শিরোনাম: |
দুই দুষ্ট ভূতের কাণ্ড
|
সাদত আল মাহমুদ : মানুষ জাতির মতো ভূত সমাজেও ভূতেরা বিয়ে সাদী করে ঘর সংসার করে। বিয়ের পর সন্তান-সন্তাদি হয়ে থাকে। ভূতদের ছেলেপুলেরাও লেখাপড়া শিখে ভূতের মতো ভূত হওয়ার চেষ্টা করে। আবার কিছু কিছু ভূতদের সন্তানেরা পড়াশুনার ধারে কাছে না গিয়ে সারাদিন বনে-বাঁদারে ঘুরে বেড়ায়। যাকে বলে, টো টো কোম্পানির ম্যানেজার আর কি? কালকেতনের দুই ছেলে পিটলি ও কিটলি। এরা দুজনই ভারী দুষ্ট হয়েছে। এদের বাবা না থাকায় মা কালকেতনের পক্ষে ওদের লালন পালন করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। ওদের বাবা বছর খানিক আগে মানুষ শিকার করতে গিয়ে নিজেই শিকার হয়ে গেছে। এরপর থেকেই পিটলি ও কিটলি এতিমের খাতায় তাদের নাম লিখিয়েছে বাবা না থাকার কারনে শাসনের অভাবে ছেলে দুটি দিন দিন ভারী দুষ্ট হয়ে উঠেছে। শাসনের অভাবের কারনেই পিটলি ও কিটলি দিন দিন দুষ্টের শিরোমণি হয়ে উঠছে। ওদের দুজনকে নিয়েই ওদের মা কালকেতনের চিন্তার শেষ নেই। পিটলি ও কিটলি কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ছোট-বড়। দুজনই প্রায় সমবয়সী হওয়ার কারণে খুবই ডানপিটে হয়েছে। সারাদিন দুজন ভাসমান অবস্থায় আকাশে ভেসে বেড়ায়। ভূতদের পাড়ায় এর বাড়ি ওর বাড়ি সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে ভূতদের পাড়া ছেড়ে মানুষের পাড়াতে গিয়েও দুষ্টুমি করে। বিশেষ করে যাত্রাপালা, বিয়েবাড়ি, ছেলেদের খেলার মাঠে নানা ধরনের দুষ্টুমি করা পিটলি ও কিটলির প্রতিদিনের রুটিন কাজে পরিণত হয়েছে। একবার এক মাওলানা সাহেব প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে মাওলানার পানি ভর্তি বদনা শূন্যে উঠিয়ে নিয়ে যায়। মাওলানা সাহেবের চোখের সামনে বদনা শূন্যে উঠে যাওয়ায় মাওলানা সাহেব বলে, পানির বদনা কোনাই যায়। নাউজিবিল্লাহ। মাওলানার এই করুন দশা দেখে পিটলিও কিটলি হা হা করে হাসছে। শালার মাওলানা এবার ফান্দে পড়েছে। বেটা সারাদিন তো শুধু পবিত্র পবিত্র নিয়ে চেঁচামেছি করছ। এবার তুই নিজেই অপবিত্র হয়ে বসে থাক। এই বলে, পিটলি ও কিটলি দুজনই আবারও হা হা করে অট্রহাসিতে ফেটে পড়ে। পিটলি ও কিটলি সবচেয়ে বেশি যে দুষ্টুমি করে সেটা হলো- টিনের চালে ইট নিক্ষেপ করা। টিনের চালে ইট পড়লে মানুষেরা ভয়ে অস্থির হয়ে যায়। সবাই জানে এগুলো ভূতের কাজ। এমনও দেখা গেছে, ভূতের ভয়ে মানুষ বাড়ি ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে গিয়েছে। একদিন পিটলি ও কিটলি ওদের মা কালকেতনের কাছে আচ্ছামতো বকা খায়। মায়ের বোকা খেয়ে দুজনে সিদ্ধান্ত নেয়, ভূত সমাজে আর থাকবে না। প্রচণ্ড রকমের রাগ করে, ভোর বেলায় ভূতের এলাকা ছেড়ে মানুষের রাজ্যে চলে আসে। পিটলি ও কিটলি দুজনই ভূতের রূপ ধারণ করে আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। ওদের দুজনের রূপের বর্ণনায় দেখা যায়, নাক বাশের বাশির মতো এক হাতের মতো লম্তা। মানুষের মতো দুটো হাত থাকলেও হাতের আগুলগুলোতে বড় বড় নখ আছে। দুজনেরই কুকুরের লেজের মতো বাকানো লেজ আছে। বিশাল পর্বতের ওপর দিয়ে ওরা ভেসে যাচ্ছে, আর আপন মনে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখছে। ভাই দেখেছিস, মানুষের রাজ্য দেখতে কি সুন্দর! কি সুন্দর আকাশ, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা আরও কত কি। মানুষের রাজ্য দেখতে এত সুন্দর হওয়ায় বুঝি, মানুষ দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে। ভাই কিটলি। হ্যাঁ, বল ভাই পিটলি। আমার না মানুষ হতে ইচ্ছা করে। মানুষের মতো সুন্দর চেহারা পেতে ইচ্ছা করে। পিটলির মুখে মানুষ হওয়ার ইচ্ছার কথা শুনে, কিটলি হা হা করে হেসে উঠে। তোর কি ভাই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুই জানস না, মানুষ আমাদের জানের দুশমন। এই মানুষের কারণেই আমাদের বাবা মৃত্যুবরণ করেছে। যাদের কারণে আমাদের বাবা মারা গেছে, তুই কিনা তাদের মতো মানুষ হতে চাচ্ছিস! মা যদি জানে, তোরে ঝেটিয়ে ভূত সমাজ থেকে বের করে দিবে। মা কালকেতনের কথা শুনে পিটলি অনেকটা ভয় পেয়ে যায়। ভাই কিটলিকে অনুনয় বিনয় করে বলে, ভাই আমার এই কথাটা মাকে বলিস না। মা জানলে আমাকে মেরেই ফেলবে। আচ্ছা ঠিক আছে, মাকে বলবা না। কিন্ত একটা শর্ত আছে। কি শর্ত ভাই কিটলি? আর কোনদিন তোর মানুষ হওয়ার কথা যেন না শুনি। এই আমি নাকে খড় দিচ্ছি। আর কোনদিন যদি বলেছি, আমাকে মা যে শাস্তি দিবে তাই মাথা পেতে নেব। এদিকে কালকেতন সারাদিন পরিশ্রম করে বাড়ি এসেছে। মানুষের পাড়ায় গিয়ে সারারাত মাদার গাছের আগা, বাঁশ ঝাড়ের আগায় ছিল। মানুষ আর আগের মতো ভূত-পেত্নীকে ভয় পায় না। উল্টো দিয়াশলাইয়ের আগুন, চার ব্যাটারির টর্চ লাইটের আলো দিয়ে ভূতদের ভয় দেখায়। এরপরও সারারাত গাছের আগায় থেকে সাধ্যমত মানুষদের ভয় দেখিয়ে কিছু পঁচা মাছ, মরা ইঁদুর, তেলাপোকা নিয়ে এসেছে। বাড়িতে এসেই কালকেতন পিটলি ও কিটলিকে ডাকছে। ভাগ্য ভালো, দুই ভাইই কিছুক্ষণ আগে টইটই কোম্পানীর ম্যানেজারি করে বাড়ি এসেছে। মার ডাক শুনে দুজন মা কালকেতনের কাছে এগিয়ে যায়। মা, তুমি আমাদের ডেকেছো? হা, তোদের ডেকেছি। সারাদিন তোরা কোথায় থাকিস বলতো। সারাদিন পরিশ্রম করে আসার পর বাড়িতে এস তোদের মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছা করে। আর তোরা কিনা বাড়িতেই থাকস না। বলি, আমি না থাকলে, এই বাড়ির দেখাশুনা করবে কে? মা, তুমি কোন চিন্তা করো না। এখন থেকে আমরা দুজন তোমার সব কথা শুনবো। এরপর মা বেটা তিনজন মিলে পচা কাঁচা মাছ, মরা ইদুর ও তেলাপোকা খুব মজা করে খায়। তেলাপোকা ভূতদের খুবই প্রিয় খাদ্য। দুই ভাই মিলে খাপুস-খুপুস করে তেলাপোকাগুলো সব খেয়ে ফেলে। পরের দিন রাতের বেলায় কিটলি ও পিটলি পুনরায় মানুষদের এলাকায় চলে আসে। এরা দুজনই প্রতিদিনকার মতো আজও আকাশে ভেসে-বেড়াচ্ছে। আকাশে ভাসতে ভাসতে হঠাত্ দেখে, দূরে বিশাল এক আলোকসজ্জা দেখা যাচ্ছে। আলোকসজ্জা দেখে ওদের দুজনেরই কৌতূহল বহুগুনে বেড়ে যায় ঐখানে যাওয়ার। অবশেষে আলোক সজ্জার কাছে গিয়ে দেখে, মানুষের বাড়িতে খুব ধুমধামে বিবাহ হচ্ছে। মানুষের বিবাহের দৃশ্য দেখে, দুজনের মাথায় শয়তানি বুদ্ধি চাপে। এরপর বিয়ে বাড়িতে কিটলি ও পিটলি একঢার পর একটা শয়তানি শুরু করে দেয়। এক মাওলানা সাহেব, প্লেটে মুরগির রোস্ট খেতে যাবে, ওমনি কিটলি ছো মেয়ে প্লেটের রোস্টটা নিয়ে নেয়। বেচারা মাওলানা সাহেব, তার প্লেট থেকে মুরগির রোস্ট নাই হওয়াতে যারপর নাই অবাক এবং ভয় পেয়ে যায়। আরেকজন একজনের সঙ্গে করমর্দন করছে। পরক্ষণেই দেখে তিনি মানুষের সঙ্গে নয় ঘোড়ার লেজের সঙ্গে করমর্দন করছে। এ রকম ওদের নানা রকমের দুষ্টামিতে বিয়েতে আগত মেহমানেরা অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। বর পাগড়ি পড়ে বসে আছে। হঠাত্ বর দেখে তার মাথায় পাগড়ি নেই। বিয়ের আসরে বয়ের মাথায় পাগড়ি না থাকাটা যে কি বিরক্তিকর, যে এই পরিস্থিতিতে পড়ে নাই, সে বুঝবে না। বরের বাবা আক্কাস আলী হেঁটে যাচ্ছে, এমন সময় কিটলি এসে বরের বাবাকে দিল এক ধাক্কা। কিটলির ধাক্কা খেয়ে বরের বাবা চিত্পটাং। মাটিতে কয়েকটা পল্টি খেয়ে তবেই ক্ষ্যান্ত হয়। এদিকে বিয়ের আসরে সবারই চিত্কার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে বরের বাবা-মার চিত্কারে আকাশ ভাড়ি হয়ে যাচ্ছে। বর নাই, বর নাই। সবারই একটাই প্রশ্ন। বর গেল কোথায়? অনেক খোঁজাখুঁজির পর বরের সন্ধান মিলে। সবাই বরকে খুঁজতে খুঁজতে দেখে, বর গাছের আগায় বসে আছে। বরকে গাছের উপরে দেখে সবাই ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে সবাই দেখে, বর গাছে নয়, কনের পাশেই বহাল তবিয়তে বসে আছে। যথারীতি বর ও কনের বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। এরপর কিটলি ও পিটলি বিয়ে বাড়ির নানা রকম খাবার একটা প্যাকেট ভর্তি করে নিয়ে মা কালকেতনের জন্য বাড়ি চলে আসে। এরপর আর কোনদিন পিটলি ও কিটলি কখনো মানুষদের ভয় দেখায় না। ওরা ভূত রাজ্য ছেড়ে কখনো মানুষ সমাজে আসত না। দুজনের মধ্যে দুষ্টুমিটাও কমে গেছে বহুগুনে। মানুষরাও আর কোনদিন ভূতদের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। সব জাতের মানুষেরাও সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে আপন মনে। মানুষ সমাজে যেমন দুষ্টু মানুষ আছে, তেমনি ভূত সমাজেও দুষ্টু ভূত আছে। |