রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনার প্রতীক ২১ ফেব্রুয়ারি
Published : Tuesday, 20 February, 2018 at 6:00 AM, Count : 933

স্বপন কুমার সাহা : ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বপণ করেছিল। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় ও গর্বের দিন হিসেবে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে বসবাসকারী বাঙ্গালীরা। বাঙ্গালীজাতি ও বিশ্ববাসীকে ধর্মান্ধতার অন্ধকার থেকে আলোর পথে ও অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চেতনার জগতে মানব জাতিকে উজ্জীবিত করে চলছে।
ভাষা আন্দোলনের চেতনা শুধু বাঙালি ও বাংলাদেশের একক সম্পদ নয়। এ চেতনা এখন বিশ্ববাসী ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সনদ হিসেবে স্বীকৃত। তাই এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আমরা বাঙালি জাতি এ অর্জনে গর্ববোধ করি এবং বিশ্ববাসী ২১’র চেতনা ধারণ করে বাঙালি দামাল ছেলেদের আত্মাহুতির এ দিনটিকে তাত্পর্যপূর্ণ দিন হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমরা সেই চেতনার মন্ত্রে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি....’ গাইতে গাইতে শহীদ মিনারে পাদমূলে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মাধ্যমে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ৫২’র আত্মত্যাগের দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
এ জন্য শহীদ, বরকত, সালাম ও জব্বারসহ মহান ভাষা আন্দোলনের সূর্যসৈনিকরা বাংলাদেশের ইতিহাসে বীরের মর্যাদা নিয়ে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে। মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়ার ইতিহাস বিশ্বে আর কোনো দেশে পাওয়া যায় না।
তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ওপরই শুধু নয়, বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছিল অর্থনৈতিকভাবেও। ছাত্র-জনতার কাছে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেলে পাকিস্তানের সঙ্গে আর আপোষ নয়। শুরু হয় মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আন্দোলন ও সংগ্রাম। পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থে বিভিন্ন দাবি দাওয়ার মাধ্যমে ধাপে ধাপে বেগবান হতে থাকে জনগণের আন্দোলনের গতি।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পরদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় প্রথম শহীদ মিনার। আন্দোলনের প্রতীকী মর্যাদা পাওয়ায় সেদিন বিকেলেই ঢাকা মেডিকেল হোস্টেল ঘেরাও করে মিনারটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর ১৯৫৭ সালে একটি নকশা তৈরি করেন শিল্পী হামিদুর রহমান। সে অনুযায়ী কাজ শেষ হলে মূল অংশের মঞ্চে দাঁড়ানো মা ও শহীদদের প্রতীক হিসেবে থাকত অর্ধবৃত্তকার স্তম্ভ। গায়ে হলুদ ও গাঢ় নীল কাচের গড়া কিছু চোখের প্রতীক, মিনারের সামনে থাকার কথা ছিল বাংলা বর্ণমালা খচিত একটি রেলিং। মিনারের পাশে জাদুঘর, পাঠাগার, দীর্ঘ দেয়ালচিত্র ছাড়াও নকশায় ছিল আরও বেশ কিছু পরিকল্পনা। কিন্তু সেসব কাজ বন্ধ হয়ে যায় ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পর। ’৬২ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের তত্কালীন গভর্নর আযম খানের নির্দেশে বদলে যায় মূল নকশা। পরিকল্পিত স্থাপত্যের বিস্তর অঙ্গহানির অভিযোগ ওঠে। পরে ’৬৩ সালে সে কাজ শেষ করা হয়। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সংক্ষিপ্ত নকশায় আবারও গড়া হয় শহীদ মিনার। গবেষকদের মতে, ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণ অনীহার কারণে স্থাপত্যটি মূল নকশা অনুয়ায়ী বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ২০১৮ সালের মধ্যে শহীদ মিনারের পরিসর বাড়ানো হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানা গেছে।
’৫২-র ভাষা আন্দোলন শহীদদের স্মরণে গড়ে ওঠে তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানে জাতীয় শহীদ মিনার। এই শহীদ মিনার বা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধকে ঘিরেই শুরু হয় বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে আন্দোলন। একইসঙ্গে জনগণকেও অধিকার আদায়ের চেতনাকে আরও শাণিত করে। তাই আজকের এই শহীদ মিনার হলো বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক উজ্জ্বল প্রতীক। শহীদ মিনার হলো বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের গৌরব। শহীদ মিনার হলো গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শহীদ মিনার হলো বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ধারা। তাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বাঙালির ঘরে ঘরে সুপরিচিত। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এই শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা এবং ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর ভূমিকা আন্তর্জাতিক পরিসরে বিদেশের বুকেও স্বীকৃতি লাভ করেছে।
কেননা শহীদ মিনার হলো একটি চেতনার প্রতীক। এই চেতনাকে নস্যাত্ করতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে শহীদ মিনারের ওপর আক্রমণ চালায় এবং শহীদ মিনারটিই ছিল পাকি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু।
১৯৭১ সালে বাঙালিরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতা অর্জনে পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের জন্য চূড়ান্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও বাঙালির জাতির ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে হানাদার বাহিনী শহীদ মিনারটিকেই গুঁড়িয়ে দেয়।
এসব কারণেই ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের ফলশ্রুতিতেই আজকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে সুপরিচিত ও বাঙালি জাতির গৌরব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের গৌরবময় আত্মত্যাগের মহীমা ধাপে ধাপে উজ্জীবিত হয়েছিল ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-র আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন। তারপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সর্বোপরি বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম। ৯ মাস পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে বীর বাঙালি। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১’র ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের লাল-সবুজের পতাকার দেশ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
একটি দেশের ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। যার নাম বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস থেকে ভিন্নতর। বাংলাভাষা আজ জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এটিই হলো বাংলাদেশের জনগণের গর্ব ও ঐতিহ্য। এই গর্ব ও ঐতিহ্য বাংলাদেশি জনগণের চলার পথকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলছে।
প্রতি বছরের ন্যায় ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। সেখানে বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশের সমন্বয়ে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি তুলে ধরা হয়।
অংশগ্রহণকারী দেশগুলোও সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ও তাদের আন্তরিক উদ্যমের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্বের কথাও তুলে ধরা হয়। অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, নেপাল, রাশিয়া, জার্মানি, মঙ্গোলিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়াসহ ইউরোপীয় অন্যান্য দেশ।
আসুন, আমরা মুক্তির মন্ত্রে- আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি.....
এই গান সমবেত কণ্ঠে গাইতে গাইতে আবহমান বাঙালির সংস্কৃতি, অসম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে পায়ে পায়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলি।
লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক বর্তমান।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft