শিরোনাম: |
সদিচ্ছাতেই মানবতার সেবায় ব্রতী হওয়া যায়
|
ড. মো. হুমায়ুন কবীর : ‘জীবে দয়া করে যেজন সেজন সেবিছে ঈশ্বর’। এমন একটি প্রবাদ চালু রয়েছে। এখানে জীব যদি মানুষ হয় তবে তো কথাই নেই। মানুষের দুঃখের দিনে তার পাশে থাকার নামই মানবতা। সমাজে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা বিভিন্নভাবেই অবহেলিত। তাদের কখনো কখনো অন্য মানুষের সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে। তখন যদি কোনো মানুষ এগিয়ে আসে তাকে মানবিক গুণে গুণান্বিত মানুষ বলা হয়ে থাকে। আবার কখনো কখনো কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থাও আর্তমানবতার সেবার ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে। এখানে আজকের আমার এ লেখায় সে রকম কয়েকজন মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের কথা তুলে ধরব। যদি রাস্তায় দেখা যায় কোনো একজন অসহায় লোক শীতে কাতরাচ্ছে, কোনো একজন লোক দুর্ঘটনায় কবলিত হয়ে ছটফট করছে, কোনো লোক দুষ্কৃতিকারীদের আক্রমণে অসহায় হয়ে পড়েছে, ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ইত্যাদির কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে রাস্তায় পড়ে রয়েছে। আপনি একজন মানুষ হিসেবে নিজের সাধ্যমতো যখন সেই অসহায় মানুষকে তুলে নিয়ে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। তবে আপনাকে সবাই মানবিক মানুষ হিসেবে বিবেচনা করবে। তবে এটা ঠিক যে, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকা একজন লোককে তুলে সহযোগিতার হাত বাড়াতে অনেক ঝুঁকি থাকতে পারে। থাকতে পারে অনেক অন্তর্নিহিত ঘটনা। কিন্তু এগুলোকে তুচ্ছ মনে করে মানবতাকে সামনে রেখে যিনি দায়িত্বটি নেন তিনিই মানুষ। আমি এখানে সেসব মানুষের কথাই বলতে চাচ্ছি। আমি যেহেতু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করি কাজেই সেখানকার কিছু কথা আলোচনায় নিয়ে আসব। সেখানে চাকরি করার সুবাদে শিক্ষার্থীদের কিছু সাধারণ সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রয়েছি। অবশ্য এসব সমস্যা সারাদেশের জন্যই অনন্য সাধারণ। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় সীমিত আসনের কারণে সমমেধাসম্পন্ন অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সারাদেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েই একই সময়ে ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার কারণে পরীক্ষার্থীরা একটি পরীক্ষা ভীতি কিংবা পরীক্ষার ট্রমাতে আবৃত হয়ে পড়ে। তাছাড়া প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে চান্স পেয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও তাদের পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতার দরুণ তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হিমশিম খেয়ে যায়। অনেকে ভর্তির সময় অর্থিক সাহায্য এবং ভর্তি ফি আংশিক বা পুরোপুরি মওকুফ করার জন্য অনুনয়-বিনয়ের মাধ্যমে আবেদন-নিবেদন করে থাকে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব অবস্থায় অনেক সময় টাকার অভাবে সেমিস্টার ফি সময়মতো জমা দিতে পারে না। এমন অনেক উদাহরণ চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করতে হয় প্রতিনিয়ত। হতাশার বিষয় হলো আমি নিজেসহ আমার মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন অনেক সহকর্মীর ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সেসব শিক্ষার্থীদের জন্য কোনোরকম সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। অনেককে তাদের করুণ অবস্থা দেখে ব্যক্তিগতভাবেও সহযোগিতা দিয়েছি। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেসব শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো সহযোগিতা দিতে পারিনি। