বুধবার ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ১৪ কার্তিক ১৪৩১
গুলশান ডিসিসি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
নাশকতা না দুর্ঘটনা
Published : Tuesday, 3 January, 2017 at 6:00 AM, Count : 1249


হাজার কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাইব্যবসায়ীদের অভিযোগ ষড়যন্ত্র নাশকতাদুটি তদন্ত কমিটি গঠন বর্তমান প্রতিবেদক : গুলশান ডিসিসি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড নাশকতা না দুর্ঘটনা- এ প্রশ্ন এখন ব্যবসায়ীদের। সোমবার মধ্যরাতের আকস্মিক এ অগ্নিকাণ্ডে মার্কেটের দুই শতাধিক দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চোখের সামনে প্রায় হাজার কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত হওয়ায় পথে বসেছেন শত শত ব্যবসায়ী। কীভাবে আগুন ধরেছে, সমস্ত মার্কেটে এত দ্রুত আগুন কী করে ছড়িয়ে পড়ল, ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে কেনইবা ধসে পড়ল মার্কেটের দোতলার ছাদ, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিটের ১৫ ঘণ্টা সময় লাগল কেন- ঘুরে ফিরে এসব প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। ডিএনসিসির মেয়র আনিসুল হক এই অগ্নিকাণ্ডকে দুর্ঘটনা বললেও মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং মার্কেটের অধিকাংশ ব্যবসায়ী একে নাশকতাই বলছেন। অভিযোগ তদন্তে গঠন করা হয়েছে দুটি তদন্ত কমিটি।

তাত্ক্ষণিকভাবে এ অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তাই ব্যবসায়ীরা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে অগ্নিকাণ্ডের ফলে লুটপাট ঠেকাতে সড়কের প্রতিটি মোড়ে র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সতর্ক পাহারা ছিল। ঘটনাস্থল ও তার আশপাশে পাহারায় ছিল এপিবিএন সদস্য ও স্থানীয় প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ড। গত সোমবার রাত আড়াইটার দিকে এই মার্কেটে আগুন লাগে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। আগুন লাগার পর মার্কেটের একাংশ ধসে পড়েছে। এ সময় দমকল বাহিনী পানি সঙ্কটে পড়ে। তারা শেষ অবধি পার্শ্ববর্তী হাতিরঝিল থেকে পানি সংগ্রহ করেছে আগুন নেভানোর কাজে। এ সময় আগুনের বিষাক্ত ধোঁয়ায় মনে হচ্ছিল ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে রাজধানীর গুলশান-১ এর গোটা এলাকা। দেশের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা গুলশানের ডিসিসি মার্কেটের দাহ্য পদার্থ বা কেমিক্যাল পোড়ার বিষাক্ত ধোঁয়ার কুণ্ডলী এটি। শীতের খানিক কুয়াশা আর মার্কেট পোড়ার ধোঁয়া মিলে ভয়ঙ্কর এক ধোঁয়াশায় ঢাকছে গুলশান। দূর থেকে মিলছে পোড়া গন্ধও। ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করেছে। আগুন নেভাতে নৌবাহিনীও কাজ করেছে। দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টা পর গতকাল মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে  গুলশান ডিসিসি মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

এক সময় আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পাশের গুলশান শপিং কমপ্লেক্স নামে অভিজাত মার্কেট গ্রাস করে। দমকল বাহিনী ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় অভিযান চালিয়ে মার্কেটটি রক্ষা করতে সক্ষম হয়। এর আগেই ব্যবসায়ীরা দোকানের মালামাল সরিয়ে নেয়। আগুন লাগার পর মার্কেটের সিংহভাগ ধসে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের ভাষ্য, তারা রাতভর চেষ্টা করেও আগুন নেভাতে পারেনি। বরং আগুন ছড়িয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস জানায়, আগুন লাগার এক পর্যায়ে মার্কেটের কাঁচাবাজার অংশের ভবন ধসে পড়ে। এরপর একাধিকবার ধসের ঘটনা ঘটে।

আগুনের ঘটনায় গুলশান ১ নম্বর ও এর আশপাশের এলাকার সড়কে প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হয়। মালামাল সরানো এবং ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলাচলের জন্য গুলশান ১ নম্বর চত্বর থেকে শুটিং ক্লাব পর্যন্ত সড়কে সাধারণ যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

আগুন লাগার খবর পেয়ে রাতেই অনেক দোকান মালিক ও কর্মচারী ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কেউ কেউ তাদের ব্যবসায়িক ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সালাউদ্দিন নামের এক দোকান মালিক অভিযোগ করেন, ফায়ার সার্ভিস যথেষ্ট তত্পর না। তারা ধীরগতিতে কাজ করছে। তারা সক্রিয় থাকলে অনেক আগেই আগুন নেভানো সম্ভব হতো। ডিএনসিসি পাকা মার্কেট দোকান মালিক সমিতির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান অভিযোগ করেন, এই আগুন লাগার পেছনে ষড়যন্ত্র আছে।

ইতোমধ্যে আগুন লাগার কারণ জানতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ এ তথ্য জানিয়েছেন। ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এখনও মার্কেটের বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলছে। এক জায়গায় কিছুটা নিভলে অন্যদিকে জ্বলে উঠছে। পানি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে পানি আনতে সময় লাগছে। এসব কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে।’ তবে এ ঘটনার পেছনে নাশকতা দেখছেন না ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। তিনি বলেন, বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে আগুন লাগতে পারে বলে তার ধারণা। ডিসিসির এই মার্কেটে হাজারো দোকান আছে বলে সেখানকার কয়েকজন মালিক জানিয়েছেন।

