রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
পাকিস্তানের কারাগারে ২৯০ দিনের দুঃসহ বন্দিজীবন
বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা ও আন্তর্জাতিক চাপে ফাঁসি দিতে সাহস পায়নি ইয়াহিয়া
Published : Monday, 9 January, 2017 at 6:00 AM, Count : 1766

রফিকুল ইসলাম রতন : প্রহসনের সামরিক বিচারের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোই ছিল প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার একমাত্র সংকল্প। পরিকল্পিতভাবে তার সব আয়োজনও সেরে রেখেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের লায়ালপুর কারাগারের অন্ধকার ছোট্ট প্রকোষ্ঠে বন্দি বঙ্গবন্ধুও প্রতি মুহূর্তেই মৃত্যুর প্রহর গুনেছেন। কামরার জানালার পাশে কবর খোঁড়া দেখে তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘আমার ফাঁসির পর তোমরা আমার লাশ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে আমার লোকদের কাছে পাঠিয়ে দিও।’ প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে সামরিক আদালত বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির রায়ও দিয়ে রেখেছিল। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মানসিকভাবে চরম অমানবিক নির্যাতনও করা হয় তাঁর ওপর।
কোথায় রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ ৯ মাস তা যেমন জানতে দেয়া হয়নি। যোগাযোগ ও সব খবর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখতে তেমনি কোনো পত্রিকা, বই বা রেডিও দেয়া হয়নি তাঁকে। কেউই কথা বলত না তাঁর সঙ্গে। এভাবে শত চেষ্টা ও পরিকল্পনা থাকার পরও বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্ব, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের চাপ, আমেরিকার নমনীয়তা, পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় এবং সর্বশেষ ভুট্টোর অনুরোধের কাছে নতি স্বীকার করে ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমার্পণ এবং পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার ক্ষমতাচ্যুতি এবং ভুট্টোর প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত হয়।   একাত্তরের ২৫ মার্চ পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সবাইকে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দিয়ে নিজ বাসায় অবস্থান করেন এই জন্য যে, তাকে না পেলে পাক হানাদার বাহিনী পুরো ঢাকা শহর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। যখন তিনি দেখলেন, রাতে পাক বাহিনী নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ভারি অস্ত্র, কামান নিয়ে হামলা করেছে তখন তিনি দিবাগত মধ্যরাতে ইপিআর ওয়্যারলেসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা পাক বাহিনীর বেতারে ধরা পড়ার পরপরই শীর্ষ মহলের নির্দেশে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পাক মেজর জহিরুল আলমের নেতৃত্বে রাত দেড়টার পর ট্যাঙ্ক, কামান, এপিসি ও বেশ কয়েকটি সজোয়া যানসহ বিশাল একটি সেনাদল তার ধানমন্ডি বাসা ঘেরাও করে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। বৃষ্টির মতো গুলি ও মর্টার সেলে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। পাক বাহিনীর ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের সময় বিপুলভাবে সশস্ত্র প্রতিরোধ করা হবে। কিন্তু যখন কোনো প্রতিরোধ হয়নি তখন পাক বাহিনী গুলি কমিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুও হয় মৃত্যু না হয় গ্রেফতার এই ব্যবস্থার জন্যই প্রস্তুত ছিলেন। তিনি আগে থেকেই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে অন্য বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলে শেখ কামালও ওই সময় বাসায় ছিলেন না। ছিলেন শুধু বেগম মুজিব, শেখ জামাল ও রাসেল। সেনা কমান্ডরা বাসার ভেতরে ঢুকেই হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা করেন, শেখ ইউ স্যুড কাম ডাউন। বঙ্গবন্ধু তাদের গুলি থামাতে বলে নিচে নেমে আসেন। মেজর বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।’ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেই এই মেজর ওয়্যারলেসে বার্তা পাঠায়, বিগবার্ড ইন দ্য কেজ।’ চিরাচরিত সাদা পাজামা পাঞ্জাবির ওপর কালো মুজিব কোট এবং হাতে পাইপ। সঙ্গে নেলেন একটি স্যুটকেস। কড়া সশস্ত্র পাহারায় টয়োটা ল্যান্ডক্রুজারে উঠিয়ে ওরা বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টে। তাদের ভয় ছিল বিষয়টি গোপন না রাখলে তাদের ওপর ভারতীয় হামলা হতে পারে। দু’দিন পর তাকে রাখা হয় নির্মিয়মান সংসদ ভবনে। অনেক জল্পনা-কল্পনার ৬ দিন পর বঙ্গবন্ধুকে শ্রীলঙ্কা হয়ে নিয়ে যাওয়া হয় করাচিতে। তখন পাক বাহিনীর ভয় ছিল খবরটি ফাঁস হলে ভারতীয় বিমানবাহিনী মধ্য আকাশে হামলা চালাতে পারে অথবা বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান ভারতে নামাতে বাধ্য করতে পারে। ওরা বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে গেলেও সমগ্র দেশের মুক্তিকামী লাখো কোটি মানুষ এবং সারা বিশ্বের বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নামেই জীবন জ্ঞান তুচ্ছ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ মাতৃকাকে হানাদার মুক্ত করেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে ২৬ মার্চ গ্রেফতার করে পাকিস্তানি সামরিক শাসক ২ এপ্রিল করাচি নিয়ে গেলেও তাঁর আর কোনো খবর কেউ পায়নি। তিনি বেঁচে আছেন না তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে, এ বিষয়ে সমগ্র বিশ্বই ছিল উত্কণ্ঠায়। ২ এপ্রিল সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি ইয়াহিয়া খানের কাছে চিঠি দিয়ে শেখ মুজিবের সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একইভাবে ইয়াহিয়াকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত, যুক্তরাজ্য, পশ্চিম জার্মানি, সুইডেন, হল্যান্ড, জাপান, যুগোশ্লাভিয়া, ইটালি, ফ্রান্স, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, তানজানিয়া, মালয়েশিয়া, মিসর, ইরাক, সিঙ্গাপুর, ঘানা, আফগানিস্তান এবং জাতিসংঘ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪টি দেশ সফর করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে সমর্থন আদায় করেন এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবকে মুক্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮ জন কংগ্রেস সদস্য এবং ১১ জন সিনেটর স্বাক্ষরিত একটি বার্তাও পাঠানো হয় পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে। একপর্যায়ে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রমিকো পাকিস্তানকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে বলেন যে, শেখ মুজিবের কিছু হলে তার খেসারত দিতে হবে পাকিস্তানকে। তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধেরও দাবি জানান। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ৩ আগস্ট প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান টেলিভিশনে এক সাক্ষাত্কারে বলেন যে, শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তার বিচার করা হবে। ৯ আগস্ট পাকিস্তান সরকার এক প্রেস নোটের মাধ্যমে জানায় যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার অভিযোগে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার হবে। পাকিস্তান সরকারের এই প্রেস নোটের বিরুদ্ধে সমগ্র বিশ্বেই তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং এই প্রহসনের বিচার বন্ধে উল্লেখিত দেশ এবং শতাধিক মানবাধিকার সংস্থা বিবৃতি দেয়।             
১১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার বিচার শুরু হয় একজন ব্রিগেডিয়ারের নেতৃত্বে। ২ জন কর্নেল, উইং কমান্ডার, নেভাল কমোডোর ও একজন জেলা জজের সমন্বয়ে গঠিত ছিল এই সামরিক আদালত। সামরিক এই আদালত নির্দেশিত হয়ে এক তরফাভাবে  ফাঁসির রায় প্রদান করে ৪ ডিসেম্বর। পরে তারা এই রায় সামরিক সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পাকিস্তান সামরিক সরকারের জেনারেলদের সভাতেও বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি এই রায় কার্যকর করার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে নেন। গোপনে ফাঁসি কার্যকর করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে ৮ ডিসেম্বর লায়ালপুর জেল থেকে হেলিকপ্টারে করে রাওয়ালপিন্ডির মিয়ানওয়ালি জেলে স্থানান্তরও করা হয়। এখানে আনার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তিন তিনবার ফাঁসি কার্যকর ও কবর খোঁড়ার নির্দেশ দিলেও তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনুরোধে তা আবার স্থগিত করেন। কারণ ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার্থে জাতিসংঘ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতসহ বিশ্বের অসংখ্য রাষ্ট্রপ্রধান এবং মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়া দেখে এ অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এ প্রেক্ষিতেই ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে একজন সামরিক ব্যক্তিও জীবিত অবস্থায় ফিরে আনা সম্ভব হবে না। আর পাকিস্তান হয়ে পড়বে ‘আন্তর্জাতিক শত্রু রাষ্ট্র।’ ভুট্টোর অনুরোধে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলেও ইয়াহিয়া অতি গোপনে যে কোনো মুহূর্তে ফাঁসি বা হত্যার সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিলেন।
১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় জেনারেল নিয়াজিকে যখন মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে আত্মসমার্পণের প্রস্তাব দেয়া হয়, তখনও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মদ্যপ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার স্বপ্নে বিভোর। মিয়ানওয়ালি জেলের সুপার চৌধুরী নাসেরকে গোপনে ইয়াহিয়া খবর পাঠালেন যে, ‘একটি টেলিগ্রাম পেলেই ঝুলিয়ে দিবে। কাক পক্ষিও টের পাবে না।’ এর মধ্যে দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে গোটা পরিস্থতি। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমার্পণের মধ্যদিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলেও ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির ব্যাপারে ছিলেন অনড়। কিন্তু ২০ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার গদি উল্টে যায়। ভুট্টোপন্থি সামরিক কমান্ডোরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ইয়াহিয়াকে বন্দি করে এবং ভুট্টোকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। ২০ ডিসেম্বর একজন সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে অতিগোপনে রাত ৩টায় একটি ট্রাকে করে জেল থেকে বাইরে নিয়ে একটি বাংলোয় নিয়ে রাখেন। এ সময় সবই ছিল ধোঁয়াশা। বঙ্গবন্ধুও ছিলেন অন্ধকারে। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ক্ষমতার পালাবদল, ইয়াহিয়া বন্দি, সামিরিক অভ্যুত্থানে ভুট্টোর প্রেসিডেন্ট হওয়া- এসবের কিছুই জানতে পারেনি বঙ্গবন্ধু। কোনোরকম সামরিক প্রহরা ছাড়া এই বাংলোয় দু’দিন থাকার পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি কলোনি এলাকায়। সেখানে রাখা হয় আরও ৪ দিন। ২৬ ডিসেম্বর একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির বাইরে ইসলামাবাদের কাছে একটি সাধারণ বাংলোতে নিয়ে রাখা হয় তাঁকে। ২৭ ডিসেম্বর সশস্ত্র প্রহরীসহ জুলফিকার আলী ভুট্টো দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই বাংলোতেই দেখা করেন। তিনিই জানান পাকিস্তানের ক্ষমতা পরিবর্তনের কথা। ভুট্টো বলেন, ‘আমি এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ইয়াহিয়া বন্দি।’ বঙ্গবন্ধু প্রথমেই ভুট্টোর কাছে জানতে চান, ‘আমি এখন মুক্ত কিনা। এটা জানার পর আমি আপনার সঙ্গে কথা বলব, অন্যথায় নয়।’ জবাবে ভুট্টো বলেন, ‘শেখ মুজিব, আপনি এখন মুক্ত। আপনি  যেখানে খুশি চলে যেতে পারেন।’ এরপরও বঙ্গবন্ধু তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলেন না। অতি সতর্কতার সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। ভুট্টো জানালেন, ড. কামাল হোসেনও বন্দি অবস্থায় রয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ব্যবস্থার অনুরোধ জানালেন। দু’দিন পর প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন দেখা করতে এলেন, তখন ড. কামালকেও সেখানে নিয়ে আসা হয়। এ সাক্ষাতে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের প্রতিশ্রুতি ও চুক্তি করতে চেয়েছিলন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণের সঙ্গে কথা না বলে, পার্টির সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো কথা দিতে পারব না। আগে আমাকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করুন, তারপর দেখা যাবে।’ বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা, আন্তর্জাতিক চাপ ও বিশ্বে জনমত এবং পূর্ব পাকিস্তানে বন্দি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ স্বাধীনের ২১ দিন পর ৭ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সব ব্যবস্থাই করেন অতি গোপনে। ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়, পাকিস্তান বিমান সংস্থার একটি ৭০৭ বোয়িং এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরীর নেতৃত্বে ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে অবস্থান করছে। রাত ২টায় ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সাধারণ নিরাপত্তায় ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে পৌঁছলেন এবং কাক-পক্ষিও টের পাওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধুকে বিমানে তুলে দিয়ে বিদায় নিলেন। বিমানে উঠলেন ড. কামাল হোসেনও। পাইলট এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর কাছে পরিচয় দিতেই বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন, আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাইলট জানালেন লন্ডন। ৮ জানুয়ারি ভোর ৬টা ৩৬ মিনিটে বোয়িংটি যখন লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে ঠিক তার আগের মুহূর্তে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে জানানো হয় বঙ্গবন্ধুর কথা। খবর পেয়েই ব্রিটিশ বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ দ্রুত সেটি জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খবরটি জানার সঙ্গে সঙ্গে তা জানিয়ে দেন ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দফতরকে। বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে নিয়ে যাওয়া হয় ভিভিআইপি টার্মিনালের বিশেষ কক্ষে। তাঁকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা সরকারের পক্ষ থেকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু কথা বলেন, ঢাকায় স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ও পুত্রকন্যাদের সঙ্গে। তিনি প্রথমেই জানতে চান, আমার স্বাধীন দেশের মানুষ কেমন আছে। বঙ্গবন্ধুকে ফোন করে মুক্তির শুভেচ্ছা জানান ভারতের প্রধানমস্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। মিসেস গান্ধী বঙ্গবন্ধুর জন্য বিশেষ বিমান পাঠানোরও আগ্রহ জানালেন। ঢাকায় ফেরার পথে দিল্লিতে যাত্রা বিরতি করার জন্যও অনুরোধ জানালেন ইন্দিরা গান্ধী। বঙ্গবন্ধুকে রাজকীয় বাহিনীর গার্ড দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখানে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি স্থগিত করে অধীর অপেক্ষায় ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। মি. হিথ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উষ্ণ করমর্দন করে সম্বোধন করেন মি. প্রেসিডেন্ট হিসাবে। দু’নেতা কথা বলেন প্রায় এক ঘণ্টা।
বঙ্গবন্ধুকে জানানো হলে ব্রিটিশ রাজকীয় একটি বিমানে করেই তিনি ঢাকায় ফিরছেন। এরপর সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশে ফেরার পথে ১০ জানুয়ারি সকালে নয়াদিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি করেন বঙ্গবন্ধু। পালাম বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষের উত্ফুল্ল জয়ধ্বনির মধ্যে রাষ্ট্রপতি ভিপি গিরি তাকে স্বাগত জানান। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীন বাংলাদেশের এই নেতাকে বিশ্ব নেতা বলে সম্বোধন করে বক্তব্য রাখেন। বঙ্গবন্ধুও জনতার সম্ভাষণের জবাব দিয়ে আবেগ আপ্লুত ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী সাদা রঙের ব্রিটিশ কমেট রাজকীয় বিমানটি যখন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মাটি স্পর্শ করে তখন সময় দুপুর ১টা ৪৫ মিনিট। (নিবন্ধটি পাকিস্তানি লেখক সাংবাদিক আহমেদ সালিমের শেখ মুজিবের বন্দিজীবন ও বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইনের দ্য টর্চার্ড অ্যান্ড দ্য ডামনড এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল গ্রন্থের তথ্যের ভিত্তিতে রচিত)



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft