শিরোনাম: |
করোনার নতুন স্ট্রেইনে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে শিশুরা
|
বর্তমান ডেস্ক: বিশ্বজুড়ে করোনার নতুন স্ট্রেইনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অন্তত ৪০টি দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ স্থগিত করেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন নিয়ে আলোচনা করতে সদস্যদের বৈঠক ডেকেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। বিশেষজ্ঞরা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বাতিলের পরামর্শ দিলেও বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে ফ্লাইট বন্ধে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহাবুব আলী।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। যুক্তরাজ্য থেকে আসা যাত্রীরা ৭ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকবেন, কোয়ারেন্টিন শেষে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। পরে তারা বাড়িতে গিয়ে হোম কোয়ারেন্টিন করবেন। কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তারা বলছেন, হোম কোয়ারেন্টিন বলে কিছু নেই। গত মার্চে দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর দেশজুড়ে সেটি ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবেও তখন হোম কোয়ারেন্টিনকেই দায়ী করেছেন তারা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন এই স্ট্রেইনে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। আমাদের দেশে যদি এই ভেরিয়েন্ট ঢুকে যায় তাহলে শিশুরাই সবোর্চ্চ ঝুঁকিতে থাকবে, কারণ তাদের জন্য কোনও ভ্যাকসিন নেই। তারা বলছে, ‘এমনিতেই আমাদের খারাপ অবস্থা। তার ওপর যদি নতুন স্ট্রেইন চলে আসে বাংলাদেশে আরও অবস্থা খারাপ হবে। আর হোম কোয়ারেন্টিনে অভিজ্ঞতা কোনোভাবেই ঠিক নয়, আমাদের অতীত সেটা বলছে না।’ সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে নতুন বৈশিষ্ট্যের এই করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। তারপর তা গোটা যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অক্টোবরে ব্রিটেনে যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ৫০ শতাংশই এই নতুন বৈশিষ্ট্যের ভাইরাসের কবলে পড়েছেন। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে ৪৩ শতাংশ, পূর্ব ইংল্যান্ডে ৫৯ শতাংশ এবং লন্ডনে ৬২ শতাংশ নতুন সংক্রমণের পেছনে এ রূপান্তরিত স্ট্রেইন দায়ী। ইংল্যান্ডের প্রধান মেডিক্যাল কর্মকর্তা অধ্যাপক ক্রিস হুইটি বলেছেন, ‘গত কয়েক সপ্তাহে খুব দ্রুত এর সংক্রমণ বেড়েছে।’ করোনাভাইরাসের নতুন এ স্ট্রেইনটির ২৩টি ভিন্ন ভিন্ন পরিবর্তন দেখা গেছে। যুক্তরাজ্যের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা প্যাট্রিক ভ্যালান্স বলছেন, ‘অস্বাভাবিকভাবে বড় সংখ্যায় এর রূপান্তর দেখা গেছে।’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, ভাইরাসের নতুন রূপান্তরিত স্ট্রেইন (ভিইউআই-২০২০১২/০১) ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি সংক্রামক হতে পারে। এছাড়া নতুন বৈশিষ্ট্যের এই করোনা ব্যাপক হারে শিশুদেরকে সংক্রমিত করছে। সে কারণেই উদ্বিগ্ন বিশ্ব। ইউরোপ, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আমেরিকার অন্তত ৪০টি দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘প্রথমেই উচিত ছিল যুক্তরাজ্য থেকে আসা ফ্লাইট বাতিল করা। কিন্তু সেটা তো হলো, আর ফ্লাইট বাতিল না হলে পরবর্তীতে যে মারাত্মক কিছু ঘটতে পারে সে দায়-দায়িত্ব যারা বন্ধ করলো না তাদের ওপরই বর্তাবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে এখন আইসিইউতে শয্যা নেই, স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্ধারিত তালিকার হাসপাতালের বাইরেও প্রতিটি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি রয়েছে। কোনোভাবে যদি নতুন এ স্ট্রেইন বাংলাদেশে ঢুকে যায় তাহলে সেটা ভয়ঙ্কর হবে—এটা নিশ্চিত’। তিনি বলেন, ‘কেবল বিমানবন্দর দিয়ে মানুষ আসছে তা নয়, ২৬টি স্থল বন্দর, নৌ-বন্দর, সমুদ্র বন্দর-সবগুলোতেই সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের অবস্থা যেখানে এতই নাজুক, সেখানে এই বন্দরগুলোতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত।’ যুক্তরাজ্যফেরতরা ৭ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের পর হোম কোয়ারেন্টিনের থাকবেন—স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘হোম কোয়ারেন্টিন বলে কিছু নাই, কোনোদিন সম্ভব নয়’। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, অন্য দেশ যা করেছে আমাদেরও তাই করা উচিত, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করা উচিত। সাত দিনের কোয়ারেন্টিনের কথা বলেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। কিন্তু আসলেই তাদেরকে কোয়ারেন্টিন করা সম্ভব হবে কিনা মন্তব্য করে তিনি বলেন, অতীত অভিজ্ঞতা সেটা বলে না। তিনি বলেন, ‘এই ভেরিয়েন্ট যদি বাংলাদেশে আসে তাহলে সংক্রমণের হার বাড়বে, মৃত্যুহার বাড়বে। সংক্রমণের সংখ্যা বাড়লে রোগী বাড়বে, রোগী বাড়লে আনুপাতিক হারে হাসপাতালে ভর্তি বাড়বে এবং আনুপাতিক হারে আইসিইউ রিকোয়ারমেন্ট বেড়ে যাবে—এটা অনেক বড় সমস্যা হবে আমাদের জন্য।’ তিনি আরও বলেন, এই ভেরিয়েন্টে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এতদিন শিশুদের আক্রান্তের হার বেশি না থাকলেও এখন সেটা বেড়ে যেতে পারে। আর যদি এই ভেরিয়েন্ট আরও পরিবর্তিত হতে থাকে , যদি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে, তাহলে সেটা হবে বড় সমস্যা। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি নতুন এই স্ট্রেইন বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ কী হতে পারে বিষয়ে বৈঠক করেছে। সেখানে সাতদিন নয় ১৪ দিনের ফুল কোয়ারেন্টিন অর্থাৎ পরীক্ষা করে নেগেটিভ না আসা পর্যন্ত তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের কথা সুপারিশ করেছেন তারা। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হোম কোয়ারেন্টিন প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্যের সমালোচনা করে কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শুরুর দিকে চীনসহ নানা দেশ থেকে যারা এসেছেন তাদের ছেড়ে দিয়ে হোম কোয়ারেন্টিনের জন্য বলা হয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিল প্রথম মারাত্মক ভুল। হোম কোয়ারেন্টিন বাংলাদেশে হয়নি, হবেও না।’ তিনি বলেন, ‘এই অভিজ্ঞতার পর যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হোম কোয়ারেন্টিন করার কথা বলে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাতে ফেলে তাহলে সেটা আর ভুল হবে না, হবে ক্রাইম, ভীষণ বড় ক্রাইম। কারণ এটা শিশুদের বেশি সংক্রমিত করছে এবং শিশুদের জন্য কোনও ভ্যাকসিন নেই, ১৮ বছরের নিচে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে না। কিন্তু এরাই এখন সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে।’ এদেরকে কোনোভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাতে ফেলা যাবে না মন্তব্য করে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শিশুদের বাঁচানোর একমাত্র উপায় এই ভাইরাস থেকে তাদের দূরে রাখা। তাই অন্তত দুই সপ্তাহ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ রাখা উচিত। অথবা যদি এসেই যায় তাহলে একেবারে নেগেটিভ না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা।’ |