শিরোনাম: |
অনিশ্চয়তার পথে মার্কিন সমাজ
|
সুব্রত বিশ্বাস : সব অনুমান, পূর্বাভাস, সমীক্ষা, ধারণা, বিশ্লেষণ, অভিমতকে মিথ্যা প্রমাণ করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হলেন রিপাবলিকান প্রার্থী (রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থি) ডেনাল্ড ট্রাম্প। ১৮ মাসের প্রচার পর্বে প্রতিনিয়ত তিনি যেমন চমক ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন তেমনি তার জয়ও এসেছে চমক ও বিস্ময়ের মধ্য দিয়ে। আবার জয়ের পরেও বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। উলটে নতুন করে হাজির হয়েছে হাজারো প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন প্রচারকালে তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেগুলো কি পালন করবেন? যদি পালন করেন বা পালনের চেষ্টা করেন তাহলে অবশিষ্ট বিশ্বের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের টানাপড়েন নতুন কোনো সঙ্কট তৈরি করবে না তো? এই প্রশ্নের আপাতত কোনো উত্তর কারো কাছে নেই। আসলে অস্থিরচিত্র, খামখেয়ালি এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শহীন হিসেবে অধিক পরিচিত ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত কি করবেন বা করবেন না তা অনুমান করা অসম্ভব। তাই এ বিষয়ে একমাত্র আশঙ্কা করাই বাঞ্ছনীয়। এবারের নির্বাচন আমেরিকার ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে এই প্রথম কোনো একজন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির ঘরানা, আচার-আচরণ, ব্যবহার কথাবার্তা ইত্যাদি সম্পর্কে যে তিনি একেবারেই অনভ্যস্ত তা গোটা প্রচারেই তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তাছাড়া প্রশাসনিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি অভিজ্ঞতাহীন কোনো ব্যক্তি এ প্রথম প্রেসিডেন্ট হলেন। তিনি শুধু প্রেসিডেন্ট হননি ৫০ প্রদেশের অধিকাংশের গভর্নরই তার দলের। সংসদের দু’টি কক্ষই (কংগ্রেস ও সিনেট) এখন রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুপ্রিমকোর্টে বর্তমানে রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাট সমর্থন সমান সমান বিচারপতি থাকলেও একটি পদ শূন্য আছে। ট্রাম্প পছন্দের কোনো বিচারপতি নিয়োগ করে সর্বোচ্চ আদালতকেও নিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসতে পারবেন। অর্থাত্ মার্কিন প্রশাসনের নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠানেই ট্রাম্পির আধিপত্য। কার্যত পুরোপুরি বিরোধীহীন প্রশাসন চালাবেন ট্রাম্প। মার্কিন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যে আশঙ্কা করেছিল সেটাই সত্য হলো। রাজনৈতিক মহল, অর্থনীতি ও বাণিজ্য মহল, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ, থিঙ্ক টেঙ্ক ও করপোরেট মিডিয়া এ প্রতিষ্ঠানেই অংশ। এদের কেউই অনুমান করেনি ট্রাম্প জিতবেন। মার্কিন করপোরেট মিডিয়া সর্বশক্তিমান ও অজেয় বলেই অধিক পরিচিত। তারা চাইলে পারে না এমন কাজ নাকি নেই। কিন্তু এই নির্বাচনে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ ও পরাজিত। তারা যা আভাস দিয়েছিল বা হিসাব-সমীক্ষা করেছিল ফল প্রকাশের পরই তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। করপোরেট মিডিয়াকে এতটা খাটো করে দেখা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে অতীতের আদর্শভিত্তিক নিরপেক্ষ বলতে যা বুঝায় আজ আর তার অস্তিত্ব নেই। আজকের মিডিয়া করপোরেট মালিকানাধীন পুঁজির মুনাফা সৃষ্টির অন্যতম হাতিয়ার। এই মিডিয়া বৃহত্ একচেটিয়া পুঁজি, বিশেষ করে সারা বিশ্বে চলমান লগ্নিপুঁজির স্বার্থরক্ষায় দায়বদ্ধ। তাই সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা বা বস্তবতা যাই থাকুক করপোরেট মিডিয়ার কাজ হবে তাকে বিকৃত বা সংশোধন করে করপোরেট পুঁজির অনুকূলে পরিবেশন করা। মার্কিন করপোরেট পুঁজি মনে করেনি ট্রাম্প তাদের প্রার্থী। বরং হিলারিকেই তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মেনে নিয়েছিল। তাই হিলারির প্রচার তহবিলে জমা পড়েছিল অঢেল করপোরেট ডলার। মার্কিন বিত্তবানরা মরিয়া হয়ে উঠেছিল হিলারিকে জেতানোর জন্য। অন্যদিকে ট্রাম্পের তহবিলে টাকা এসেছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বেশি। বস্তুত মার্কিন শাসকশ্রেণী তথা বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজির কর্তা ব্যক্তিরা চেয়েছিল তাদের স্বার্থরক্ষাকারী রাজনৈতিক-প্রাতিষ্ঠানিক কাঠমোর মধ্যেকার কেউ জয়ী হোক। সে দিক থেকে হিলারি ছিলেন তাদের প্রথম পছন্দের। মূলত এ জায়গা থেকেই মার্কিন করপোরেট মিডিয়া ও তাদের সহযোগী আন্তর্জাতিক মিডিয়া তাদের সংবাদ ভাষ্য পরিবেশনে প্রকৃত বাস্তবতা ও সত্যকে যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। একদিকে যেমন হিলারির পক্ষে সরাসরি প্রচার করেছে, অন্যদিকে তেমনি নানা কায়দায় সরাসরি ট্রাম্পের বিরোধিতা করেছে। হিলারিকে যেমন দায়িত্বশীল, নির্ভরযোগ্য অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনৈতিক ও মার্কিন স্বার্থের প্রতিভু হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে তেমনি চিহ্নিত করা হয়েছে দায়িত্বজ্ঞানহীন, অনভিজ্ঞ, অস্থিও মস্তিস্ক অস্বাভাবিক ব্যক্তি হিসেবে। হিলারির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগগুলোকে যেমন যথাসাধ্য আড়াল করার ও গুরুত্বহীন করার চেষ্টা করা হয়েছে তেমনি ট্রাম্পকে কিছু অশালীন ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যকে বেশি করে প্রচারের আলোয় এনে ট্রাম্পকে নিকৃষ্টমানের ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আবার আধুনিক পুঁজিতন্ত্র তথা নব্য উদারনীতিকে বিশ্বায়িত লগ্নি পুঁজির রুজিরোজগারের নিশ্চয়তা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের একমাত্র ও সর্বোন্নত পথ হিসেবে বাস্তবায়িত করতে হিলারিকে যথাযোগ্য প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। অথচ বিগত কয়েক দশক ধরে সাধারণ মানুষের মজুরি বৃদ্ধি না হওয়া, বিশেষ করে নব্বইয়ের দশক থেকে মজুরি হ্রাস, জীবনযাত্রার মানের অবনয়ন, বেকার, অর্ধবেকার কাজের অনিশ্চয়তা যেভাবে মার্কিন শ্রমজীবী জনগণের দুর্দশা বাড়িয়েছে ট্রাম্প সেই প্রশ্নগুলো সামনে আনলেও মিডিয়া সেগুলোকে চাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে। বস্তুত এ প্রশ্নগুলোই হিলারির ডেমোক্র্যাটিক প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি স্যন্ডার্স আরও জোরালো ও স্পষ্টভাবে তুলেছিলেন এবং এই সমস্যা নিরসনে অর্থনীতিতে নতুন অভিমুখ আনার কথা বলেছিলেন। মার্কিন করপোরেট মিডিয়া উদারনীতির স্বার্থেই স্যান্ডার্সকে অপাংতেয় করে হিলারিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এটা ঠিক ট্রাম্প সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার জলন্ত সমস্যাগুলোকে সামনে এসেছেন কিন্তু এ ক্ষেত্রে সততা ও সদিচ্ছার লেশমাত্রও তার মধ্যে ছিল না। তার লক্ষ্য ছিল যেভাবেই হোক ক্ষমতা দখল। তাই সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের সামগ্রিক সমস্যাকে দেখেছেন বর্ণবাদী দৃষ্টিতে। আদতে এই ধনকুবের ব্যবসায়ী নিজেও একচেটিয়া পুঁজির অধিকতর মুনাফা সৃষ্টির মৌলিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নীরব। অধিকন্তু সমস্যাকে কৃষ্ণাঙ্গদের এবং বিদেশি অভিবাসীদের বিরুদ্ধে চালিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবিদ্বেষকে জাগিয়ে তুললেন যা মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও মেরুকরণকে অনিবার্য করে তোলে। সমস্যা সমাধানের পথের সন্ধান নয়, তিনি সমস্যাকে ব্যবহার করে উগ্র দক্ষিণপন্থাকে নির্বাচনী প্রচারের হাতিয়ার করলেন। মার্কিন সমাজকে উদারপন্থা থেকে সঙ্কীর্নতা ও পশ্চাদপদতার দিকে ঠেলে দিলেন। ইউরোপেও সম্প্রতি এই প্রবণতা দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। ব্রিটেনে তা পরিণত চেহারা নিয়েছে ব্রেক্সিটের মধ্য দিয়ে। ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশে কট্টর দক্ষিণপন্থি নয়া ফ্যাসিস্তরা জনভিত্তি বাড়াতে পারছে। ভারতেও এমন দক্ষিণপন্থা উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতা দখলে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে ক্ষমতায় না গেলেও ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে যথেষ্টভাবে সচেষ্ট। হিলারির পরাজয়ে বৃহত্ একচেটিয়া করপোরেট তথা বিশ্বায়িত লগ্নি পুঁজি একটু ধাক্কা খেয়েছে সন্দেহ নেই। অন্যদিকে ট্রাম্পের শাসনে ভবিষ্যত্ আমেকিরার অবস্থান অন্যান্য দেশও দ্বিধান্বিত। বিশেষ করে যেসব দেশের সাথে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এবং যারা আমেকিরা ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে তারা রীতিমতো অনিশ্চয়তার দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। আবার যাদের সঙ্গে আমেরিকার ভালো সম্পর্ক নয় তারা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে নতুন করে খুঁটি সাজানোর জন্য। এসবের বাইরে সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা হলো এ নির্বাচনকে ঘিরে মার্কিন সমাজে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন। সাম্প্রতিক অতীতে নির্বাচনকে ঘিরে মার্কিন সমাজ এভাবে বিভাজিত হয়নি। এভাবে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান ও শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কৃষ্ণাঙ্গ বিরোধী ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা এভাবে মাত্রা ছাড়া আকার নেয়নি। এক সময় আমেরিকা অতিথি শ্রমিক হিসেবে যেসব অভিবাসীদের সাদরে আমন্ত্রণ জানাতো এখন তাদের দেশের ও জাতির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জাগিয়ে দিচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দেশ থেকে আসা শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদেরও আজ আমেরিকা সহ্য করতে পারছে না। অর্থাত্ উদার গণতন্ত্র বলে যে আমেরিকা এতকাল দেখানো হয়েছিল সে আমেকিরা এখন আর নেই। জাতি বিদ্বেষ আর বর্ণবিদ্বেষের আত্মঘাতী স্রোতে আজকের আমেরিকা আক্রান্ত। আসলে বিশ্বের সর্ববৃহত্ অর্থনীতি এবং সর্বশক্তিমান দেশে আজ ভেতর থেকেই পচন ধরেছে। বাইরের ঐশ্চর্য, প্রাচুর্য আর জৌলুশ দিয়ে তাকে আর আড়াল করা যাচ্ছে না। বস্তুত মার্কিন অর্থনীতির স্বর্ণযুগের শেষের শুরু হয়েছিল ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিক থেকে। মার্কিন ডলারের সঙ্গে মজুদ স্বর্ণের সম্পর্ক ছিন্ন করা তখনই। মার্কিন অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী নিয়ম অনুসারে মুনাফা বৃদ্ধির পথ সঙ্কীর্ণ হওয়ার সূচনাও হয় তখন থেকে। ফলে মার্কিন শ্রমজীবীদের প্রকৃত আয় বৃদ্ধির পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। মার্কিন পুঁজির মুনাফা সৃষ্টির গতি ধরে রাখতে তখন থেকেই হাজির হয় নতুন তত্ত্ব নব্য উদারনীতি। অর্থাত্ পুঁজির সর্বোচ্চ মুনাফার স্বার্থে যাবতীয় বাধা-প্রতিবন্ধকতা দূর করে দিতে হবে। বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ, ডব্লিউটিও এমনকি কিছু ক্ষেত্রে জাতিসংঘও দায়িত্ব নেয় এই নতুন ব্যবস্থা সারা বিশ্বে চাপিয়ে দিতে। নতুন ব্যবস্থা মানে শ্রমখাতে ব্যয় যতটা সম্ভব কমাতে স্থায়ী চাকরি, স্থায় মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি তুলে দেয়ার ব্যবস্থা। অন্যদিকে পেনসন, পি এফ ই এস আই, সবেতন ছুটি, কাজের সময় ইত্যাদি তুলে দিয়ে শ্রমিকদের শ্রম যথেচ্ছ লুটের ব্যবস্থা হয় মজুরি না দিয়ে বা কম দিয়ে। এভাবে আপাতদৃষ্টিতে মুনাফা বাড়লেও অর্থনীতির বৃদ্ধির হার বাড়লেও শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়তে থাকে। তাদের জীবন মানের অবনমন ঘটতে থাকে। অন্যদিকে বৃহত্ করপোরেট পুঁজির লগ্নির জন্য খুঁজে নেয় সস্তা শ্রমের জায়গা। ফলে একদা উন্নত দেশের বহু কলকারখানা স্থানান্তরিত হয় উন্নয়নশীল দেশে। পাশাপাশি বিদেশের বাজার দখলের ফলে করপোরেট মুনাফা বাড়লেও সাধারণ মানুষের বেকারি, অর্ধবেকার, নিম্নমজুরি প্রবণতা দ্রুত বাড়ে। এরই পরিণতি ধনবৈষম্যের তীব্রতা বৃদ্ধি। তথাকথিত বিকাশের মাধ্যমে যে সম্পদ তৈরি হচ্ছে তার সবটাই প্রায় চলে যাচ্ছে ওপরতলার কিছু ধনবানের হাতে। যত্সামান্য কিছু থাকে সাধারণ মানুষের জন্য।
লেখক : কলাম লেখক |