বুধবার ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ১৪ কার্তিক ১৪৩১
৬ ঘণ্টার বৃষ্টিতে অচল ঢাকা
Published : Saturday, 13 July, 2024 at 6:00 AM, Count : 1088

বর্তমান প্রতিবেদক: এক দুপুরের বৃষ্টির পানি জমে প্রায় অচল হয়ে যায় রাজধানী ঢাকা। মাত্র ৬ ঘণ্টার বৃষ্টির পানি প্রায় সারাদিনেও নিষ্কাশন করতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। শুক্রবার (১২ জুলাই) রাতেও অনেক এলাকায় পানি জমে থাকার খবর পাওয়া গেছে।


শুক্রবার (১২ জুলাই) সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এমন বৃষ্টি অনেকের কাছে আনন্দের হলেও কয়েক ঘণ্টা যেতেই তা রূপ নেয় চরম ভোগান্তি আর আতঙ্কে। শেষ পর্যন্ত দুর্যোগে পরিণত হয় আষাঢ়ের এই বৃষ্টি। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত টানা ৬ ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস।

এই বৃষ্টির পানি জমে গলি থেকে রাজপথ সবই প্রায় ডুবে যায়। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরসমান পানি। গন্তব্যে পৌঁছাতে সড়কে পা দেওয়া মানুষেরা নাকাল হয়েছেন।

শাহজাদপুরে মদের দোকান বন্ধের দাবিতে মুসল্লিদের বিক্ষোভশাহজাদপুরে মদের দোকান বন্ধের দাবিতে মুসল্লিদের বিক্ষোভ
এছাড়া রাস্তা উপচে ময়লা পানি ঢুকেছে দোকানপাটে, বাসাবাড়িতে। সড়কে বিকল হয়ে পড়ে থেকেছে যানবাহন। দিনভর দুর্ভোগে স্থবির হয়ে পড়ে জনজীবন। যান ও জলজটে অচল হয়ে পড়ে রাজধানী। জলাবদ্ধতায় নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে মন্ত্রী-এমপি-সচিব থেকে শুরু করে লাখ লাখ নগরবাসীকে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় বাইরে মানুষের চলাচল কম ছিল।

এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নাগরিকরা। অনেকেই জলাবদ্ধতার ছবি ও ভিডিও পোস্ট করে ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্যও করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যদিও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) দাবি করেছে, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে ঢাকায় তাদের কয়েক হাজার কর্মী কাজ করেছেন।

শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, টানা বৃষ্টিতে  কাকরাইল, মোহাম্মদপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়াসহ মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা এবং মিরপুরে মাজার রোড, এলিফ্যান্ট রোড, মৎসভবন, সেন্ট্র্ল রোড, ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, তেজগাঁও, বিজয় স্মরণী, পশ্চিম তেজতুরী বাজার, তেজকুনি পাড়া, দক্ষিণ মনিপুরের মোল্লাপাড়া, গুলশান, নিকেতন, মহাখালীর বিভিন্ন রাস্তায় পানি জমেছে।

এছাড়া শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, কাকরাইল, নয়া পল্টন, পুরানা পল্টন, আরামবাগ, শাহজাহানপুর, ফকিরেরপুল, বিজয়নগর সড়কে পানি উঠেছে। পানিতে তলিয়েছে দয়াগঞ্জ মোড়, সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল, নিমতলী, যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, গোলাপবাগের নিচু এলাকাসহ আরো কয়েক এলাকা।

নিউমার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, জলাবদ্ধতার কারণে দোকানের মালামাল পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। কোমর পানিতে নেমে অনেকেই মালামাল পানি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। একই অবস্থা দেখা গেছে আশেপাশের মার্কেটগুলোতেও। জলাবদ্ধতার কারণে নিউমার্কেট, গাউসিয়া, চাঁদনীচক, নুরজাহান মার্কেটসহ অন্যান্য মার্কেটগুলো বন্ধ ছিল।

নিউ মার্কেট এলাকার ফুটপাতে কাপড়ের দোকানি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এতো পানি যে আমার মালামাল কি অবস্থায় আছে বুঝতে পারছি না। যারাই ভেতরে যাচ্ছে কেউ বলছে বুক পানি, কেউ বলছে কোমর পানি।

সাঁতরে গিয়ে নিজের দোকানের মাল সরিয়ে আসা সাইদ সজীব বলেন, অনেক পানি ভেতরে একপর্যায়ে যাওয়ার পর আর হাঁটতে পারি নাই সাঁতরে গিয়েছি দোকান পর্যন্ত। আমার জুতার দোকান কিন্তু যে জুতাই হাতে নিচ্ছি পানিতে ভিজে গেছে। যতটুকু বুঝছি আমার প্রায় ৫ থেকে ৮ লাখ টাকার মাল নষ্ট হয়েছে।

এদিকে মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে পানি ঢুকে সারি সারি করে রাখা চাল, চিনি আর ডালের বস্তা ডুবে গেছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বালতি আর ড্রাম নিয়ে মার্কেটের পানি বের করছেন ব্যবসায়ীরা। পানি আটকাতে গলির মুখে পেপার ও বস্তা দিয়ে আরও উঁচু করে দিয়েছেন। বিক্রি বন্ধ রেখে চাল-ডালের বস্তা বাঁচাতেই ব্যস্ত তারা।

কৃষি মার্কেটের চালের আড়তের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম মন্টু বলেন, এ মার্কেটে পাইকারি পণ্যের দোকান আছে দুইশর মতো। এর মধ্যে শতাধিক দোকানের চাল, ডাল, চিনি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরুপণ করা যায়নি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি ৯ থেকে ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

নাখালপাড়ার বাসিন্দা সফুরা বেগম বলেন, সকালে বাচ্চাগুলো কিছুই খায়নি। বাধ্য হয়েই বের হলাম। কয়দিন আগেই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করল। কিন্তু, লাভ হয়নি কোনো। প্রায় কোমরসমান পানি। এই জ্বালার কোনো সমাধানই নাই।

মিরপুর ২-এর বাসিন্দা তৌহিদা সুমি বলেন, সকাল ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হয়েও মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি জলাবদ্ধতার কারণে।

সুমি বলেন, বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাসা থেকে বের হয়েছিলাম কিন্তু বাসার সামনেই পানি থইথই করছিল। কোনো রিকশাও পাওয়া যাচ্ছিল না। পানি মাড়িয়ে কিছু দূর যাওয়ার পরও কোনো গাড়ি পাচ্ছিলাম না। পরে দেরি হয়ে যায় দেখে বাসায় ফিরে আসছি।

বৃষ্টিতে কেন বারবার ডুবছে ঢাকা- এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আমাদের আসলে উন্নয়নের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে গেছে। এই উন্নয়ন হচ্ছে ধ্বংসাত্মক উন্নয়ন। আমাদের ঢাকা শহরে খাল বা জলাশয় এখন ৫ শতাংশের নিচে। আর সবুজ ৭ ভাগের নিচে। ফলে, পানি নিষ্কাশনের সুযোগ নেই। যদি, জলাশয় ভরাট করা না হতো এবং পর্যাপ্ত সবুজ থাকত, তাহলে হয়ত এমন চিত্র হত না।

তিনি বলেন, কংক্রিট নিয়ে আমরা একটা গবেষণা করেছিলাম, যেখানে ঢাকার উন্নত এলাকাগুলোতে ৮০ শতাংশের উপর কংক্রিট। কোথাও-কোথাও ৯০ শতাংশ। ফলে, পানি নিষ্কাশনের সুযোগ নেই। এই জলাবদ্ধতা আমাদের মেনে নিতেই হবে। আমরা যেটা করতে পারি, যে ড্রেনেজ সিস্টেম এবং জলাশয় অবশিষ্ট আছে, সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা করে জলাশয় ভরাট করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

এদিকে নগরবাসীর অভিযোগ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। পানি যেতে পারছে না। উল্টো কোথাও কোথাও পানি ড্রেনের ঢাকনার মুখ দিয়ে ওপরে বের হয়ে আসছে। আগে থেকে সতর্ক থাকা উচিত কর্তৃপক্ষের। ছুটির দিন হওয়ায় গণপরিবহন কম। রিকশা ছাড়া চলাচলের উপায় নেই। রিকশাচালকরা পঞ্চাশ টাকার ভাড়া ১৫০-২০০ টাকা দাবি করছেন।

জানা যায়, সড়ক থেকে পানি সরাতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৬ হাজার কর্মী কাজ করেছেন। তবে রাত পর্যন্ত পর্যন্ত রাজধানীর অনেক সড়কে পানি জমে ছিল। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে জানানো হয়েছে, রাস্তা থেকে পানি সরাতে সকাল থেকেই কাজ চলছে।

ঢাকা উত্তর সিটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন পাঁচ হাজারের বেশি পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এ ছাড়াও সংস্থাটির ১০টি অঞ্চলে কাজ করছে ১০টি কুইক রেসপন্স টিম। প্রতিটি কুইক রেসপন্স টিমে ১০ জন কর্মী রয়েছেন। ইতিমধ্যে প্রধান প্রধান সড়কে থেকে পানিনিষ্কাশন করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।

কোথাও কোনো পানি জমে থাকলে ঢাকা উত্তর সিটির হটলাইন ১৬১০৬ নম্বরে ফোন করে জানাতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এদিকে জলাবদ্ধাত নিরসনের লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও প্রকৌশলী বিভাগের সমন্বয়ে ১০০টি টিম মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে বলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এই সংস্থা গঠিত প্রতিটি টিমে ১০ জন করে রয়েছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির জনসংযোগ শাখা থেকে জানানো হয়েছে, কমলাপুর টিটি পাড়া পাম্প স্টেশনে পাঁচ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বড় পাম্প এবং পাঁচ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি ছোট পাম্প চালু রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ধোলাইখাল পাম্প স্টেশনে সাত দশমিক পাঁচ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি পাম্পও চালু রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বড় চারটি ও ছোট তিনটি পাম্প মিলিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ২৫ হাজার ৪২৫ লিটার পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে।

সাড়ে চার বছর আগে নির্বাচনের সময় ঢাকার দুই মেয়র জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়াদের শেষ সময়ে এসেও জলাবদ্ধতার কোনো সমাধান করতে না পারাকে তাদের ব্যর্থতা হিসাবে দেখছেন নগরবাসী। যদিও জলাবদ্ধতার জন্য জলাশয় ভরাট ও দখলকে দায়ী করছেন মেয়রদ্বয়।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, চলতি বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক অবস্থায় রাজধানীতে একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে আজ। ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় গত ২৭ মে রাজধানীতে একদিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছিল ২২৪ মিলিমিটার।

আবহাওয়াবিদ মো. তরিফুল নেওয়াজ কবির জানান, নিয়ম অনুসারে প্রতি তিন ঘণ্টা পরপর বৃষ্টি পরিমাপ করা হয়। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৬০ মিলিমিটার। পরের তিন ঘণ্টায় পরিমাণ আরও বেড়েছে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৭০ মিলিমিটার। সবমিলে ৬ ঘণ্টায় বৃষ্টির পরিমাণ রেকর্ড করা হয় ১৩০ মিলিমিটার।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft