শিরোনাম: |
অপ্রতিরোধ্য বাজার সিন্ডিকেট : মজুতের শাস্তি আটকে আছে বিধিতে
|
এসএম শামসুজ্জোহা : দেশে খাদ্যপণ্যের অবৈধ মজুদ, উৎপাদন, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিপণন ও বিতরণে ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট আইন পাস হলেও নির্দিষ্ট বিধিমালা না থাকায়; তা কার্যকর করতে পারছে না সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধ মজুদদারি গড়ে তুলছে। এতে করে খাদ্যপণ্যের বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। রমজানের আগে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সামাল দিতে বর্তমানে কঠোর সরকার। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে মজুদবিরোধী অভিযান ও জেল-জরিমানার ওপর জোর দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী। চালের বাজার ও দাম নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক পর্যবেক্ষক দল। কিন্তু আইন থাকার পরও বিধিমালা না থাকায় অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে আইনি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। খাদ্যপণ্যের অবৈধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রনে সারাদেশে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে খাদ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তর বলছে, খাদ্যপণ্য সংক্রান্ত ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধের নিয়মিত অভিযানে ভোক্তা সংরক্ষণ আইন, কৃষি বিপণন আইনের আওতায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। তাদের মতে, নতুন আইন কার্যকর হলে খাদ্যপণ্যের অবৈধ মজুদসহ অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হবে। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, আইনের সবকিছু চূড়ান্ত। এটি ভেটিং-এর অপেক্ষায় আইন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। তাদের সাথে কথা হয়েছে; এটি দ্রুত সম্পন্ন করার ব্যাপারে আশা করছি দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা গেজেট প্রকাশ করতে পারব। জানা গেছে, অযৌক্তিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের বড় সংকট। যখন বাড়তে থাকে তখন একটার পর একটা পণ্যের দাম বাড়ে। ডিমের দাম না কমতেই আলু, আলুর দাম না কমতেই বাড়ে পেঁয়াজের দাম। তেল, চিনির ক্ষেত্রেও তাই। প্রসেস করা খাদ্যের দাম যখন বাড়ে তখনো সব কোম্পানিই একের পর এক বাড়াতে থাকে পণ্যেরমূল্য। কিছু ক্ষেত্রে যৌক্তিক কারণ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দাম বাড়ে সিন্ডিকেটের কারণে। আর এসব সিন্ডিকেট ভাঙতে দেশে শক্তিশালী কোনো আইন নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে এসব অপরাধ প্রতিরোধে আইনের বড় দুর্বলতা রয়েছে; যা আছে তারও প্রয়োগ কম। আবার কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে ‘গুরু পাপে লঘু দন্ড’ নির্ধারিত রয়েছে। যে কারণে বারবার বেপরোয়া হয়ে উঠছেন ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লুটে নিচ্ছেন অবৈধ মুনাফা। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে পণ্যের উচ্চমূল্য শুধু বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণেই নয়। এর পেছনে আছে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজারের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা। অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত সপ্তাহে সারাদেশে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ব্যবসায়ীদের ৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অভিযান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন আইন অনুযায়ী একজন ব্যবসায়ী অবৈধ উদ্দেশ্যে খাদ্যপণ্য মজুদ করলে যে শাস্তি পাবে; চলমান শাস্তি তার তুলনায় অনেক কম। বিধিমালার মাধ্যমে নতুন আইন কার্যকর হলে অবৈধ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হবে বলেও আশাবাদী তারা। তথ্য বলছে, বাজার তদারকিতে ভোক্তা অধিকার আইনের আওতায় তৎপরতা সবচেয়ে বেশি হলেও দেশে এ আইনে বিচার শেষে সাজা হয়েছে; এমন উদাহরণ নেই। বাজারে কোনো পণ্য অধিক দামে বিক্রির প্রমাণ মিললে এক-দুই হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই পরিমাণ জরিমানা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীর কিছু সময়ের অবৈধ মুনাফার সমান। এছাড়া আইনের অন্য ধারারও তেমন প্রয়োগ নেই। এ পরিস্থিতিতে প্রচলিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন সংশোধন ও সময়োপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার- এমনটাই জানিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম (টিটু) এমপি। সম্প্রতি তিনি সংসদে বলেছেন বলেছেন, ‘সিন্ডিকেটগুলো সব সময় বাজারে কারসাজি করে মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ খোঁজে। এসব অবৈধ কারবারি চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে আমরাও সদা সক্রিয়। সেজন্য এ আইন অনেক ক্ষেত্রে যথার্থ নয়। আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বাজার তদারকির ক্ষমতা থাকলেও তাদের বিচারিক ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ, শুধু জরিমানা করতে পারে। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, আমরা কাউকে কারাদন্ড দিতে পারি না। সেক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর মামলা করতে হবে। সেখানে কারাদন্ড হবে। এছাড়া জেলা প্রশাসন থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা চাইলে কারাদন্ড দিতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে বিচারিক ক্ষমতা দিলে ভালো হয়। এ আইনের ২৪ ধারা অনুযায়ী, মহাপরিচালক বা সরকারের কাছ থেকে এই উদ্দেশ্যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা যদি মনে করেন কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করেছেন; তাহলে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করতে পারে। সেজন্য মাঝে-মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা ও জরিমানা করা ছাড়া ভোক্তা অধিকারের তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। কারসাজি বা সিন্ডিকেট করে কেউ যাতে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে না পারে, সেজন্য প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো; ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা। প্রতিযোগিতা আইনের ১৫ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও বিতরণ সংক্রান্ত এমন কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে না। যা বাজারে সেই পণ্যের দাম নির্ধারণ বা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে বা বিস্তারের কারণ ঘটায় কিংবা বাজারে মনোপলি অথবা ওলিগপলি অবস্থার সৃষ্টি করে। দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা প্রায়ই অভিযোগ করেন; বড় ব্যবসায়ী বা করপোরেট প্রতিষ্ঠাগুলো বাজারে একচেটিয়া অবস্থানের কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে। কোম্পানিগুলো প্রচলিত প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘন করে বাজারে কর্তৃত্বমূলক অবস্থা বজায় রেখে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতা কমিশন এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয় না বলে অভিযোগ। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভোক্তারাও। তারা বলছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় এই সিন্ডিকেট আরো শক্তিশালী হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো ও মজুতদারদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত- এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ভোক্তা অধিকারের যে আইন আছে; সে আইনের মধ্যে তাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পাওয়ার দেওয়া আছে। তবে মামলা করার ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়নি। ফলে তারা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ শাস্তি যেটা; সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। |