বুধবার ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ১৪ কার্তিক ১৪৩১
অধিগ্রহণ চুক্তি নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য
সাঁওতাল পল্লীতে হামলা : অভিযোগের তীর এমপির দিকে
Published : Thursday, 17 November, 2016 at 6:00 AM, Count : 1027

আতিক বাবু, গাইবান্ধা
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের আলোচিত জমি নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায় ও সুগার মিল কর্তৃপক্ষ। উভয়পক্ষই শর্ত অনুযায়ী জমি নিজেদের বলে দাবি করছেন। সাঁওতালদের দাবি রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১৯৬২ সালে আখ চাষের জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ (বাগদা-কাটা) এলাকায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ১৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। অধিগ্রহণের সময় জমির মালিকদের সঙ্গে চিনিকল কর্তৃপক্ষের চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ওই জমিতে আখ ছাড়া অন্য ফসলের চাষ হলে খামারের জমি প্রকৃত মালিকদের ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু কিছুদিন ধরে ওই জমিতে ধান ও তামাক চাষ করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বাপ-দাদার জমি নিজেদের দাবি করে আন্দোলনে নামে আধিবাসী (সাঁওতাল) সম্প্রদায়ের লোকজন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত ১ জুলাই খামারের প্রায় ১০০ একর আবাদি জমিতে ছোট ছোট কুঁড়েঘর নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন তারা।
অপরদিকে রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আউয়াল জানান, ১৯৬২ অধিগ্রহণের সময় চুক্তিনামা ছিল চিনিকল বা খামার বন্ধ হলে সেক্ষেত্রে জমি সরকারের কাছে চলে যাবে। অথচ এলাকার কতিপয় সুবিধাবাদী ব্যক্তির উসকানিতে সাঁওতালরা অবৈধভাবে চিনিকলের জমি দখল করে।
গত ৬ নভেম্বর জমি দখলমুক্ত করতে সাঁওতালপল্লীতে হামলা, ভাঙচুর ও বাড়িঘর লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, ইউপি চেয়ারম্যান ও সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি বুলবুল এবং পুলিশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ সাঁওতালদের। তারা জানান, সাঁওতালপল্লীতে অবৈধ আদিবাসী উচ্ছেদের নামে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে এবং তাদের আদেশেই হঠাৎ পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে। গুলির আওয়াজে তারা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে নিজেদের জীবন বাঁচানোর তাগিদে সাঁওতালরা তীর-ধনুক ব্যবহারে বাধ্য হন।
মাদারপুর গ্রামের আশা মুরমু অভিযোগ করে বলেন, ‘পুলিশের গুলির শব্দে সাঁওতালপাড়ায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন আমরা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তীর নিক্ষেপ করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা ইক্ষু খামার এলাকা থেকে পালাতে বাধ্য হই।’ পরে প্রাণভয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সাপমারা ইউনিয়নের মাদারপুর ও জয়পুরপাড়ায় (সাঁওতালপল্লী) আশ্রয় নিয়েছি।
ঘটনার ১০ দিন অতিবাহিত হলেও মাদারপুর ও জয়পুরপাড়ার সাঁওতালদের জীবনযাত্রা চরমভাবে স্থবির হয়ে রয়েছে। সেই সঙ্গে সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া এসব মানুষ স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের হুমকিতে ভয়, আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন। পাশাপাশি এসব পরিবারের নারী ও শিশু-কিশোররা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। অনেকে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এছাড়াও ঘটনার পর থেকে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষরা বাইরে কোনো কাজে যেতে পারছেন না। কাজ না থাকায় তারা অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন। ফলে দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। পুলিশের গ্রেপ্তার, আর স্থানীয় প্রভাবশালীদের হুমকিতে সাঁওতাল পরিবারের লোকজন হাটবাজারেও যেতে পারছেন না। তাছাড়া সাঁওতাল সম্প্রদায়ের অনেক শিশু-কিশোর গত ৯ দিন ধরে স্কুলেও যেতে পারছে না বলে অভিযোগ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের।
সাঁওতালপল্লীর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী অনন্ত জানায়, বাড়িতে আগুন দেওয়ার পর থেকে ভয়ে স্কুলে যাই না। অপর শিক্ষার্থী প্রভাতী কিসকু, চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী স্মৃতি মুরমু জানালো একই কথা।
এদিকে, সংঘর্ষের ঘটনার পর এ পর্যন্ত তিন সাঁওতাল মারা গেছেন বলে দাবি করছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে দুজন নিহতের কথা স্বীকার করা হয়েছে। তবে এ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা গ্রহণ করেনি পুলিশ। সাঁওতালদের দাবি সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের ক্ষমতার দাপটে পুলিশ মামলা গ্রহণ করছে না। এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুব্রত কুমার সরকার জানান, সাঁওতালপল্লী থেকে কেউ এখন পর্যন্ত থানায় মামলা করতেই আসেনি, তবে তারা এলে অবশ্যই মামলা গ্রহণ করা হবে। ওসি আরো জানান, এ ঘটনায়  ইতোমধ্যে গোবিন্দগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কল্যাণ চন্দ্র বাদী হয়ে ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা মিলে ৫০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় পুলিশ এ পর্যন্ত দীজেন টুটু, চরণ সরেন, বিমল কিসকু ও মাঝিয়া হেমভ্রম নামে চার আদিবাসীকে গ্রেপ্তারও করেছে।  সাঁওতালরা বলছেন এই মামলায় গ্রেপ্তারের ভয়ে পুরুষরা এলাকা ছাড়া। তারা মামলা করতে থানায় যাবেন কীভাবে?
নিহত সাঁওতালরা হলেন দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার চান্দুপর গ্রামের মৃত জ্যেঠা মাদ্রির ছেলে মঙ্গল মাদ্রি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শ্যামল হেমভ্রম ও সাপমারা ইউনিয়নের শিন্টাজুরি গ্রামের মৃত শম টুডু ওরফে শম মাঝির ছেলে রোমেশ টুডু।
সাঁওতাল সুভাস বলেন, খামারের জমিতে ঘর ছিল। সেই ঘর আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে সব শেষ করে দিয়েছে কালাম এমপি। ভোটের আগে মাথায় হাত বোলায়, আর এখন জমি দখলের জন্য সেই মাথা কাটার জন্য গুণ্ডা আর পুলিশকে লাগিয়ে দিয়েছে। এখন আর মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই নেই। কাজের জন্য বাইরেও যেতে পারছি না তাই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছি। একই গ্রামের জুনা মনি (৫০) বলেন, ‘এহন থাকার জায়গা নাই। খাবার নাই। স্বামীও আতঙ্কে বাড়ি ছাড়া। এহন আমাদের কি হবে। ছাওয়া পাওয়া (ছেলেমেয়ে) নিয়ে কই যামু।’
নির্মল টুডু ও মারি টুডু বলেন, ‘পুলিশের ভয়ে বাড়ি থেকে মাঠে কাজে যেতে পারছি না। ঘরে খাবার নেই। ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে যেতে ভয় পাচ্ছে। রান্না করা ঘর আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে, হাঁড়ি-পাতিল লুট করেছে। এখন আমরা খোলা আকাশের নিচে রান্না করতে বাধ্য হচ্ছি। তাও আবার এক পাতিলেই ১০ ঘরের রান্না।
একই গ্রামের মারি টুডু বলেন, ‘মাদারপুর গ্রামের মানুষ অজানা আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। পুরুষরা গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়ি ছাড়া। ঘরের খাবার শেষ হওয়ায় আমরা এখন অসহায় হয়ে পড়েছি। কেউ আমাদের সাহায্যও করতে আসছে না।
ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাস্কে অভিযোগ করে বলেন, ‘এখনো পাঁচ-সাতজন আদিবাসী নিখোঁজ রয়েছেন। আর এ হামলার সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাই জড়িত বলে তিনি দাবি করেন।
তিনি জানান, অধিগ্রহণের সময় জমির মালিকদের সঙ্গে চিনিকল কর্তৃপক্ষের চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ওইসব জমিতে আখ ছাড়া অন্য ফসলের চাষ হলে খামারের জমি প্রকৃত মালিকদের ফেরত দেওয়া হবে। কিছুদিন ধরে ওইসব জমিতে ধান ও তামাক চাষ করা হচ্ছে। সে কারণে এ দখলের ঘটনা ঘটে।
রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আউয়াল জানান, ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণের সময় চুক্তিনামা ছিল চিনিকল বা খামার বন্ধ হলে সেক্ষেত্রে ওইসব জমি সরকারের কাছে চলে যাবে। অথচ এলাকার কতিপয় সুবিধাবাদী ব্যক্তির উস্কানিতে সাঁওতালরা অবৈধভাবে চিনিকলের জমি দখল করে।
সাঁওতালপল্লীতে হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি গোটা সাংবাদিক সমাজের প্রতি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি যদি এই ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে বা আপনারা বের করতে পারেন তবে আমি সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দিব।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আবদুল হান্নান বলেন, সাঁওতাল পরিবার কর্মহীন থাকায় তারা নিরাপত্তহীনতায় ভুগছেন। সরকারি ও বেসরকারিভাবে তাদের সাহায্যের চেষ্টা করা হচ্ছে তবে সাঁওতালরা সাহায্য গ্রহণ করছেন না। এছাড়া তাদের পুনর্বাসনসহ আরো সহযোগিতা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। 



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft