শিরোনাম: |
মহানায়কের প্রত্যাবর্তন দিন আজ
|
স্বপন কুমার সাহা : ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। এ দিনটি ছিল বাঙালি জাতির চূড়ান্ত মুক্তির দিন। এ দিন উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা থেকে মুক্তি পায় ৭ কোটি বাঙালি। জয়ী হয় মানবতার পক্ষের বিশ্বশক্তি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এ দিন ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। যে দিন থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের এক নতুন অভিযাত্রা। আজ সেই চেতনার দিন, প্রেরণার দিন, মহানায়কের প্রত্যাবর্তনের দিন। এ দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে বিভিন্ন দিক দিয়ে অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ।
২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২। এ দীর্ঘ সময় মৃত্যুপুরীতে ছিলেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ ৯ মাস তাকে থাকতে হয় পাকিস্তানের কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। এ সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয় তাকে। চলে বিশ্ব রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। শেখ মুজিবকে নিয়ে কী সিদ্ধান্তে নেয়া হবে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। প্রথমেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সংসদ ভবনে, এরপর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেখান থেকে নেয়া হয় করাচিতে। তবে এর মধ্যেও কম রাজনীতি ও জলঘোলা হয়নি। গ্রেফতারের পর তাকে নিয়ে কী করা হবে, সে বিষয়ে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, অতীব গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা বন্দি হওয়ায় গ্রেফতারের পর শেখ মুজিবকে নিয়ে দোটানায় ছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। তাদের ধারণা ছিল, কোনো বিদেশি রাষ্ট্র বিশেষ করে ভারত, তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। তাই তার অবস্থান গোপন রাখা হয়েছিল এবং এক জায়গায় রাখা হতো না তাকে। এমনকি তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা দুবার বাতিল করা হয়েছিল এই ভয় থেকে যে, খবরটা ভারতে পাচার হয়ে গেছে এবং মধ্য-আকাশে তাকে বহসকারী বিমান ধাওয়া করতে পারে ভারত। যা হোক, পরে করাচি হয়ে শেখ মুজিবকে নিয়ে যাওয়া হয় লায়ালপুর কারাগারে, যেটি বর্তমানে ফয়সালাবাদ সেন্ট্রাল জেল নামে পরিচিত। তবে ঠিক কত তারিখে তাকে ঢাকা থেকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। এ ব্যাপারে বিভিন্ন গবেষকের দাবি বিভিন্ন রকম। শামসুল হুদা চৌধুরি ‘মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর’ বইতে ২৯ মার্চের কথা বলেছেন। আবার রবার্ট পেইনের ‘ঞযব ঞড়ত্ঃঁত্বফ ধহফ ঞযব উধসহবফ’ বইয়ে ২৭ তারিখের কথা উল্লেখ করা হয়। এদিকে ১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে আসার পর শেখ মুজিবের একটি সাক্ষাত্কার নেন সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ। সাক্ষাত্কারে মুজিব যা বলেছেন সে হিসেবে, ২৫ মার্চ তাকে গ্রেফতার করার পর ছয় দিন তাকে ঢাকায় রাখা হয়। অর্থাত্ ১ এপ্রিল তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে। শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের পরপরই পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ মোটামুটিভাবে জানিয়ে দেয় যে, তাকে (শেখ মুজিব) বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ১৪ এপ্রিল তারিখে প্রকাশিত সিডনি শনবার্গের একটি প্রতিবেদনে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে ইয়াহিয়া খান প্রথম থেকেই শেখ মুজিবকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব-নিকাসে গ্রেফতারের শুরুর দিকে শেখ মুজিবকে হত্যা করতে না পারলেও এক্ষেত্রে সুপরিকল্পিত প্রহসনের বিচারের ছক কষে এগুতে থাকে পাকস্তানি শাসক গোষ্ঠী। অপরদিকে জুলাইয়ের দিকে শেখ মুজিবের বিচারের প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় ধরনের আলোড়ন তোলে। ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন শেখ মুজিবের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনে শক্তভাবে মাঠে নেমে পড়ে। অন্যদিকে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র একাট্টা হয় শেখ মুজিবের বিচারের পক্ষে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় বিচার কীভাবে হবে সে ব্যাপারে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া যায়। বিবিসির সূত্রে পত্রিকাটি জানায়, খুব শিগগিরই সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার হবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। ২২ জুলাই ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস জানায়, গোপন সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার হবে বলে বিভিন্ন মহল থেকে জানা গেছে। তবে এর মধ্যে নড়েচড়ে বসে বিশ্বের শান্তিকামী শক্তি। ২৯ জুলাই ভারতের লোকসভার সদস্য কুমারস্বামী কামারাজ জাতিসংঘের তত্কালীন মহাসচিব উ থান্টের কাছে শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে একটি চিঠি লেখেন। অন্যদিকে ৩ আগস্ট পাকিস্তানের সব টেলিভিশন স্টেশন থেকে প্রচারিত একটি সাক্ষাত্কারে ইয়াহিয়া জানান, বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার করা হবে। এরই প্রেক্ষিতে ৬ আগস্ট পাকিস্তানের জেলে বন্দি শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয় একটি সামরিক আদালতে। বিষয়টি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এবং ভারত সরকার উভয়ের জন্যই ছিল উদ্বেগের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। উপায়ান্তর না দেখে ১১ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে বার্তা পাঠিয়ে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির অনুরোধ জানান। তার বার্তাটি ছিল এ রকম- আমরা আশঙ্কা করছি, শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রাণদণ্ড দেয়ার অজুহাত হিসেবে তথাকথিত বিচারকে ব্যবহার করা হবে। এর ফলে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতির অবনতি হবে এবং ভারতে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর অনুভূতির কারণে ভারতেও এর চরম প্রতিক্রিয়া হবে। আমরা অনুরোধ করছি, এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার বৃহত্তর স্বার্থে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যেন একটি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন, সে জন্য আপনি তার ওপর আপনার প্রভাব খাটান।’ (বি জেড খসরু, মিথস অ্যান্ড ফ্যাক্টস: বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার) বাংলাদেশের পক্ষে দূতিয়ালি করার জন্য ইন্দিরা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চষে বেড়িয়েছেন। বাংলাদেশ প্রশ্নে একটি সম্মানজনক সমাধান এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য তিনি বিশ্বনেতাদের কাছে বহু দেনদরবার করেছেন। এরই মধ্যে নভেম্বরে তার ওয়াশিংটন সফর ঠিক হয়। মার্কিন প্রশাসনের মনোভাবে অবশ্য কোনো পরিবর্তন লাখ করা যায়নি। ইন্দিরা ও মুজিবের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা অধ্যাপক হেনরি কিসিঞ্জারের বিন্দুমাত্র আগ্রহ কিংবা শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। ৪ ও ৫ নভেম্বর নিক্সন-ইন্দিরা বৈঠক হয়। নিক্সনের মনোভাব ছিল শীতল। দ্বিতীয় দিন সকালের বৈঠকের আগে ইন্দিরাকে প্রায় ৪৫ মিনিট বসিয়ে রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য ইন্দিরা এ উপেক্ষা ও অপমান নীরবে হজম করেছিলেন। এর আগে ১৭ আগস্ট ইয়াহিয়ার কাছে চিঠি লিখে প্রতিবাদ জানায় ইন্টারন্যাশনাল জুরিস্ট কমিশন। ২০ আগস্ট ওয়ার্ড প্রেস কাউন্সিল এ বিচারের মাধ্যমে যে সম্ভাব্য দুর্যোগের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা এড়াতে পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ করে। এভাবেই চলতে থাকে মুজিবের পক্ষ-বিপক্ষের তত্পরতা। যা হোক, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ২৬৭ দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। তবে শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয়ে তখনো কোনো সুরাহা হয়নি। তাকে মুক্তি দেয়া হবে নাকি ফাঁসি দেয়া হবে, সেটা নিয়ে চলতে থাকে উভয়মুখী তত্পরতা। একদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষের শান্তিকামী শক্তি মুজিবের মুক্তির জন্য জোর দাবি জানাতে থাকে, অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে পাকিস্তান তাকে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পাঁয়তারা করতে থাকে। এদিকে এক পর্যায়ে লায়ালপুরের কারাগার থেকে এনে তাকে রাখা হয় রাওয়ালপিন্ডির মিয়ানওয়ালি কারাগারে। এরই মধ্যে ১৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের এক সরকারি মুখপাত্র মারফত জানা গেল মুজিবের বিচার শেষ হয়েছে, তবে রায় দেয়া হয়নি। সত্য হচ্ছে, ১৫ ডিসেম্বরই মুজিবের ফাঁসির আদেশ হয়ে যায়। এমনকি তার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল তার সেলের সামনে। ঠিক এমন সময় মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ আরও তীব্র হতে থাকে। এরই মধ্যে ইয়াহিয়া খান সরে গেছেন ক্ষমতা থেকে। নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তবে নাটক শেষ হয়নি। ২১ ডিসেম্বর ভুট্টো জানালেন- মুজিবের মুক্তি এখনই নয়। আগে জনমত যাচাই করা হবে। এরপর শেখ মুজিবকে কার্যত গৃহবন্দি করে রাখা হয় রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বাসভবনের লাগোয়া একটি বাড়িতে। বাইরের পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন তিনি। এরই মধ্যে ২৮ ডিসেম্বর ভুট্টো হঠাত্ মুজিবের সঙ্গে তার সদ্য সাক্ষাতের কথা জানিয়ে বলেন, আলোচনা চলছে। এবার বিষয়টি অতি নাটকীয়তার দিকে মোড় নেয়। বাংলাদেশ থেকে তাজউদ্দিন আহমেদ খুব পরিষ্কারভাবে ভুট্টোকে জানিয়ে দিলেন, বঙ্গবন্ধুকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। এদিকে পাকিস্তানেও মুজিবের পক্ষে সমর্থন বাড়তে থাকে। এর আগে নভেম্বরে ৫২ জন পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী মুজিবের মুক্তি চেয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। এবার দেশটির কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রও একই দাবি জানালো। এর মধ্যে ছিল ডন এবং জং এর মত পত্রিকা। এক পর্যায়ে যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদের পরম মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চরম শত্রু চীন মুজিবের মুক্তির পক্ষে অবস্থান নেয়। অবশেষে বিভিন্ন নাটকীয়তা ও আশঙ্কা-উত্কণ্ঠার পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পান। তখন খুব গোপনে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তান সরকার। বিমানটি লন্ডনের বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর নেমে বঙ্গবন্ধু ভিআইপি লাউঞ্জে আসলে তাকে স্বাগত জানান ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের উপস্থিত কয়েকজন কর্মকর্তা। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে ব্রিটিশ ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ার মাদারল্যান্ড উপস্থিত হয়ে জানান, ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ লন্ডনের বাইরে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ তাকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। লন্ডন থেকে ৯ জানুয়ারি স্বদেশে ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু রওনা হন। পথে দুই ঘণ্টা যাত্রাবিরতি করেন দিল্লিতে। ভারতের তত্কালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। অবশেষে আসে সেই স্বপ্নের ১০ জানুয়ারি। এদিন সকালে স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা রাখেন বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওইদিন সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরের রাস্তার দু’পাশে লাখো মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করেন তারা। দেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগে কেঁদে ফেলেন বঙ্গবন্ধু। বিমানবন্দরে অস্থায়ী সরকারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধাসহ সবাই অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের এ বরপুত্রকে। পরে বিমানবন্দরের বাইরে প্রাণের স্নিগ্ধ উষ্ণতায় তাকে বরণ করে নেয় আপেক্ষমাণ লাখো জনতা। সেদিন সবার চোখেমুখে ছিল অন্যরকম উত্তেজনা। ছিল স্বস্তি। বিমানবন্দর থেকে খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু। এ সময় ১৭ মিনিটের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন তিনি। তার ওই ভাষণ ছিল জাতির জন্য সার্বিক দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্র কাঠামো কেমন হবে, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যারা দালালি ও সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, সে বিষয়গুলো তুলে ধরেন তিনি। এছাড়া মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে, সেসব বিষয়ে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেন তিনি। একই ভাষণে তিনি ডাক দেন দেশ গড়ার সংগ্রামের। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত মন্ত্রমুগ্ধ জনতা দুই হাত তুলে সে সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বাঙালি জাতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থা ছিল অবিচল। স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি সেদিন রেসকোর্স ময়দানে বলেছিলেন, এ বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা, এ বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র, এ বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তিনি জনগণকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, আমি দেখায় দেবার চাই দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে। শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে। জাতির জনক মহান মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের সমর্থনকে অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করেন এ ভাষণে। পাশাপাশি তিনি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানান ভারত সরকার, সে দেশের জনগণ ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। কৃতজ্ঞতা জানান ব্রিটেন, জার্মান, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে। আবার বঙ্গবন্ধু মার্কিন জনগণকে ধন্যবাদ জানান। তবে সরকারকে নয়। সেই ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাখ লাখ অনুরাগীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের জনগণ ওই দিনই প্রাণভরে বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ উপভোগ করেন। আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হয়েছে। বাঙালি জাতির মহানায়ক আজ নেই। ঘাতকের বুলেটে সপরিবারে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে স্বাধীনতার মাত্র চার বছর পরেই। তবে বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন বাঙালি জাতির হূদয়ে। তিনি তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে যেতে পরেননি। তবে আজ এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। যে বাংলাদেশ বিশ্ব উন্নয়নের রোল মডেল। তবে সবকিছুর প্রেরণায় যিনি আছেন, তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান। |