ষড়যন্ত্র ও নাশকতার অভিযোগ ব্যবসায়ীদের: ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তাদের উচ্ছেদের জন্য চক্রান্ত করে আগুন দেয়া হয়েছে। তারা এই ঘটনাকে নাশকতা বলে মনে করছেন। তারা অভিযোগ করেন, আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য ফায়ার সার্ভিস তেমনভাবে কাজ করছে না। দোতলা একটি বিল্ডিংয়ের ওপর এই মার্কেট, চারপাশে খোলা অথচ ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বলে ক্ষোভ জানান তারা।

মার্কেট মালিক সমিতির চেয়ারম্যান শের মোহাম্মদ দাবি করেন, ২০০৩ সালে মেট্রো গ্রুপের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুয়ায়ী এই মার্কেটটি ভেঙে এখানে ১৮ তলাবিশিষ্ট একটি বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। কিন্তু এখানকার দোকান মালিকদের পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। এ নিয়ে দোকান মালিকদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে এক রকম বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়। বহুবার তাদের উচ্ছেদের জন্য হুমকি-ধমকি দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে ২০১০ সালে একটি মামলাও হয়েছে। বর্তমান মেয়র আনিসুল হক দায়িত্ব নেয়ার পর দোকান মালিকদের কোনো হুমকি না দিয়ে বিষয়টি সমঝোতার চেষ্টা করেন।

অন্যদিকে ডিএনসিসি সূত্র বলেছে, রাজধানীর গুলশান-১ নম্বরের ডিসিসি বা ডিএনসিসি মার্কেটটি জরাজীর্ণের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ব্যবসায়ীদের মামলার কারণে এ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন হচ্ছিল না। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে কাঁচাবাজারের একটি অংশ ভেঙে পড়ে কর্মচারী আহত হয়েছিল। একাধিক কারণে ব্যবসায়ীরা সন্দেহ করছে, মার্কেটে কেউ বা কোনো চক্র অগ্নিসংযোগ করেছে। শের মোহাম্মদের দাবি, এটি নিশ্চিত নাশকতা, তাই আগুন লাগার আধা ঘণ্টার মধ্যে ভবনের একাংশ ধসে পড়েছে। সাধারণত আগুন লাগলে এভাবে বিল্ডিং ধসে পড়ে না।

এদিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মতত্পরতা নিয়ে অভিযোগ তোলেন মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বহু দোকান মালিক। তাদের মধ্যে আলতাফ হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাদের উচ্ছেদের জন্যই আগুন দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাতে মার্কেটের পূর্ব অংশে আগুন লাগে এবং কিছু সময় পর ওই অংশটি ধসে পড়ে। সকাল সাতটা পর্যন্ত মার্কেটের পশ্চিম অংশে কোনো আগুন ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের উপস্থিতিতেই আগুন পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সারা মার্কেটে ছড়িয়ে পড়েছে।

মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না: ফায়ার সার্ভিস ঃ  রাজধানীর গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ। ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, যে কোনো ভবনে আগুন লাগতে পারে। কিন্তু আগুন নেভানোর সক্ষমতা, পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা ও আগুন নেভানোর যন্ত্র থাকতে হবে।

এই মার্কেটে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকার অভিযোগ তুলে মেজর শাকিল বলেন, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমাণে পানি থাকে। এই পানি শেষ হয়ে গেলে বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হয়েছে। সেই পানি নিয়ে আসতেও সময় লেগেছে।

মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

অগ্নিকাণ্ডের ফলে গুলশান-১ নম্বর ও এর আশপাশের এলাকায় প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হয়েছে। দোকানিদের মালামাল সরানো ও ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যানবাহনগুলোকে চলাচলের জন্য গুলশান-১ নম্বর চত্বর থেকে শুটিং ক্লাব পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

গত সোমবার রাত আড়াইটার দিকে এ মার্কেটে আগুন লাগে। গতকাল মঙ্গলবার সাড়ে ৫টার আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুনে মার্কেটের একাংশ ধসে পড়েছে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট কাজ করেছে। বিকেলে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে দমকল সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে আগুন লাগার খবর পেয়ে রাতেই অনেক দোকান মালিক ও কর্মচারী ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কেউ কেউ তাদের ব্যবসায়িক ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ডিসিসির এই মার্কেটে হাজারো দোকান আছে বলে সেখানকার কয়েকজন মালিক জানিয়েছেন।

গুলশানের আগুন দুর্ঘটনা নয়: মানবাধিকার চেয়ারম্যান ঃ রাজধানী গুলশানের ডিসিসি মার্কেটে আগুনের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত নাশকতা কি-না তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. রিয়াজুল হক। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর রিয়াজুল হক এ মন্তব্য করেন। আগুনের ঘটনা খতিয়ে দেখার জন্য কমিটি গঠনেরও কথা বলেছেন তিনি। এ কমিটির মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও কেন আগুন নেভাতে দেরি হলো তা খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়া আগুনের কারণ অনুসন্ধান এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার জন্য সুপারিশ করবে এই কমিটি। কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে সে বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও এ আগুনকে পরিকল্পিত নাশকতা বলে অভিযোগ তুলেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরাও।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft