মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
মাটির ঘ্রাণে লোক সংস্কৃতি
Published : Saturday, 3 December, 2016 at 6:00 AM, Count : 1158

গ্রাম বাংলার মাটি থেকে ওঠে আসা হাজারো লোকায়ত সংস্কৃতির মধ্যে বাংলার ঘরে ঘরে মাঠে-বাটে-প্রান্তরে কখনো একক, কখনো বা দলবদ্ধ হয়ে প্রাচীন পুঁথির গান বা নিজস্ব তৈরি ছড়াগুলো কিছুটা সুর করে পরিবেশন করার রেওয়াজ ছিল। বিশেষ করে, গাঁয়ের প্রান্তিক নিরক্ষর ও প্রাথমিক ছাত্রাবস্থায় স্কুল থেকে ঝরে পড়া বিত্তহীন ব্যক্তিদের(যাদের বেশির ভাগ যুবক ও প্রাক মধ্য বয়সী) স্বতঃস্ফূর্ত সম্মিলিত গীত বা সুর করে এক ধরণের ছন্দোগতিতে পুঁথি পড়ার ন্যায় কিছু কিছু নাতিদীর্ঘ ছড়া পড়া হতো তাদের একান্ত নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায়। ঠিক কোন কালে, কত যুগ আগে থেকে এসব পরিবেশনা শুরু হয়েছিল, তা বলা সম্ভব নয়। তবে, কয়েক শতাব্দী পাড়ি দিয়ে আসা, এ দেশের মাটির ঘ্রাণে মিশে থাকা, প্রায় লুপ্ত হয়ে যাওয়া এ সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারা যে ব্রিটিশোত্তর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এমনকি, সে দিনকার স্বাধীন বাংলাদেশেও কিছুকাল দৃশ্যমান ছিল, তা বলাই বাহুল্য। আমরা শৈশব এ ধরনের লোক সংস্কৃতির রসবোধ আহরণ করে আসছিলাম এবং যারপরনাই আনন্দে তৃপ্ত হয়ে অনেকটা মনের অজান্তেই মুখস্থ করে নিতাম সেসব লোক গীতি বা ছড়াগুলো।

এখন স্বদেশ ভূমের সূর্যটা প্রায় মধ্য গগনে। অর্থাত্, স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স এখন সাড়ে চার দশক। এত দিনে এ দেশের তথ্য প্রযুক্তির অভাবিত অগ্রগতি সহ প্রগতির চাকাটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সংস্কৃতির গ্রহণ-বর্জনের মধ্যদিয়ে কালের এ ঘূর্ণায়মান চাকায় পুরোনো গ্রামীণ সংস্কৃতি যেন যাদুঘরে রক্ষিত প্রাচীন পুঁথির মতো ধূসরিত ও ঝাপসার বস্তু হতে হতে ক্রমশ জনপদ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ছেলেবেলায় শোনা যেতো জারিগান(যার পটভূমিতে রয়েছে ইমাম হাসান(রা.) ও ইমাম হোসেন(রা.)এর বিয়োগান্তক করুণ ইতিহাস) ; ছিল সারিগান আর শীতকালে বিশেষত, পৌষ জুড়ে চলতো গাঁয়ের প্রান্তিক ভাগ চাষি কিংবা অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত, শিক্ষায় পশ্চাত্পদ জনগোষ্ঠীর উত্সাহী যুবসমাজ ও মধ্যবয়সী যারা, বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান গেয়ে তাদের সঞ্চিত মাগন (সংগৃহীত চাল বা টাকা)-এর বদৌলতে তাদেরই বাড়ির নিকটবর্তী কোনো উঁচু বা টিলা সংবলিত বনভূমির ফাঁকা জায়গায় তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত বনভাতার (বনভোজন) আনন্দে মেতে ওঠে। স্বহস্তে তৈরি করা তাদের শীতের রকমারি পিঠা খাওয়ারও এক অনাবিল তৃপ্তির আমেজে মেতে ওঠতো ওরা।

