শিরোনাম: |
সাহসী নারীর গল্প!
|
সাহসী হতে হলে ঠিক কী কী করতে হয় একজন মানুষকে? কতটা বেশি ঝুঁকির মুখোমুখি হলে কোনো একজন মানুষকে সাহসী বলবেন আপনি? আপনার দৃষ্টিতে সাহসের সংজ্ঞা যেটাই হোক না কেন, এমন কিছু সাহসী নারীর গল্প আজ আপনাদের বলব যাদের শুধু আপনি বা আমি নই- সবার চোখেই তারা সাহসী নারী! চলুন পড়ে আসি অসম্ভব সাহসী হতে পারা সেই মানুষগুলোকে-
উইলি স্টেক: হঠাত্ একদিন একজন মানুষ কোথা থেকে এসে বলতে শুরু করল সে নাকি অন্নপূর্ণায় উঠেছে। অন্নপূর্ণা মানে অন্নপূর্ণা পাহাড়ে। বরফ শীতল সেই পাহাড়ে সে একা উঠেছে। তাও আবার সাধারণ আর সব পাহাড় চড়ুয়েদের মতো নির্দিষ্ট পথ ধরে নয়। সে পাহাড়টিতে চড়েছে এর দক্ষিণ দিক থেকে। যেখান থেকে পাহাড়ে উঠতে গিয়ে এর আগে মারা গেছেন অনেকে। ব্যর্থ হয়ে পিছিয়ে গেছেন। প্রথম প্রথম কেউ বিশ্বাসই করতে চাইলো না লোকটার কথা। পাগল না হলে মিথ্যুক! ভাবল সবাই। তবে সবাইকে চিন্তায় ফেলল লোকটির আগের পাহাড়ে চড়ার কিছু রেকর্ড। এর আগে সেই ২০০৭ সাল থেকে পরপর তিনবার অন্নপূর্ণার এদিক দিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু কখনো সঙ্গীর অসুস্থতা, কখনো পাহাড়ধস- এমন হাজারটা কারণে প্রতিবারই পিছিয়ে পড়েছে সে। হেরে যেতে বাধ্য হয়েছে। তবে এবার নাকি সে আর পেছায়নি। নিজের এতদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে জয় করেছে এমন বিপজ্জনক পাহাড় আর তার রাস্তাকে এক তুড়িতেই। একটা সময় সবাই বলল- কোনো প্রমাণ আছে তোমার কথার? প্রমাণ! সত্যিই তো। এইবার টনক নড়ল লোকটার। আসলেই তো তার হাতে কোনো প্রমাণ নেই। কেউ ছিল না এই অভিযাত্রায় তার সঙ্গী হয়ে। আবার বরফধসে হারিয়ে গেছে তার সাধের ক্যামেরাটাও। কিন্তু তাতে কি হয়েছে! বুক ফুলিয়ে বলল লোকটা সগর্বে- তোমাদের বিশ্বাস করার হলে করো না হয় করো না। লোকটার ভেতরে এতটা দৃঢ়তা দেখে আবশেষে একটা সময় সবাইই বুঝতে পারল ঠিক ঠিকই এই পাগল লোকটা অন্নপূর্ণা পাহাড় থেকে মরতে মরতে ফিরে এসেছে। আর এই পাগল পাগল লোকটার নাম হলো উইলি স্টেক। আপনার কি মনে হয় এভাবেই আপনি হিমালয় পর্বতও পেরোতে পারবেন? প্রশ্ন করা হয়েছিল উইলিকে। উইলির সোজাসাপ্টা জবাব- আন্নপূর্ণার মতন এমন সুযোগ একজন মানুষের জীবনে শুধু একবারই আসে। আমি সত্যিই জানি যে আমি আর এমন ধাঁচের অভিযাত্রা আর করতে চাই না। ওয়াসফিয়া নাজরীন : ছোট্টবেলায় সেই প্রথম কোনো সাদা চামড়ার মানুষ দেখেছিল মেয়েটি। শুধু বাবা-মাই নয়। তাদের সঙ্গে এসেছিল সাদা চামড়া এক ধবদবে ফর্সা মিষ্টি মেয়ে। যার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল তার। মেয়েটার হাতে ছিল একটা হোলা-হুপ। ওটা নিয়ে একটু খেলতেই পাশের বাসার খালা এসে মেয়েটিকে বলে গেল- এগুলো নিয়ে মেয়েরা খেলে না। দেখতে ভালো লাগে না। তখনই মেয়েটা খেলা বন্ধ করে দিয়েছিল। খেলনাটা তুলে দিয়েছিল বিদেশি মেয়েটির হাতে। সাদা চামড়ার মেয়েগুলোই বুঝি শুধু খেলতে পারে এই খেলনা দিয়ে! ভেবেছিল মেয়েটি। আর তারপর আরও কত না এলো জীবনে। বাইকে চড়ো না, খেলতে যেও না- কত ধরনের, কত জনের না। কিন্তু এই নায়ের শক্ত আবরণের ভেতরে থেকে থেকে যেন ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল মেয়েটির মন। আস্তে আস্তে নিজেকে বুঝতে শিখল মেয়েটি। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। ভাবল সে। পড়াশোনা শেষ করে যোগ দিল কেয়ার এ। পতিতালয়ের নারী ও বাচ্চাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আরও সব সুবিধা দিতে এগিয়ে এলো সে কেয়ারের মাধ্যমে। আর এ ক্ষেত্রে সাহায্য করল বিদেশি সাহায্য। সবকিছু বেশ ঠিকঠাকই চলছিল। পতিতালয়ের আঁধার ছাড়াও যে বাইরের জগতে বেঁচে থাকার কতগুলো রাস্তা আছে সেটা শিখে গিয়েছিল ওরা প্রায় সবাই। কিন্তু হুট করেই একটা বড় ধাক্কা লাগলো এই নতুন শেখায়। বিদেশি সাহায্য বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল পতিতালয়ের মানুষগুলোকে নিয়ে করা কাজ। এতদিন ধরে পতিতালয়ের বাইরে এসেছে বলে বেশ আড়চোখে দেখা হচ্ছিল এগিয়ে আসা নারী আর বাচ্চাদের। এবার সুযোগ পেয়ে সেই আড়চোখে আগুন জ্বলে উঠল। পতিতালয়ে ফিরে আসবার পর বঞ্চিত হতে শুরু করল তারা মানুষ হিসেবে আগের পাওয়া কিছু ছিটেফোঁটা সুবিধাও। আর এসবই লক্ষ্য করল সেইদিনের সেই মেয়ে ওয়াসফিয়া নাজরীন। মন ভেঙে গেল তার। সেদিনই ভাবল ওয়াসফিয়া। বাইরের সাহায্য আর কত। ওদের ওপর নির্ভরতা আর কতদিন? বেরিয়ে আসতে হবে এর থেকে। মনে ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ইচ্ছা পূরণ করতে যে অনেক টাকা লাগে! কি করা যায় এখন? নিজের লক্ষ্যকে অনেক ভাবনার পর ওয়াসফিয়া ভাগ করল দুইভাগে। পাহাড়ে চড়ার শখ তার বহুদিনের। আর তার সঙ্গে সবাইকে সাহায্য করার ইচ্ছাও এবার যোগ হলো। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে ধরল সেভেন সামিট ফাউন্ডেশনে। পাহাড়ে চড়া শুরু হলো মেয়েটির। প্রথমদিকে অতটা নজর না দেয়া হলেও এভারেস্ট জয়ের পরে বিশ্ব অবাক হয়ে তাকালো মেয়েটার দিকে। আর সবচাইতে অবাক ভাব জমে ছিল বাংলাদেশের চোখে। এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল বাংলাদেশের এই রত্নটি? বাংলাদেশের আশি শতাংশ মানুষই পাহাড় দেখেনি। প্রতিটি মহাদেশে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশিদের বিভিন্ন মহাদেশে নিয়ে যাওয়া। এটি তাদের অনেক গর্বিত করবে। বলেন ওয়াসফিয়া। তবে এর আবার আরেকটা দিকও বেরিয়ে এল। নানা কাজে এবার ধীরে ধীরে বেশ ভালো উপার্জন হতে লাগল ওয়াসফিয়ার। আর সেই থেকে সে শুরু করল তার দ্বিতীয় লক্ষ্যটি অর্জনের চেষ্টা। পতিতালয়ের মানুষগুলোকে নরক থেকে সুন্দর একটা জীবনে আসতে গড়ে উঠল ওসেল ফাউন্ডেশন। কবে থেকে এই পাহাড়ে চড়ার শুরু হলো জানতে চাওয়া হলে ওয়াসফিয়া জানান ২০০৮ সালে অলিম্পিক গেমসের বিরোধিতা করবার সময় বেশ কয়েকবার তাকে তিব্বত ও নেপালে ভ্রমণ করতে হয়। আর সেখান থেকেই তার পাহাড়ে চড়ার শুরু। নিজের ফাউন্ডেশন তৈরির মাধ্যমে নিজের ওপরে নেয়া ঝুঁকি সম্পর্কে ওয়াসফিয়া বলেন- আমার বেশ বড় কিছু ব্যাংক লোন আছে। আমি জানি না ঠিক কী করে এগুলোকে শোধ করব। যদি বাস্তবতাকে সামনে আনা হয় তাহলে এগুলো সম্পর্কে আমার বেশ চিন্তিত হবার কথা ছিল। কিন্তু আমার মস্তিষ্ক তা নয়। নিজের ছোটবেলার কথা মনে করে তিনি বলেন- আমি চাই না আর কোনো মেয়ে এমন অবস্থার ভেতর দিয়ে যাক। আর এখান থেকেই আমার পুরোটা শক্তি আসে। টমি কালডোয়েল : দক্ষিণ পাতাগোনিয়ার চিলি-আর্জেন্টিনা সীমান্তের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ কিলোমিটার লম্বা গ্রানাইট দাঁতের তৈরি পাহাড়টি। নাম তার ফিটজ রয় মেসিফ। পাহাড়টির গায়ে শুধু ধারালো দাঁত আছে তাই নয়। এর ধারে কাছে আসলেই সহ্য করতে হতে পারে হারিকেনের বাতাস বা তুষার ঝড়। তাই আর সব পাহাড়টির মতোন এই পাহাড়টিকে কাবু করা বেশ কষ্টকর ব্যাপার। তবে কষ্টসাধ্য বলেই হয়তো প্রতি বছরই পৃথিবীর সব ঝানু পাহাড় চড়ুয়ারা চেষ্টা করে যায় এখানে। পৃথিবীতে বিখ্যাত কিছু পাহাড় চড়ুয়ার নামের তালিকায় প্রথমেই হয়তো জায়গা করে নেবে টমি কাডওয়েল নামটি। ইয়োসোমাইটের ইআই ক্যাপিটানের মতন দুর্ধর্ষ জায়গাতেও যাওয়া হয়ে গেছে তার। তো একে একে অনেক পাহাড়কে ডিঙিয়ে এবার তার কেন যেন মনে হলো এই ফিটজ রয়কে কাবু করা যাক। ২০০৬ সালে প্রথম আসেন তিনি পাতাগোনিয়াতে। চারপাশটা দেখে তিনি ভাবেন ইয়োসোমাইটের পদ্ধতিটি এখানেও খাটানো যায় কি-না। অনেক হিসাব-নিকাশ করে বের করেন তিনি বিপদ হওয়ার সম্ভাবনাকে। মন ঠিক করেন ফিটজ রয়ে চড়ার। তবে সঙ্গে সঙ্গেই আগাননি টম। প্রথমেই একজন যোগ্য সঙ্গীকে খোঁজেন তিনি। বেশ ক’বছর ধরে খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল অ্যালেক্সকে। অ্যালেক্স হনোল্ড। ২০১৪ সালে অভিযান শুরু করেন তারা। আর জয় করেন যুদ্ধক্ষেত্র। আমার আর অ্যালেক্সের ভাবনা ছিল যতক্ষণ না পর্যন্ত খুব বেশি বিপজ্জনক কিছু সামনে আসছে ততক্ষণ থেমো না। বলেন টমি। ম্যাট স্টোকার, ট্র্যাভিস রুমেল ও বেন নাইট : হঠাত্ করে কি হলো কে জানে স্টোকারের মাথায় চাপল আমেরিকার ওয়াশিংটনে অবস্থিত সবচাইতে বড় দুটি বাঁধকে সরানো দরকার। আর সেটা করার জন্য দরকার বাঁধের ক্ষতিকর দিকগুলোকে নিয়ে সবাইকে সচেতন করা। কিন্তু কি করে? একটা ছবি বানানো যায় না এটার ওপরে? যেই ভাবা সেই কাজ! নির্মাতা রুমেল ও নাইটের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। আর তিনজনে এক হয়ে বানালেন ৮৭ মিনিটের একটি ছবি- ড্যামনেশন। আশি দিনে তৈরি হওয়া ছবিটি সম্পূর্ণ হতে সাড়ে তিন বছর লাগলেও এর কারণে আরেকটু হলে পুলিশে ধরে নিতে