শিরোনাম: |
পাঠ্যপুস্তকে ভুল আর তথ্যবিভ্রাটের সঙ্গে জড়িতদের ছাড় নয়
|
বিপুল উত্সাহ আর সীমাহীন আনন্দের সঙ্গে পহেলা জানুয়ারি দেশব্যাপী পাঠ্যপুস্তক উত্সব বাংলাদেশের একটি নতুন শিক্ষা-সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। এই সংস্কৃতির উদ্ভাবক হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের শুরু করা এই বই উত্সব আজ পুরো বিশ্বের কাছে অসাধারণ একটি উদ্যোগ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার বিষয়ে সরকারের উদারনীতির কথাই প্রকাশিত হয়। গত কয়েকবছর এ ক্ষেত্রে কোনো বিতর্ক ও সমালোচনা দেখা না গেলেও এবার সেই পাঠ্যবইয়ে ভুলের ছড়াছড়ি ও অসংখ্য তথ্যবিভ্রাট লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া পাঠ্যপুস্তককে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে নানা আঙ্গিকে। পাঠ্যপুস্তক কেলেঙ্কারি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে দেখা দিয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। পাঠ্যপুস্তকে বানান ভুল বা তথ্যবিভ্রাট হতে পারে সংশ্লিষ্টদের অযোগ্যতা-অবহেলা, অব্যবস্থাপনা বা মনিটরিংয়ের অভাবের কারণে। কিন্তু পাঠ্যসূচির হঠাত্ পরিবর্তন পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এমনটি ভাবলে কি ভুল ভাবা হবে?
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন উন্নয়নের সরকার গত কয়েক বছর ধরে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দিয়ে নিজেদেরকেই ঋদ্ধ করছে। বিশ্বের আর কোথাও এমন নজির আছে বলে আমাদের জানা নেই। সেই অনন্য সফল অর্জনটি নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে তখন নানা ধরনের শঙ্কা মনের মাঝে ঘুরপাক খায়। প্রশ্ন জাগে সরকার বা প্রশাসনের ভেতরে থাকা মুখোশধারী সাম্প্রদায়িক শক্তি এ ধরনের একটি পরিস্থিতির জন্ম দিতে পরিকল্পিভাবে কাজটি করলো কি? অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে ওঠা একটি ঐতিহ্যবাহী দলকে সাম্প্রদায়িক তকমায় অভিহিত করার নতুন চক্রান্ত নয়তো এটি? ১ জানুয়ারি শিশুদের হাতে তুলে দেয়া পাঠ্যবইয়ে থাকা ভুল-ত্রুটি তুলে ধরে দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেসব রিপোর্টে বলা হয়েছে বইয়ের ছাপা অত্যন্ত নিম্নমানের। বিভিন্ন শ্রেণির ‘বাংলা’ এবং ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’সহ অন্যান্য পাঠ্যবইয়ে ভুলের ছড়াছড়ি। পাল্টে দেয়া হয়েছে অতি পরিচিত একটি কবিতার চরণও। একটি পাঠ্যবইয়ের শেষ মলাটে উপদেশবাণীতে ‘উড় হড়ঃ ঐঁত্ঃ ধহুনড়ফু-এর ক্ষেত্রে লেখা হয়েছে ‘উড় হড়ঃ যবধত্ঃ ধহুনড়ফু’। ভুল প্রকাশিত এই বাণীটির ঠিক উপরে আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বই বিতরণের একটি ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে ‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’। মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ে মুসলিমকরণ করতে গিয়ে বিভিন্ন গল্প-কবিতায় হিন্দু নাম বাদ দেয়া হয়েছে। মুখবন্ধ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে এনসিটিবির হিন্দু চেয়ারম্যানের নাম। সরকারের সবকিছু যখন ভালোভাবে চলছিল, যখন দেশ-বিদেশ থেকে সরকার নানা উত্সাহ ও স্বীকৃতি পাচ্ছিল তখন এমন একটি ঘটনা পুরো দেশেই সমালোচনার ঝড় তুলেছে। অনেকে মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনা অতি-উত্সাহী গোষ্ঠীর পরিকল্পিত কাজ। সেই গোষ্ঠীটি সরকারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বলেও শোনা যাচ্ছে। যদি তেমনটি হয় তাহলে তা অত্যন্ত বেদনার। এরই মাঝে এই ঘটনার সূত্র ধরে সরকার তথা আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সম্পর্কের কথা উঠেছে। বলা হচ্ছে, ২০১৩ সালে নতুন কারিকুলামে পাঠ্যবই দেয়ার পর হেফাজতে ইসলাম আন্দোলন করেছিল। ওই ঘটনার পর বিভিন্ন ক্লাসে ‘হিন্দু’ লেখক-কবিদের লেখা বাদ দিয়ে মুসলিম লেখক-কবির লেখা অন্তর্ভুক্ত করায় এবং ধর্মভিত্তিক পাঠ বাড়ানোর কারণে অনেকেই মনে করছেন হেফাজতে ইসলামের দাবির প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু প্রগতিশীল ধারার লোকজন এ কথাটি বিশ্বাস করতে পারছেন না। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করে আওয়ামী লীগ ধাপে ধাপে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে। দলটি ধর্মীয় তথা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে সম্পৃক্ত কোনো গোষ্ঠীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে কোমলমতি শিশুদের মননে ধর্মীয় চেতনা পাকাপোক্ত করার পদক্ষেপ নেবে সেটা কি হতে পারে? এ ঘটনায় দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এ ধরনের শিক্ষা শিশুকে মানসিকভাবে বিপন্ন করবে। পাঠ্যবইয়ে ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি রকম উপস্থাপনা শিশুদের ধর্মের প্রতি এমন এক ধরনের অন্ধ অনুরাগের সৃষ্টি করবে, যা ইতিবাচক নাও হতে পারে। আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যত্। তারা সুস্থ ও সুন্দর মানসিকতার মধ্য দিয়ে ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের মূল চেতনা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে এমনটিই সবার প্রত্যাশা। সেই শিশুদের যদি পাঠ্যপুস্তকে ভুল শেখানো হয়, ধর্মের নামে যদি ধর্মীয় চেতনায় গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয় তাহলে ধর্মীয় গোঁড়ামি তাদের মধ্যে জন্ম নিতে পারে। যা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশে পাঠ্যবই প্রণয়ন ও মুদ্রণ করে থাকে এনসিটিবি। প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সবল কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই বলে জানা যায়। দুজনের নাম থাকলেও তারা পুস্তক প্রণয়নে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেন না। অভিযোগ আছে পাঠ্যবই প্রণয়ন নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও রেষারেষি প্রকট। পাঠ্যবইয়ের কারিকুলাম তৈরি-রচনা ও মুদ্রণের মতো টেকনিক্যাল কাজের সঙ্গে অতীতে যাদের কোনো পরিচয়ই ছিল না এমন অনভিজ্ঞ কর্মকর্তারা পাঠ্যবই প্রকাশনা প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে কারণে ভুল ত্রুটি থেকে যায় পাঠ্যবইয়ে। নানা সূত্র জানায়, একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এনসিটিবি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠানটির কলকাঠি নাড়ে। তারা সেখানে পাঠ্যবই মুদ্রণের টেন্ডার, কাগজ ক্রয় আর বাণিজ্যিক খাতগুলোর দিকে যেমন নজর রেখেছে, তেমনি প্রতিষ্ঠানে থাকা কর্মকর্তারাও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। কে কারণে পাঠ্যক্রমের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এনসিটিবিতে ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানি মতাদর্শীরা সুকৌশলে এমন অপতত্রপতা চালাতে পারে। এসব অভিযোগ মোটেই সুখের নয়। এসব বিষয়ে যথাযথ তদন্ত করে সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিতে না পারলে সরকারকেই তার ফল বহন করতে হবে। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইগুলোর ভুল-ত্রুটি খুব দ্রুত সংশোধন করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। তিনি জানিয়েছেন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে এনসিটিবিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে পাঠ্যপুস্তকে ভুল-ভ্রান্তি তদন্তে একাধিক কমিটি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ওএসডি করা হয়েছে এনসিটিবির দুজন কর্মকর্তাকে। আশা করি সুষ্ঠু তদন্তে প্রকৃত কারণগুলো উঠে আসবে এবং সে অনুযায়ী দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতা ও ত্রুটিগুলো দূর করার উদ্যোগ নেয়া হবে। সেই সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে থাকা ভুলগুলো সংশোধন করে নতুন করে পুস্তক সরবরাহ করা হবে শিশুদের মাঝে। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ প্রক্রিয়ায় যোগ্য-দক্ষ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিতে হবে। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এ ঘটনায় ক্ষোভ ব্যক্ত করে বলেছেন, কবিতার লাইনে শব্দ ওলটপালটের এখতিয়ার এনসিটিবিকে কে দিয়েছে? তার প্রশ্ন মাত্র তিন বছরের মাথায় পাঠ্যবইয়ে কবি-লেখকদের লেখা সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন কেন পড়ল? হিন্দু নাম মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ে কেন রাখা যাবে না? তাহলে কী কেউ অসুস্থ হলে হিন্দু ডাক্তারের কাছে যাবে না? তবে তিনি মহানবীর বিদায় হজের ভাষণ পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এতে যে মানবিকতা আছে তা শিশুদের জানা প্রয়োজন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদাকে চৌধুরী বলেন, কিছু লোকের এমন কাজের কারণে সরকারের ভালো অর্জনগুলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বই পৌঁছে দেয়াটা বর্তমান সরকারের এক ঐতিহাসিক সাফল্য। এ সরকারের জনকল্যাণমূলক একটি বড় কাজ। শুধু বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেয়াই নয়, সে বই যাতে নির্ভুল ও সুসম্পাদিত হয় সে দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। নতুবা পুরো প্রক্রিয়াটি গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। যা সরকারকের উদ্যোগকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। সরকারের এই মহত্ কাজে কারা কি উদ্দেশ্যে বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস চালালো তা সুস্পষ্টভাবে জেনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াই সরকারের জন্য ভালো হবে। কোনোভাবেই এই চক্রের কাউকে ছাড় দেয়া চলবে না। লেখক: উপ-সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান। |