শিরোনাম: |
আলোচিত রিফাত হত্যা মামলার রায়
মিন্নিসহ ৬ জনের ফাঁসি
|
বর্তমান প্রতিবেদক : বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয়জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই মামলায় ৪ জনকে খালাস প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন আদালত। গতকাল বুধবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান। মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ভূবন চন্দ্র হালদার এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। ফাঁসির দøপ্রাপ্তরা হলেন- মো. রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯) ও আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি (১৯)। এছাড়া এ মামলায় চার আসামিকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- মো. মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), মো. সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সায়মুন (২১)। রায় ঘোষণার সময় দণ্ডপ্রাপ্ত রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজি, আল কাইউম ওরফে রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, মো. হাসান, রাফিউল ইসলাম রাব্বি, মো. সাগর এবং কামরুল ইসলাম সাইমুন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। ১০ আসামির মধ্যে মুসা পলাতক এবং মিন্নি জামিনে। মুসা ছাড়া বাকিরা রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মজিবুল হক কিসলু জানান, ২শ পাতার রায়ের মূল অংশ এবং সাজার অংশ বিচারককে পড়ে শোনানোর জন্য অনুরোধ আইনজীবীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়। সে অনুযায়ী তিনি ১টা ১০ মিনিটে এজলাসে ওঠেন এবং সোয়া ১টায় রায় পড়া শুরু করেন। যে রায় পড়া পৌনে ২টায় শেষ হয়। ৩৫ মিনিট ধরে চলা রায় ঘোষণার সময় কাঠগড়ায় রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ সব আসামি উপস্থিত ছিলেন। এ সময় নিজের মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা শুনেও বিচলিত হননি মিন্নি। তষ্ঠাকে এ সময় আতঙ্কিত বা কাঁদতে দেখা যায়নি। রায় শেষে এমন তথ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এম. মজিবুল হক কিসলু। তিনি বলেন, বিচারক যখন রায় ঘোষণা করেন, রায়ে ফাঁসির আদেশের কথা শুনেও মিন্নি বিচলিত হননি। তাছাড়া চোখের পানিও ঝরতে দেখিনি। আমি ভেবেছিলাম, ফাঁসির আদেশের কথা শুনে মিন্নি অসুস্থ হবেন বা জ্ঞান হারাবেন, কিন্তু তা দেখা যায়নি। তষ্ঠাকে সুস্থ স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। এ রায়কে যুগান্তকারী উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিন্নি যে সত্যিকারের অপরাধী এবং এ হত্যাকাণ্ডে মূল হোতা, তা আজ এ রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো। রায়ের পর কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ২টা ৫০ মিনিটে মিন্নিকে আদালত থেকে ডিবির একটি কালো মাইক্রোবাসে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এর ১০ মিনিট পর ফাঁসির সব আসামিদের পুলিশের প্রিজন ভ্যানে কারাগারে নেওয়া হয়। এ সময় অন্য একটি গাড়িতে খালাসপ্রাপ্তদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। আইনি প্রক্রিয়া শেষে খালাসপ্রাপ্তদের জামিনে মুক্ত করা হবে। এদিকে আদালত প্রাঙ্গনে চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যা মামলার রায় শুনতে সকাল থেকেই ভিড় করে উৎসুক জনতা। আদালত প্রাঙ্গনে একাধিক ব্যক্তি জানান, এ রায়ে শুধু বরগুনাবাসী নয় গোটা দেশবাসী খুশি হয়েছে। আদালত যে রায় দিয়েছে এটি নজিরবিহীন। সন্তুষ্ট রিফাতের বাবা ও রাষ্ট্রপক্ষ: রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহত রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। রায় শুনে আদালতে কেঁদে ফেলেন তিনি। রায় ঘোষণার পর রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বলেন, এক বছর ধরে আমাদের পরিবারের সদস্যরা কাঁদছি। আমাদের নির্ঘুম দিন কাটছে। ওই কান্না আর আজকের কান্নার মধ্যে অনেক তফাত। ১৫টা মাস এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। রায়ে রিফাতের আত্মা শান্তি পাবে। তিনি বলেন, আমরা সুবিচার পেয়েছি। তবে রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। কাক্সিক্ষত রায় পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান দুলাল শরীফ। রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং বরগুনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর মোস্তাফিজুর রহমান বাবু সাংবাদিকদের বলেন, বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। এ মামলায় মিন্নিসহ ছয়জনের ফাঁসির রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বলেন, রিফাত হত্যা মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। তাই প্রত্যাশিত রায় পেয়েছি। রায়ে প্রমাণ হলো অপরাধী যেই হোক ছাড় নেই। এ মামলার রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিতি হয়েছে। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে জেলা দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর সঞ্জীব দাস ও আইনজীবী মজিবুল হক কিসলু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। রায়ে অসন্তোষ মিন্নির বাবা ও আইনজীবী: রায়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে মিন্নির বাবা বাবা মো. মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। কিন্তু মিন্নির প্রতি অবিচার করা হয়েছে। আমরা উচ্চ আদালতে যাব। মামলার রায় প্রত্যাশিত হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন মামলার অন্যতম আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম। গতকাল বুধবার দুপুরে রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ মন্তব্য করেন। মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম বলেন, রায় মেনে নিতে হবে। এ রায় আমরা মেনে নিয়েছি, তবে আমরা সংক্ষুব্ধ। আমরা উচ্চ আদালতে যাব। উচ্চ আদালতে মিন্নি খালাস পাবে বলে আশা করছি। এদিকে ফাঁসির দøপ্রাপ্ত আসামি মো. রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী রায়ের পর হাসতে হাসতে আদালত থেকে বেরিয়ে প্রিজনভ্যানে ওঠেন। এ সময় তিনি বলেন, আমরা সব আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলাম। অতীতে যা হয়েছে তা আল্লাহ করেছেন আর ভবিষ্যতে যা হবে সেটাও আল্লাহই করবেন। গতকাল বুধবার দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে আদালত থেকে আসামিদের কারাগারে নেয়ার সময় প্রিজনভ্যানে ওঠার মুহূর্তে এসব কথা বলেন রিফাত ফরাজি। তবে আশপাশের শব্দের কারণে তার বাকি বক্তব্য স্পষ্ট শোনা যায়নি। এ সময় শুধু আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন ছাড়া বাকি সাজাপ্রাপ্তরা স্বাভাবিক ছিলেন। মিন্নিকে হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড বললেন আদালত: রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন মিন্নি। তারই পরিকল্পনায় রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান বলেন, রিফাত হত্যা মামলার আসামিদের নির্মম বর্বরতা ও নির্মমতা মধ্যযুগীয় কায়দায়কেও হার মানিয়েছে। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে তষ্ঠাদের অনুসরণ করে অন্য যুবকরাও ধ্বংসের পথে যাবে। এসব আসামি সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। রায় ঘোষণার সময় বিচারক বলেন, পাঁচজনের সহযোগী হিসেবে রিফাত শরীফ হত্যায় অংশ নিয়েছেন স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। একই সঙ্গে তারা ছয়জন রিফাতের মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন। এজন্য কলেজগেটের সামনে সময়ক্ষেপণ করেন মিন্নি। রিফাতকে যখন মারার জন্য আসামিরা নিয়ে যাচ্ছিল তখন স্বাভাবিক ছিলেন মিন্নি। এতেই প্রমাণিত হয়, মিন্নি হত্যা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তারই পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ডে ঘটেছে। এজন্য তষ্ঠাকেও ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এসব তথ্য নিশ্চিত করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মজিবুল হক কিসলু বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলেছিলাম, আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির ষড়যন্ত্রের কারণে রিফাত হত্যাকাণ্ডে ঘটেছে। আদালতে রায়ের পর্যবেক্ষণে তাই উঠে এসেছে। রিফাত শরীফকে হত্যা পরিকল্পনা করেছেন মিন্নি। একই সঙ্গে আসামিদের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। এজন্য মিন্নিকে ফাঁসি দিয়েছেন আদালত। বাদী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে আগেও বলেছেন, মিন্নি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এ হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি রিফাত ফরাজি, তিন নম্বর আসামি রিশান ফরাজি, ছয় নম্বর আসামি রাব্বি আকন এবং ১২ নম্বর আসামি টিকটক হৃদয় হত্যাকাণ্ড মিন্নির সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া মিন্নি নিজেও রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে আরও বলেছেন, নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির বিয়ে হয়েছিল এবং সেই বিয়ে বলবৎ থাকার পাশাপাশি বিয়ের তথ্য গোপন করে ধর্মীয় এবং দেশের প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করে মিন্নি রিফাত শরীফকে বিয়ে করে। এর প্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করেন তারা। এছাড়া হত্যাকাণ্ডের আগের দিন নয়ন বন্ডের বাসায় গিয়ে নয়ন বন্ডের সঙ্গে দেখা করে রিফাতকে হত্যার পরিকল্পনা করেন মিন্নি। আদালতে হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে মিন্নির সঙ্গে হত্যাকারীদের মোবাইল ফোনে কথোপকথনের তালিকার পাশাপাশি মেসেজ আদান-প্রদানের তথ্য তুলে ধরেন; আদালতকে হত্যাকাণ্ডের দিন সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখান আইনজীবীরা। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে শত শত লোকের ভিড়ে রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ঘটনার পরদিন ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও পাঁচ-ছয়জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন নিহত রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক দুভাগে বিভক্ত করে ২৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। এতে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। ১ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত। এরপর ৮ জানুয়ারি থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন আদালত। এ মামলায় মোট ৭৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর এ মামলার দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আসাদুজ্জামান রায়ের জন্য গতকাল বুধবার দিন ধার্য করেন। |