বাধা পর বাধার মুখোমুখি হন গোলাম মোস্তফা। সাময়িক অভাব মুছতে তার ও অবিভাবকদের মতে চাকরির চুক্তিতে এক অশিক্ষিত মহিলাকে বিবাহ করতে বাধ্য হন। ১৯৭৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পার্শ্ববর্তী উপজেলা চিলমারীর বজরা তবকপুর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে তার বিবাহ হয়। স্ত্রীর নাম মোছা. হামিদা বানু (রেণু)। পরে ১৯৭৬ সালের ২৫ মে তখন কার বৃহত্তর রংপুর জেলার পাটগ্রাম উপজেলার জগতবেড় ইউনিয়নের জগতবেড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। দীর্ঘ ছয় বছর সেখানে কৃতীত্বের সঙ্গে শিক্ষকতা করেন। ১৯৮১ সালের ৩১ ডিসেম্বর বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারি উপজেলার বকবান্ধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলী প্রাপ্ত হয়ে চাকরিতে যোগ দান করেন। ১৯৮২ সালে জুন মাসের ৪ তারিখে পার্শ্ববর্তী চিলমারী উপজেলার রমনা ২ নং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ২৯ আগস্ট ১৯৮৩ সালে একই উপজেলার কাঁচকোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ১০ জুলাই ১৯৮৪ সালে রাজারভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলী প্রাপ্ত হয়ে প্রশংসিতভাবে চাকরি করেন। বজরা তবকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৯ ডিসেম্বর বদলির হন। পরে অষ্টমীর চরের কালীকাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ওখান থেকে নটারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সর্বশেষ খেদাইমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর নেন। তার বাবা ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বাবার মৃত্যুর এক বছর পরেই তিন ভাই মিলে পৃথক পৃথক সংসার শুরু করেন। সংসার জীবনে তিন মেয়ে দুই ছেলে জনক তিনি। বড় মেয়ে কিন্তু অভাব অনটন তার পিছু ছাড়েনি। জীবনে নেমে আসে দরিদ্রের অমাবস্যা। লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক |