শিরোনাম: |
ভ্রমণ কাহিনীকার সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
|
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিক, লেখক ও পণ্ডিত। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল ভ্রমণকাহিনীর রচয়িতা হিসেবে খ্যাত তিনি। ইংরেজি সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও আইন বিষয়ে বিশেষ ব্যুত্পত্তি লাভ করার বিপুল খ্যাতি রয়েছে তার। প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ করে। বাবা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন পূর্ববর্তী স্বদেশি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটদের একজন। তার অনুজ সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের আমলাতান্ত্রিক বৈষম্য সঞ্জীবচন্দ্রের স্বভাববিরুদ্ধ হওয়ায় নিয়োগ প্রাপ্তির এক বছরের মধ্যেই তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল ভ্রমণকাহিনীর রচয়িতা হিসেবে খ্যাত। বিখ্যাত লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অগ্রজ অর্থাত্ বড় ভাই হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। তার রচনা দীপ্তি, কবিত্ব ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, সম্পাদক কিংবা লেখক হিসেবে তিনি যত না খ্যাতি পেয়েছিলেন তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি খ্যাতি পেয়েছিলেন তার অমর ভ্রমণকাহিনী ‘পালামৌ’-এর কারণে। প্রাথমিক জীবন: সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ডেপুটি কালেক্টর যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় ছেলে ছিলেন সঞ্জীবচন্দ্র। শৈশবে গ্রাম্য পাঠ্যশালায় শিক্ষালাভ করে সঞ্জীবচন্দ্র মেদিনীপুরে স্কুলে ভর্তি হন। বাবার কর্মসূত্রের বদলির কারণে সঞ্জীবচন্দ্রকে দুইবার হুগলী কলেজ ও মেদিনীপুরের স্কুলে ভর্তি হতে হয়। এরপর তিনি ব্যারাকপুরের সরকারি জেলা কলেজে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষা দেয়ার জন্য ভর্তি হলেন, কিন্তু অসুস্থতার জন্য পরীক্ষায় বসতে অক্ষম হলে কলেজ ত্যাগ করেন। কর্মজীবন: কলেজ ত্যাগ করার পর যাদবচন্দ্র বর্ধমান কমিশনারের অফিসে অল্প-মাইনের কেরানির চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। এরপর তিনি চাকরি ছেড়ে অনুজ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শে প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন বিভাগে ভর্তি হন, কিন্তু পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হন। কিছু দিন পর যাদবচন্দ্র মাসে তার জন্য আড়াইশ’ টাকা মাইনের হুগলি জেলার আয়কর বিভাগের পর্যবেক্ষকের চাকরির ব্যবস্থা করে দেন, কিন্তু কয়েক বছর পর পদটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে সঞ্জীবচন্দ্র বেঙ্গল রায়টস: দেয়ার রাইটস অ্যান্ড লায়াবিলিটিজ নামক একটি ইংরেজি প্রবন্ধ রচনা করেন। বইটি ইংরেজ শাসকমহলে এতটাই প্রভাব বিস্তার করল যে, সঞ্জীবচন্দ্রকে কৃষ্ণনগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ দেয়া হলো। এরপর তিনি পালামৌ, যশোর, আলিপুর হয়ে পাবনায় বদলি হন। সেখানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ার কারণে তার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি যায়। কিন্তু সরকার তাকে স্পেশাল সাব-রেজিস্ট্রারের পদে নিযুক্ত করলে বারাসত, হুগলি, বর্ধমান ও যশোরে তার বদলি হয়। যশোরের ম্যাজিস্ট্রেট বার্টনের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে সঞ্জীবচন্দ্র চাকরিতে ইস্তফা দেন। সাহিত্য কর্ম: ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম বাংলা প্রবন্ধ যাত্রা প্রকাশিত হয়। ভ্রমর নামক মাসিক পত্রিকায় রামেশ্বরের অদৃষ্ট নামক তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়, যা ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম উপন্যাস কণ্ঠমালা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে জালপ্রতাপ চাঁদ ও ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে মাধবীলতা নামক উপন্যাস পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। ১২৮১ বঙ্গাব্দে ভ্রমর নামক মাসিক পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত দামিনী নামক গল্পটি তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। ১২৮৭ বঙ্গাব্দ থেকে ১২৮৯ বঙ্গাব্দের মধ্যে ছয়টি পর্বে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় তার ভ্রমণকাহিনী পালামৌ প্রকাশিত হয়।তিনি পালামৌ ভ্রমণ করার বহুদিন পর ‘পালামৌ’ লেখেন। পালামৌ বইটিতে তিনি লিখেছেন- ‘বহুকাল হইল আমি একবার পালামৌ প্রদেশে গিয়াছিলাম, প্রত্যাগমন করিলে পরে সেই অঞ্চলের বৃত্তান্ত লিখিবার নিমিত্ত দুই-এক জন বন্ধুবান্ধব আমাকে পুনঃপুন অনুরোধ করিতেন, আমি তখন তাহাদের উপহাস করিতাম। এক্ষণে আমায় কেহ অনুরোধ করে না, অথচ আমি সেই বৃত্তান্ত লিখিতে বসিয়াছি। তাত্পর্য বয়স।’ পালামৌ ভ্রমণের সময় তিনি ছিলেন যুবক আর গ্রন্থটি লেখার সময় ছিলেন বৃদ্ধ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরে এই গ্রন্থের মূল্যায়ন করে ‘পালামৌ’ শিরোনামেই আরেকটি বই লেখেন। প্রসঙ্গত বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বাংলা সাহিত্যে বহুল স্মরণীয় উক্তি ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ এর সাক্ষাত্ আমরা পাই বইয়ের পাতাতেই। রবীন্দ্রনাথের মতো সব গুণীব্যক্তিই বলে গেছেন সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ছাত্রজীবনের মতো কর্মজীবনেও তিনি স্থির ছিলেন না। তবে ছাত্র হিসেবে তিনি মেধাবী ছিলেন। তার এই ভ্রমণকাহিনী ‘প্রমথনাথ বসু’ ছদ্মনামে ‘বঙ্গদর্শন’-এ প্রকাশিত হয়। ১৮৮৯ সালে তার মৃত্যু হয়। - বর্তমান ডেস্ক |