শিরোনাম: |
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও সংবিধানের চার মূলনীতি
|
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন : বাঙালির জাতীয় জীবনে একাত্তরের ৭ মার্চ অন্য যে কোনো দিনের মতো ছিল না। যদিও দিনটি ছিল ফাল্গুনের অন্যান্য দিনগুলোর মতোই পাতা ঝরার দিন। ফাল্গুনের দিনটি ছিল- না শীত, না গরম। আকাশ পরিষ্কার ছিল, কিন্তু সেদিন চড়া রোদ ছিল না। রেসকোর্স ময়দানে সেদিন যে সমাবেশ হয়, সেটি অতীতের কোনো সমাবেশের সঙ্গেও তুলনীয় নয়। শেখ মুজিবুর রহমান অতীতে বহু সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন, কিন্তু সেদিন তিনি ১৮ মিনিটের যে ভাষণ দেন, সেটি ছিল তার জীবনের অনন্য এক ভাষণ। এ ভাষণের কারণেই বিশ্ব বিখ্যাত গণমাধ্যম নিউজ উইক বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দলটির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল- যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। অপ্রত্যাশিতভাবে ১ মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। এমন সংবাদে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় তিনি সমগ্র পূর্ব-বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই পটভূমিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে বিপুল সংখ্যক লোক একত্রিত হয়। পুরো ময়দান পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে। ৭ মার্চ ঢাকা মিছিলের শহরে পরিণত হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে লোকজন পায়ে হেঁটে, বাস, লঞ্চ কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষে পরিপূর্ণ হয়েছিল রেসকোর্স ময়দান। মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়েছিল উত্থিত বাঁশের লাঠি হাতে সমবেত লাখ লাখ বিক্ষুব্ধ জনতা। বাতাসে উড়ছিল বাংলাদেশ মানচিত্র আঁকা লাল-সূর্যের অসংখ্য পতাকা। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন দৃপ্তপায়ে উঠে আসেন রেসকোর্সের সমাবেশ মঞ্চে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে গগন বিদারী স্লোগান আর অসংখ্য করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান অপেক্ষমান জনতার উদ্দেশে। তারপর শুরু করেন ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। ...... আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’ তারপর বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাবডিভিশনে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো। এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ ভাষণটি বিচার বিশ্লেষণ করলে আমাদের সামনে ফুটে উঠে- তখনকার সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা; নিজ ভূমিকা ও অবস্থান ব্যাখ্যা; পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত; সামরিক আইন প্রত্যাহারের আহ্বান; অত্যাচার ও সামরিক আগ্রাসন মোকাবিলার হুমকি; দাবি আদায় না-হওয়া পর্যন্ত পূর্ব-পাকিস্তানে সার্বিক হরতাল চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা; নিগ্রহ ও আক্রমণ প্রতিরোধের আহ্বান। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে তুলে দেন হিমালয়সম এক উচ্চতায়। ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীর ব্যারাকে ফিরে যাওয়া, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা দাবিও উত্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে করে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত। ব্র্রিটেনের বাম বুদ্ধিজীবী জ্যাক ওয়াডিস বলেছেন, আমেরিকার গেটিসবার্গে প্রদত্ত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ঘোষণা। যেখানে তিনি জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। কার্ল মার্কসের সাম্যবাদী কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো, যাতে কার্ল মার্কস সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। অতঃপর তিনি নির্দ্বিধায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদিও এই ভাষণটিতে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আসলে এটি তার সমকালীন বিশ্বে সব নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের দিক-নির্দেশনা।’ ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হত্যার পর যখন জ্যাক ওয়াডিস লন্ডনের বিখ্যাত ‘সোস্যালিস্ট ওয়ার্কার্স’ পত্রিকায় এই কথাগুলো লেখেন, তখন বাংলাদেশি কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটির অতি মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। তার কিছুকাল পরেই দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন সম্পর্কে প্রকাশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত বলছেন, ‘সন্ত্রাসের পথ নয়, শেখ মুজিবের জনযুদ্ধের পদ্ধতির মধ্যেই রয়েছে নির্যাতিত প্যালেস্টাইনিদেরও মুক্তির পথ।’ শেষ পর্যন্ত লন্ডন থেকে প্রকাশিত জ্যাকব এফ ফিল্ড কর্তৃক সংকলিত ও সম্পাদিত ‘ডব ংযধষষ ভরমযঃ ড়হ ঃযব নবধপযবং: ঃযব ংঢ়ববপযবং ঃযধঃ রহংঢ়রত্বফ যরংঃড়ত্ু’ নামক গ্রন্থে খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত ইতিহাসের অগ্রযাত্রার সহায়ক ঘোষণাগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণাও স্থান পেয়েছে। ২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষে ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ওয়াল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এই ভাষণটিসহ মোট ৭৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথিকে একইসঙ্গে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইউনেস্কো পুরো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে সংরক্ষিত করে থাকে। ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ)’ ৭ মার্চের ভাষণসহ এখন পর্যন্ত ৪২৭টি গুরত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ ‘ওয়াল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ স্বীকৃতি পাওয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় জননেত্রী শেখ হাসিনা একে ইতিহাসের প্রতিশোধ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক জাফর ইকবাল ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যে’র স্বীকৃতি পাওয়া উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত নাগরিক সমাবেশে বলেন, ‘আমি সেই উদ্যানে দাঁড়িয়েছি, যেখানে বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে খুব কম জাতি আছে, যারা দাবি করতে পারবে, একটি দেশ ও একটি মানুষ সমার্থক। আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা তা দাবি করতে পারি। কারণ বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক। যদি বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হতো আমরা এই বাংলাদেশ পেতাম না। আমাদের খুব সৌভাগ্য যে, এই দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল। তিনি সমস্ত বাঙালিকে একত্র করেছিলেন। তিনি আমাদের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। যেই স্বপ্ন দেখে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে আমাদের এই দেশ উপহার দিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি শিক্ষক মানুষ, আমি আমার ছাত্রদের বলি তোমরা দেশকে ভালোবাসো। দেশকে ভালোবাসার সোজা রাস্তা কী? সোজা রাস্তা হলো- দেশের ইতিহাসকে জানো। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটি জানো, তাহলে তুমি অবশ্যই দেশকে ভালোবাসবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যদি জানতে হয়, আমাদের সবাইকে ৭ মার্চের ভাষণকে জানতে হবে।’ বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করতে না পারে, সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তার এই সতর্ক কৌশলের কারণেই জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে শেখ মুজিবকে ‘চতুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘২০১৫ সালে কানাডার একজন অধ্যাপক সারাবিশ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। সেখানেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল। তখন ভাষণটি একাডেমিক স্বীকৃতি পেলেও এবার পেল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।’ (চলবে...) লেখক : ভাইস-চ্যান্সেলর, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সন্তোষ, টাঙ্গাইল। |