আমার আজকের এই নিবন্ধে আমি সব প্রসঙ্গে না গিয়ে শুধু মাত্র একটি  অঞ্চলের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির স্মৃতিচারণ  করছি। মনে পড়ে, সেইসব শীতের রাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান গেয়ে মাগন সংগ্রহ করার প্রচীন প্রচলনের কথা। ছেলেবেলায় এমন ধরনের গানকে আমরা কুড়া-কুড়নী র গান নামেই জেনে আসছি। যেহেতু, গরিব ও প্রন্তিক ভাগ চাষিদের এই সংস্কৃতি, যাদের মধ্যে তখন অনেকের ঘরে তিন বেলা আহারেরও সঙ্গতি ছিল না, সেহেতু মাঝে মাঝে মনকে এই ভেবে নাড়া দেয় যে, সেকালের দারিদ্র্যকে ছাপিয়েও ওদের মধ্যে বর্তমান ছিল হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির সানন্দ মুখরতা। সারাদিন কায়িক পরিশ্রম করে, যাদের মধ্যে (শধুমাত্র পুরুষ) কেউ ক্ষুদ্র দোকানদার, কেউ প্রন্তিক চাষি আর সর্বাধিক সংখ্যায় ছিল দিনমজুর ; বিশেষ করে শীতকালে কোন রকমে রাতের আহার সেরে প্রায় পনেরো-বিশ জনের একেকটি দল বেঁধে বেরিয়ে পড়তো গাঁয়ের বিত্তবান, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়িগুলোর উদ্দেশ্যে। বাড়ি প্রতি প্রায় গুরুত্ব অনুসারে এক বা দুতিনটে গান কিংবা, পুঁথি সদৃশ ছড়া তাদের নিজস্ব ঢংয়ে সুর করে পর্যায়ক্রমে পরিবেশন করে তারা যেমন গৃহস্থের বাড়ির সদস্যদের আনন্দ যোগাতো, তেমনি নিজেদেরকেও অনেকটা ধন্য মনে করতো। প্রতি বছর পৌষ পার্বণকে সামনে রেখে শীতের শুক্লপক্ষের চাঁদনী রাতের মধ্যভাগ, এমনকি রাত প্রায় দুটো-তিনটে অব্দি চলতো তাদের ক্লান্তিবিহীন পরিবেশনা। বিনিময়ে, বাড়ি বাড়ি হতে চাল বা কদাচিত্ অর্থ দিয়ে তাদের খুশি মনে বিদায় করার ঐতিহ্যের প্রচলন ছিল দেখার মতোন।

যুগ পরম্পরা অলিখিত সংস্কৃতির চর্চাবিহীন মাটি ও মানুষের মুখে মুখে গেয়ে যাওয়া বিদায়োন্মুখ মাটির গন্ধ সন্নিবিষ্ট যে সব পুরাতন গীত বা ছন্দোবদ্ধ ছড়াগুলো বিস্মৃতির অতলে প্রায়, ভাবনার বিষয়, তার ছিটেফোঁটোও আজ অঞ্চল বা সমাজের সংরক্ষণে রাখার মতো অবস্থায় নেই। যেমন ধরা যায়, ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা অঞ্চলের একটি কোরাস-                

 কুড়া বলে, কুড়ণী গো, / ইবার বড় বান ;/কুজা কইরা বাইন্যো গো বেডি,/কুইট্যা খাইবো ধান।/ কুড়া গেছে ধান কুটিতে/ কুড়ণীরে খাইলো বাঘে ;/  সকল কুড়া সাইজ্যা আইলো/

                            ফুলমানিতার বাগে।/  ফুলমানিতা জিজ্ঞাস করে,/ কই যাওরে ভাই ?/  রাজার হাতের ডাং লইয়া/

                             বাঘ মারবার যাই।/ এক বাঘ মাইরা আইলাম/ আড়ালিয়ার পাড়ে ;/ আর এক বাঘ মারতে গেলাম,/

                              বাঘ-এ করলো ক্ষুরি ;/এক্কে দৌড়ে উইঠ্যা পড়লাম/ চাঁন খাঁর বাড়ি....

ইত্যাকার আঞ্চলিক, একেবারে প্রান্তিক, ভূমিহীন আজগাঁয়ের কথ্য ভাষায় হয়তো অজস্র লোক গীত প্রচলিত ছিল, যেগুলো অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন নিজস্ব মাটির ভাষায় সংঘটিত। ওপরের গানটি ছিল সাধারণত স্বতঃপ্রণোদিত দরিদ্র বা নিম্ন আয়ের পুরুষদের পৌষ মাসে পিঠা তৈরি করার উত্সব কিংবা বনভাতার (বনভোজনকে ওরা ওদের কথ্য ভাষায় বনভাতা বলে) আয়োজন করার নিমিত্তে পরিবেশন করে চাল সংগ্রহ করার এক প্রধান ও অনন্য সংস্কৃতির অংশ। একই ভ্রাম্যমাণ আসরে পর্যায়ক্রমিক গান বা পুঁথি সদৃশ ছন্দোবদ্ধ অলিখিত ছড়া যেগুলো দলের দলনেতা এবং অন্য সবাই (দোহার) মিলে প্রশ্ন এবং উত্তরের ন্যায় নাতিদীর্ঘ আকারে কাল-কালান্তরে গেয়ে আসতো, তা নিম্নরূপ

সকলে: হরিং যায় রে হরিং যায় ;/দলনেতা : দেখেছ হরিং কইদ্যা যায়।/ দোহার: নিম্ গাছের তল দ্যা যায়।/ দলনেতা : নিম্ গাছো আড়ুলের বাসা ;/ দোহার: চক্কর চক্কর বুদ্ধিনাশা।/  দলনেতা: এক চক্করো (চক্করে) মারলাম বারি ;/ দোহার: বুইড়া বাঘের গলাত্ (গলায়) দড়ি।/ দলনেতা: বুইড়া বাঘ অনুমান (হনুমান);/ দোহার: লেঙ্গুর ধইরা টাইন্যা আন্।/

দলনেতা: লেঙ্গুর গেল ছিঁইড়া ;/ দোহার : বাঘ গেল মইরা।/ দলনেতা: শীতে মরি কষ্ট পাই ;/ দোহার : মাগন দেইন গো, বাড়িত্ যাই।...

এখানে ওপরের দুটো পরিবেশনাই ময়মনসিংহ এবং গাজীপুর জেলার উত্তরাঞ্চলের পাড়াগাঁয়ের ভাষায় হরিণ কে হরিং বলা হয়েছে। তবে এসব অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত বা স্বাক্ষর-সচেতন জনগোষ্ঠী হরিণকে পূর্বাপর হরিণই বলে আসছেন। তবুও মাটির ঘ্রাণবিশিষ্ট এসব গান বা পুঁথিপাঠগুলো এক ধরনের ছন্দাকারে প্রকাশ করা হতো বলে ভাষা যেমনই থাক, শুনতে ভালোই লাগতো। যেমন- কইদ্যা যায় মানে কোথা দিয়ে যায় এবং আড়ুল মানে টিকটিকি বোঝানো হয়েছে।

সভ্যতার ক্রম বিকাশের ধারায়, এটা আজ অনস্বীকার্য যে, নানা শ্রেণিপেশার এমনকি গরিব চাষিরাও শ্রমের ব্যস্ততা আর বিজ্ঞানের যান্ত্রিক সুবিধার সুবাদে যেমন কম বেশি সুবিধা ভোগ করছেন কিংবা, সুবিধার আঁচ পাচ্ছেন, তেমনি বিপরীতক্রমে পুরোনো লোক সংস্কৃতির ইতিকথাগুলোকেও মানুষের স্মৃতির ভাণ্ডার হতে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে নিম্নবিত্ত ও ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো কঠিন বাস্তবতায় যেখানে মোটা ভাত, মোটা কাপড় যোগাতে দিনমান শ্রমের নিগড়ে বন্দী, সেখানে ইচ্ছা থাকলেও সে সমস্ত স্বতঃস্ফূর্ত সংস্কৃতির ঐতিহ্য আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। ফলে, মাটির গন্ধ বিশিষ্ট ক্ষণিকের গ্রামীণ বিনোদন বা লোকজ সংস্কৃতির উত্সারিত আনন্দের পরিতৃপ্তি হতে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ।

পলাশ ডাকা, কোকিল ডাকা আমাদের এই সোনার বাংলাদেশের পল্লী এলাকায় এক সময় বিভিন্ন স্থানের নিজস্ব কথ্য ভাষায় যে সব লোকজ গান, শ্লোক, পুঁথি বা ছড়া আবহমান কাল ধরে পরিবেশিত হয়ে আসছিল, হয়তো অভিন্ন কারণেই সকল অঞ্চলের প্রাচীন গীতিসম্বলিত পরিবেশনাগুলোকেই আজ মানসপটে ঝাপসা হয়ে গেছে, যার প্রবাহ ময়মনসিংহ সদর দক্ষিণ অঞ্চলে এসেও একান্ত নিবিড়ভাবেই ধাক্কা দিয়েছে। দরিদ্র ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর এ সমস্ত গীত সম্পদ ভবিষ্যতে আর কোথাও কোন দিন পরিবেশন হবে কি-না, জানা নেই। হয়তো কোন সংগঠন (সংস্থা) মিডিয়া কিংবা সরকারি উদ্যোগে সম্পূর্ণ অবিকৃত বা ঈষত্ পরিবর্তিত অবস্থায় প্যাকেজ প্রোগ্রামের কোনো ফ্রেম ওয়ার্কের মতো সুনির্দিষ্ট উত্স হতে সেগুলো সাধারণ্যে প্রদর্শন করানোর নিমিত্তে কোনো কর্মপদ্ধতির আয়োজন হলে হতেও পারে; এটাই ভাবতে ইচ্ছে করে।

আমার প্রত্যাশার এই শেষ প্রান্তে এসে বলতে চাই, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে সব সময় স্বাগত জানিয়েই হয়তো আমার মতো ক্ষেত্রবিশেষে কিছু অতীতাশ্রয়ী নস্টালজিকদের আশা, বিভিন্ন স্থানের আঞ্চলিক ভাষায় পুরাতন গ্রমীণ সংস্কৃতির যতটা সম্ভব অবিকৃত আলেখ্যানুষ্ঠান একেবারে গাঁয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কর্তৃক পরিবেশনা, বিশেষ করে পল্লীর ক্ষেতে-খামারে কাজ করা সরল প্রাণ কেবল স্বাক্ষর ও নিরক্ষর পুরুষদের মুখে গাওয়া পৌষের লুপ্তপ্রায় মাটির গান টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে প্রদর্শন করানোর এক প্রত্যাশিত আকাশ-কুসুম ভাবনা নিয়ে অনাগত সেই শুভ দিনটির প্রহর গুণছি। ময়মনসিংহের ভালুকা অঞ্চলের পৌষ পার্বণকে ঘিরে কুড়া-কুড়ণীর গান আর হরিং যায় রে হরিং যায় -এর মতো আঞ্চলিক মাটির ঘ্রাণে মেশা গান, শ্লোক ও পুঁথি সদৃশ ছন্দাকার কথ্য ছড়াগুলো সুনির্দিষ্ট গতি ও সীমা অতিক্রম করে স্বমহিমায় ছড়িয়ে পড়ুক সারাদেশ ও সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার, বহির্বিশ্বে।

    - বাদল বিহারী চক্রবর্তী



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft