বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
প্রাথমিক শিক্ষা ও কিছু কথা
Published : Tuesday, 30 January, 2018 at 6:00 AM, Count : 1113

প্রকৌশলী সাব্বির হোসেন : একটা সময় ছিল স্কুলে যেতে অনেক পথ পায়ে হাঁটতে হতো। দুপুর গড়িয়ে গেলে মা পথের দিকে তাকিয়ে ভাবতো- খোকা এখনও আসছে না, খুব কষ্ট হয় খোকার। অনেক মমতায় আদরে লালিত খোকার আসা অব্দি মা দুপুরের খাবার খেতো না। খোকা এলে তবেই মা খোকাকে খাইয়ে দিয়ে নিজে খেতেন। বাবা নামের কঠিন মানুষটি খোকার জন্য নতুন জুতো জামা এনে রেখে দিতেন খোকা ফিরলে লুকিয়ে দেখতেন খোকার উত্তেজনা আর সারাবাড়ি মাথায় তোলার সে কি আনন্দ! সবার চোখের আড়ালে এই বাবা খুশিতে চোখের জল ফেলতেন যা অপ্রকাশিতই থেকে যায়।
আজ আর স্কুল দূরে নয়, বাড়ি থেকে খানিক দূরেই একাধিক স্কুল। তাই সেই আনন্দ-বেদনাগুলো এখন ফিকে হয়েছে। ক্লাসে পড়া না পারলে স্যার খোকাদের বেত দিয়ে মারতেন, মানুষ হওয়ার জন্য। বাড়ি ফিরে জামা খুললেই মা সবার আগে দেখে কাঁদতেন আর বুঝাতেন বাবা ভালো করে পড়িস তোর গায়ের ব্যথা যে আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। মায়ের আকুতি ভরা কান্নার আড়ালে সান্ত্বনা ছিল একটাই মাস্টার মশায় তার খোকার ভালোর জন্যই মেরেছে। মায়ের কথায় খোকা পড়ায় মন দিলেও বাবার আত্মা শান্তি পেত না, খোকাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার করতে কোথায় ভালো স্যার আছেন খুঁজে বেড়াতেন, খবর পেলেই খোকাকে নিয়ে সেখানে সেই স্যারের কাছে পড়াতেন। এভাবে অনেক বাবাই তার নিজের স্বপ্ন খোকাদের দিয়ে পূরণ করেছেন। নতুন সাইকেল কিনে বাবা সারপ্রাইজ দিতেন। আবার অনেক বাবা খোকাদের পড়াতেন না, চাষা করে রাখতেন খোকাদের। নিজের উদ্যোগে লেখাপড়া শিখে অনেক খোকাই বিখ্যাত হয়েছেন। ডিজিটাল যুগে বাবা-মায়ের সেই ভালোবাসা আর দেখা যায় না। স্কুলের শিক্ষক এখন আর স্টুডেন্টদের মারেন না। সব কিছুতেই কেমন একটা আলগা আলগা মনে হয়। খোকাদের সঙ্গে এখন খুকিদেরও লেখাপড়ায় অংশগ্রহণ বেড়েছে। ঘরের কাজ যে খুকিদের প্রাত্যহিক কাজ ছিল সেই খুকিরা এখন অফিসের বস, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের সরব অংশগ্রহণ যা বর্তমান সরকারের নারীর ক্ষমতায়নের ইতিবাচক ফল।
সরকার নিয়ম করেছে শিক্ষার্থীদের শারিরিক ও মানসিক প্রহার করা যাবে না। এটা মেনেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের পাঠকার্যক্রম পরিচালনা করছে। সন্তানের গায়ে আঘাতের চিহ্ন দেখে মাকে আর কাঁদতে হয় না। তবে আজও বাবাদের খুঁজতে হয় ভালো শিক্ষক কিংবা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর এখানেই খোঁজতে গিয়ে বেড়িয়ে আসে অনেক দুঃখজনক ঘটনা, এটাকে প্রতারণাও বলা চলে। সরকারি প্রাথমিক কিংবা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর এখন আর বাবা-মা আস্থা রাখতে পারেন না। তাই দেশসেরা কিছু ক্যাডেট কোচিং নামধারী নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবকদের ধরনা দিতে দেখা যায়। বেশির ভাগ অভিভাবক এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদের ভর্তি করিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায় যে তাদের সন্তান সুশিক্ষা আর ভালো মানুষ হতে পারবে। কিন্তু কিছু ঘটনা তাদের চোখের পর্দা খুলে দেয়। আসলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামে বড় হলেও, এখানে শিক্ষকতা করেন উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা সম্মান এ অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। যাদের পাঠদানের ন্যূনতম প্রশিক্ষণ নেই। কথা হলো এসব শিক্ষকদের দিয়ে কতখানি উন্নয়ন হবে শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষক নিজেই লেখাপড়া শেষ করেনি। আর এই শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতো আরও দুর্বলতা প্রকাশ করে। দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার মাসিক বেতনের শিক্ষক দিয়েই চলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রশ্ন হলো শিক্ষা অফিসার কিংবা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কি এগুলোর খবর রাখেন? নাকি দেখেও না দেখে থাকেন? উত্তর এই দুটির যে কোনো একটি হলে বুঝতে হবে এ জাতি শিক্ষার দুনিয়ায় পিছিয়ে পরতে আর বেশি বাকি নেই। কাউকে ছোট বা অপমান করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। গাজীপুর শাহীন ক্যাডেট কোচিং মাওনা শাখায় একটি ক্লাসের সব শিক্ষার্থীদের প্রহার করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে জেলা প্রশাসক অভিযুক্ত শিক্ষককে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। যা গত সপ্তাহের গাজীপুরের লিড নিউজ এবং বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রচার হয়। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কথায় সেই শিক্ষক অযোগ্য তাই তাকে অপসারণ করা হয়েছে। তাহলে এই দাঁড়ালো এসব নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামের অন্তরালে অযোগ্যদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। আবার এই শিক্ষকদের বেতন কাঠামোও তাদের অযোগ্যতাকেই নির্দেশ করে। এবার জানতে হবে এসব কোচিং স্কুলে স্টুডেন্টদের মাসিক বেতন কত? প্রতিটি স্কুলে গড়ে বেতন ১২০০-১৮০০ টাকা যেখানে প্রতি ক্লাসে স্টুডেন্ট থাকে ২০ জন। সুতরাং হিসাব পরিষ্কার এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় শিক্ষা নয় বিজনেস করতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে পকেট কাটা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। অনেক বাবার স্বপ্নের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। তাহলে কেন এসব স্কুলের বিরুদ্ধে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? কেন এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনা হচ্ছে না? তাহলে কি আমরা ধরে নেব প্রশাসন এদের খবর রাখেন না? 
একটি প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গড়ে ১৫০০ শিক্ষার্থী হলেও সরকারি প্রাথমিকে খুব বেশি হলে ৩০০-৪০০ জন। এই অনুপাত এটাই নির্দেশ করে যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যর্থতাই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার জন্য দায়ী। প্রিয় পাঠক, সরকার এত টাকা খরচ করে সরকারি প্রাথমিক স্কুলের ভবন, মাঠ, শিক্ষকদের উচ্চ বেতন, উপবৃত্তিসহ আরও কত কর্মকাণ্ডে বড় অঙ্কের বাজেট দিতে হয় অর্থমন্ত্রীকে, আর সেই টাকার জোগান আসে নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকা থেকে। গত দুই বছরে ট্যাক্স বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রশ্ন হলো পাঁচটি সরকারি প্রাথমিকের থেকেও বেশি স্টুডেন্ট একটি প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কীভাবে ভর্তি হয়? তাহলে কি বলব প্রশাসন দেখেও না দেখে থাকে? এই দুটি উত্তরই আমাদের প্রাণপ্রিয় জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন যে উন্নত ডিজিটাল দেশ তাকে বাধাগ্রস্ত করে। 
পিটিআই একজন প্রাথমিকের শিক্ষককে দুই বছর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে এতে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে অনেক টাকা খরচ হয়। প্রশিক্ষিত এই শিক্ষকদের স্কুলে শিক্ষকতা করতে নিয়োজিত করে এবং রাষ্ট্র তাদের জন্য উচ্চ বেতন প্রদান করে পক্ষান্তরে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে দুইহাজারী বেতনের শিক্ষক যাদের কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই তারা পাঠদান করে যারা নিজেরাই স্টুডেন্ট! স্কুলের শিক্ষার্থী বৃদ্ধি করতে, সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? যদি দায়িত্ব থাকে তাহলে এই ব্যর্থতা কি দায়িত্ব অবহেলাকেই নির্দেশ করে না? কেন অভিভাবকরা সরকারি প্রাথমিকে তার সন্তানকে পড়তে দিচ্ছেন না আর কেনইবা প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটছেন এর কারণ বের করতে হবে প্রাথমিকের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদেরকেই। গোড়ায় গলদ রেখে সামনে এগোলে সত্যিই কি আমরা এগোতে পারব? সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ব্যর্থ হলে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের অবমাননা হয় তা বুঝতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। 
প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের দাপটে আজ যেন মেরুদণ্ডই ভেঙে যাচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর। স্থানীয় অনেক অভিভাবকদের অভিযোগ রয়েছে সরকারি প্রাথমিকের লেখাপড়ার মান ভালো নয় তাই সন্তানদের প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ান। এই মান দেখার জন্য যে কর্তাব্যক্তি রয়েছেন তিনি কি জানেন এই সমস্যাগুলো? উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে প্রধান করে সব সরকারি প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে একটি শিক্ষা কমিশন হতে পারে। এই কমিশন প্রতিটি উপজেলার প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্টুডেন্ট সংগ্রহ করবে যেন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে। কি এমন মন্ত্র জানে প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা পিটিআই-এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা জানেন না? তা খুঁজে বের করতে হবে এই কমিশনকে। প্রয়োজনে পিটিআই এর প্রশিক্ষণকে আরও আধুনিকায়ন করতে হবে। প্রতি মাসে কমিশন উন্নয়ন রিপোর্ট প্রদান করবে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে যা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করে সাধারণ নাগরিকদের জানানো হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা শিক্ষার আতুর ঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে ঘুণ ধরেছে তা দূর করে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সহযোগিতা করবে। দূর হবে প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য, নজরদারি বাড়াবে প্রশাসন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে শিক্ষায় উন্নত এই প্রত্যাশা প্রতিটি নাগরিকের।
লেখক: কলাম লেখক।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft