শিরোনাম: |
রোগীর ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধের মাত্রা
|
হোসাইন মুবারক : ‘একজন রোগীর পিঠব্যথা। ডাক্তারের কাছে গেলেন। বহু পরীক্ষার পর ডাক্তার রোগীকে ছয়টি ওষুধ দিলেন। উপশম না হওয়ায় দ্বিতীয় ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন রোগী। দ্বিতীয় ডাক্তার আগেরগুলোসহ আরও ১১টি ওষুধ লিখে দিলেন। মোট ১৭টি ওষুধ দুই মাস ব্যবহার করলেন রোগী। এরপরও কোনো উন্নতি না হওয়ায় অবসাদগ্রস্ত হয়ে ওই রোগী বিদেশি ডাক্তারের কাছে গেলেন। এবার বিদেশি ডাক্তার ওই ১৭টি বাদ দিয়ে একটি ওষুধ দিলেন।’ গল্পের মতো এ ঘটনাটি উঠে এসেছে ১০ জানুয়ারি যায়যায়দিনের এক সংবাদে। প্রকাশিত সংবাদের এই ঘটনাটি সমাজের আরও পাঁচজন রোগীর মতো বিচ্ছিন্ন কোনো অনুগল্প নয়। এমন অহরহ ঘটনা রয়েছে আমাদের চারপাশে। ওষুধের অতিরিক্ত প্রয়োগ নানা কারণেই হচ্ছে।
চিকিত্সাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে রোগীদের অপ্রয়োজনীয় এবং দামি ওষুধ দেয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। অনেক সময় কম খরচে রোগ নিরাময়ের উপায় থাকলেও রোগীর ওপর বাড়তি খরচ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। দুই ডাক্তার যেমন দামি ওষুধ লিখেছেন তেমন বেশি ওষুধও লিখেছেন। বলা যায়, সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে না পারার কারণে ওষুধের প্রয়োগ করা হয়েছে বেশি। খবরের ভেতরের অংশে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ যেটা অপব্যবহার হয়, সেটা হচ্ছে ভিটামিন এবং এন্টিবায়োটিক। চিকিত্সকরা একটি এন্টিবায়োটিক দিয়ে যখন নিশ্চিত হতে পারেন না যে, এতে রোগ নিরাময় হবে। ঠিক তখন একাধিক এন্টিবায়োটিক লিখে দেন। এটিও একটা বেশি ওষুধ লেখার প্রবণতা। রোগ নির্ণয় করা নির্ভুল হলে বেশি ওষুধ প্রয়োগের প্রবণতা কমার কথা। এখানে ডাক্তারদের জানার পরিধি ও বোঝার গভীরতার বিষয়টি চলে আসে। যেসব ডাক্তার বেশি মেধাবী তাদের চিকিত্সা প্রদানের যোগ্যতাও তত বেশি। মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের ব্যবহার সব ডাক্তারই যে করেন, তা কিন্তু বলা যাবে না; তবে আমাদের দেশে যে চিত্রটি আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তা এ থেকে মোটেই ব্যতিক্রম নয়। সঠিক মাত্রায় প্রয়োজনীয় ওষুধ অসুস্থ মানুষের বেঁচে ওঠার প্রধান উপকরণ। এই ওষুধ যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় তাহলে রোগী বেঁচে ওঠার চেয়ে আরও অসুস্থতার দিকে ধাবিত হবে- এটাই স্বাভাবিক। তারপরও আমাদের চারপাশে অসুস্থ মানুষ এ থেকে নিস্তার পাচ্ছে না। ওষুধ প্রয়োগ ও এর জটিলতা নিয়ে যায়যায়দিনে একই দিন দুটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ‘রোগীদের কি প্রয়োজনের বেশি ওষুধ দেয়া হচ্ছে?’ এ শিরোনামের পাশেই সাইড স্টোরি হিসেবে ছাপা হয়েছে- ‘প্রেসক্রিপশন যাতে পড়া যায় সেভাবে লেখার নির্দেশ।’ দুটি সংবাদই ওষুধ প্রয়োগের স্বাস্থ্য জটিলতার ঝুঁকি নিয়ে। ওষুধ প্রয়োগের কথা তো বলা হলো। এবার ও ওষুধের মান নিয়ে কথা বলা যাক। দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের মানের প্রশ্নে এগিয়েছে অনেক দূর। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে আমাদের ওষুধ রফতানি হচ্ছে। ওষুধের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উন্নত দেশের নাগরিকরা ব্যবহারের আগে এর মান নিয়ে অনেক যাচাই-বাছাই করে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেসব দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানিকৃত ওষুধের মান পরীক্ষার পর নাগরিকদের ব্যবহারের অনুমতি দেয়। আমাদের দেশের রফতানিযোগ্য ওষুধগুলো এভাবেই পরীক্ষার স্তর অতিক্রম করে এগিয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এ ক্ষেত্রে ওষুধের মানে আমরা বিভিন্ন দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছি। এবার ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজারের কথায় আসি। কিছু দিন আগে পত্রিকায় এসেছে ভেজাল ওষুধ বা নিম্নমানের ওষুধ উত্পাদনের জন্য কতিপয় ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে সরকারি অভিযানের খবর। শুধু তাই নয়, পত্রিকায় প্রায় দেখা যায়, ‘ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব’- এ জাতীয় সংবাদ। এসব সংবাদ এদেশীয় ওষুধশিল্পের আরেকটি বিপরীত চিত্র। আমাদের যেমন আছে আন্তর্জাতিক বাজারে মানসম্পন্ন রফতানিমুখী ওষুধ, তেমনই আছে গ্রামপর্যায়ে নিম্নমানের ওষুধের বাজার এবং সেই সঙ্গে আছে যথেচ্ছ ব্যবহার। দেশের মেডিকেল ও ক্লিনিকগুলোতে দেখা যায় বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভিড়। তারা ডাক্তারদের কর্ম-সময়ের মধ্যে নিজ কোম্পানির ওষুধের প্রচার চালান। উপহার হিসেবে রাইটিং প্যাড, স্যাম্পল ওষুধ, সুদৃশ্য কলম, চিত্তাকর্ষক পেপারওয়েটসহ বিভিন্ন সামগ্রী ডাক্তারদের উপঢৌকন দেন নিজস্ব কোম্পানির ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখার জন্য। এই চিরচেনা দৃশ্য নিত্যদিনের। অনেক সচেতন রোগীর কাছে এ দৃশ্য খুবই বিরক্তিকর। তারপরও এটা কোনো কোনো ডাক্তারের কাছে একটা সংস্কৃতির মতো হয়ে গেছে। চিকিত্সাঙ্গনে এর বিপরীত চিত্রও আছে। অনেক ডাক্তার আছেন, তারা আবার এর সরাসরি বিরোধী। তারা কোনো ওষুধ প্রতিনিধিকে চেম্বারে ঢুকতে দেন না। কোথাও আবার লেখা আছে, ‘ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের প্রবেশ নিষেধ’। যেসব ডাক্তার ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কদর করেন, তাদের বিরুদ্ধে আবার অতিরিক্ত ওষুধ লিখে ওই কোম্পানির ওষুধ বিক্রিতে প্রবাহ সৃষ্টি করার অভিযোগও কম নয়। গুরুতর অনৈতিক লেনদেনের বিস্তর অভিযোগও শোনা যায়। আর এই নিম্নমানের অতিরিক্ত ওষুধ লেখায় ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ রোগীরা। এ কারণে অনেক দেশে ওষুধের জেনোরিক নাম লেখার নিয়ম আছে, সরাসরি কোম্পানির দেয়া নাম নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও জেনোরিক নাম লেখার বিধান রয়েছে। এ নিয়ে ক’দিন আগে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছে। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত স্পষ্ট অক্ষরে পড়ার উপযোগী করে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধের নাম লেখার নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার নির্দেশ দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সার্কুলার জারি করতে বলা হয়েছে। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই জরুরি। এবার আর একটু ভেতরের কথায় আসা যাক। যারা গুটিকয়েক ওষুধের আইটেম তৈরি করে ওষুধ কোম্পানির যাত্রা শুরু করেন তাদের ও একটাই লক্ষ্য থাকে বড় কোম্পানি হওয়ার। এগুলোর কোনো কোনোটি ছোট থেকে বৃহত্তর কোম্পানির রূপ নেয়। আবার কেউবা চলে যায় তৃণমূলে। নিজেদের স্বল্পমান সম্পন্ন ওষুধ বাজারে চালানোর চেষ্টা করে বিভিন্ন অনৈতিক পন্থায়। শহরে-গ্রামে চলে এই প্রচেষ্টার অবিরাম ধারা। এবার আসা যাক ডাক্তারদের হাতের লেখা নিয়ে বিড়ম্বনার কথায়। অনেক ডাক্তার রোগীর জন্য যে ওষুধ লিখেন তা অনেক সময় ফার্মেসির কর্মীরা পড়তে পারেন না। এর ফলে ভুল ওষুধ চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেকে ভুল ওষুধ ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্তও হন। এছাড়া কোন ওষুধের মাত্রা কত? দিনে কোনটা কয়বার খেতে হবে, সেটাও অস্পষ্ট থাকে। এসব অস্পষ্টতার কারণে রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয় বেশি। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও কোনো কোনো বড় মাপের ডাক্তার সহকারী রাখেন ব্যবস্থাপত্র স্পষ্ট করে লেখার জন্য। আবার অনেক সেরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিককে কম্পিউটারের মাধ্যমে কম্পোজ করে ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়। এ বিষয়ে সরকারি নিদের্শনা থাকলে রোগীরা আরেকটি ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেত। মোট কথা, ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রভাবে অতিরিক্ত ওষুধ লেখা থেকে ডাক্তারদের বেরিয়ে আসতে হবে, ওষুধের জেনোরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করতে হবে, সর্বোপরি স্পষ্ট হাতের লেখা ব্যবস্থাপত্র চালু করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এসব সমস্যা যথাযথভাবে তদারকি করতে হবে। তাহলেই এ থেকে সাধারণ রোগীরা মুক্তি পাবে। লেখক: কলাম লেখক |