যাচ্ছিল রোমেল ও নাইটকে। ছোট্ট এই ছবিটি খুব সহজেই মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে বাইরে থেকে বাঁধ দেখতে সুন্দর হলেও এর কারণে নষ্ট হচ্ছে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ। ছবিতে তুলে ধরা হয় এলোয়াহ বাঁধ আর কনডিট বাঁধের কথা। খুব বেশিদিন নয়। ছবিটি নির্মাণের এক বছরের মাথাতেই উঠে যায় এলোয়াহ বাঁধ। দুই বছর আগেও এখানে বাঁধের কারণে মাছ সাঁতরাতে পারত না। আটকে থাকত। মাছের ছোটাছুটির আনন্দকে নিজের চোখে দেখার পর সেই আগের দিনের কথাই একবার মনে করেন স্টোকার। লুইস পাঘ : সেই মানব সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে দিনকে দিন মানুষ ক্ষতি করে এসেছে পৃথিবীর। কখনো জেনে, কখনো না জেনে। ধীরে ধীরে পৃথিবী, এর জল-স্থল আর বায়ুমণ্ডলকেও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে তারা। পৃথিবী কেঁদেছে, কোঁকড়ে গেছে কষ্টে। কিন্তু একবারও সেদিকে মনযোগ দেয়নি মানুষ। তবে একটা সময় পর এসে মানুষ বুঝতে পেরেছে নিজেদের ভুলগুলো। কিন্তু যতক্ষণে বুঝেছে ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন আর ইচ্ছে করলেও খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবীকে সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে সব মানুষের মনযোগ পেলে একটা সময় নিশ্চয়ই সেটা হবে। কিন্তু সেটা সব মানুষের মনযোগ পেলে তবেই। বায়ু আর স্থলের দিকে সবারই মনযোগ থাকে কম-বেশি। প্রতিদিনই নানা ঘটনা চোখে পড়ে সবার এগুলোকে নিয়ে। কিন্তু মানুষের যত্নের তালিকায় ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার জায়গাটাজুড়ে রয়েছে পৃথিবীর বিশাল সমুদ্র স্তর। নিত্যদিনের কাজে প্রয়োজন হয় না বিধায় সমুদ্রের দিকে মনযোগই নেই কারো! আর ঠিক তাই সমুদ্রের ভালো-মন্দ, মানুষের নিষ্ঠুরতার মুখে পড়ে বর্তমান সমুদ্রের অবস্থা আর কর্মকর্তাদের উদাসীনতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেই এগিয়ে এসেছেন সাঁতারু লুইস। টেলিভিশন অথবা খবরের কাগজ- সব জায়গাতেই প্রায়ই তার খবর থাকে। প্রতিদিনই সে সাঁতরে বেড়ায় নতুন নতুন পানিতে। আর তুলে ধরে সেগুলোর সত্যিকারের ছবি সবার কাছে। এ কাজের জন্যে প্রচণ্ড গরম পানিতে যেমন তাকে সেদ্ধ হতে হয়েছে, তেমনি হাতের আঙ্গুলের চামড়া ফাটাতে হয়েছে তীব্র ঠাণ্ডা পানিতে। তবু থেমে থাকেননি তিনি। আর তারই ফল হিসেবে এখন অনেক মানুষই সচেতন পরিবেশ পরিবর্তনের খারাপ প্রভাব সম্পর্কে। তারা সচেতন সরকারের দায়িত্ব ও তার পালন সম্পর্কে। সম্প্রতি আপ্রিকার আইনজীবী সম্প্রদায় সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন সমুদ্রে সংরক্ষিত এলাকা তিন শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ করা হোক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি সাঁতরে যাব। বলেন লুইস। |