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠান বলে সে ধরনের কোনো সহযোগিতার সুযোগ নেই। তবে সেখানে মেধাবীদের জন্য মেধাবৃত্তি চালু রয়েছে, কিন্তু দরিদ্রদের জন্য আলাদাভাবে কোনো ব্যবস্থা নেই। সেটার একটি অন্যতম কারণ হতে পারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনিতেই নামেমাত্র বেতনে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের সুযোগ দেয়া হয়। অথচ আমরা যখন গ্রামের স্কুল-কলেজে পড়েছি তখন দেখেছি ফ্রি স্টুডেন্টশিপ (হাফ এবং ফুল ফ্রি) নামে একটি নিয়ম চালু ছিল। সেখানে এখনও কীভাবে স্কুলে কিংবা কলেজে হাফ এবং ফুল ফি স্টুডেন্টশিপের সুবিধা প্রাপ্তির জন্য আবেদন করতে হয় তা শেখানো হয়ে থাকে। এভাবেই সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই টানেলের ওপাড়ে একটু সামান্য হলেও আশার আলো দেখা দিল বলে মনে হলো। সে আরেক কাহিনী। আমার লেখালেখির সুবাদে বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছিলাম, যেখানে আমি দেখিয়েছিলাম যে দারিদ্র্যবিমোচনে সরকার এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার অবদান অনস্বীকার্য। ঠিক তেমনি ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’, ‘আনসার-ভিডিপি ব্যাংক’, ‘কর্মসংস্থান ব্যাংক’, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারে থাকা ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ ইত্যাদি সাফল্যগাথা নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত কিছু লেখা ‘বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন- বিএনএফ’ নামের একটি সংস্থার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। এসব লেখা তারা পেপার ক্লিপিং করে তাদের সাংগঠনিক বোর্ড সভায় উপস্থাপন করে অলোচনা করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ সংস্থাটির চেয়ারম্যন সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট ইয়াহিয়া চৌধুরী ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনো এক সুন্দর সকালে আমাকে ফোনে অনুরোধ করলেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় তাদের একটি পার্টনার এনজিওর কার্যক্রম সরেজমিন দেখার জন্য। আমি যেহেতু এসব কাজের জন্য খুবই আগ্রহী সে জন্য তার আমন্ত্রণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করলাম। সেদিন তাদের কার্যক্রম দেখে আমি বেশ আবেশিত হয়েছিলাম। ঠিক তখনই আমার মাথায় আসলো আমার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অতি সম্ভাবনাময় দরিদ্র ও অসহায় শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো কিছু করা যায় কি-না। তখন চেয়ারম্যান মহোদয় বিষয়টিকে লুফে নিয়েছেন। তাকেও আমার মনে হলো একজন মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে। তিনি তখন আমাদের টিমে থাকা ত্রিশালে উন্নয়ন কার্যক্রমে বিএনএফের পার্টনার এনজিও শশী ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম সাহেবকে দরিদ্র ও অসহায় শিক্ষার্থীদের কল্যাণার্থে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দাখিল করার জন্য অনুরোধ করলেন। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী নির্বাচন করে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৪০ জন শিক্ষার্থীর প্রতিজনকে বার্ষিক অনুদান হিসেবে পাঁচ হাজার টাকার চেক তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে। যে শিক্ষার্থীদের নির্বাচন করা হলো তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরো শিক্ষাকালীন সময়ে এ অনুদানের সহযোগিতা বার্ষিক ভিত্তিতে পেয়ে যাবে। একজন শিক্ষার্থীর পুরো বছরের আর্থিক চাহিদার সঙ্গে এ পরিমাণ অর্থ হয়তো কিছুই না। কিন্তু একজন সহায়-সম্বলহীন দিশেহারা মেধাবী শিক্ষার্থীর শিক্ষার খরচ চালানোর জন্য সেটা কিছুটা হলেও উপকারে লাগবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে অনুদানের চেক বিতরণের দিন সেই অনুষ্ঠানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক গুণের অধিকারী উপাচার্য প্রফেসর ড. এএইচএম মোস্তাফিজুর রহমান অবশ্য আরও একটি বাস্তবমুখী মানবিক আবেদন জানিয়েছেন। তিনি বিএনএফ ও শশী ফাউন্ডেশনকে অনুরোধ করেছেন যাতে অনুদানের অর্থের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা যায়। অথবা সমপরিমাণ অর্থের ব্যবহার আরও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে ৪০ জনকে না দিয়ে আরও দরিদ্র ও অসহায় সর্বোচ্চ ১০ জনকে নির্বাচন করে তাদের পুরো মাসিক খরচ চালিয়ে নিয়ে নেয়া। যাতে সেসব শিক্ষার্থী নিশ্চিন্তভাবে তাদের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারে। পরবর্তীতে দেখা গেছে, সরকারের চার বছর পূর্তিতে ময়মনসিংহ জেলা ও ত্রিশাল উপজেলা কর্তৃক আয়োজিত উন্নয়ন মেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনএফ-শশী ফাউন্ডেশনের শিক্ষার্থীদের প্রদত্ত অনুদানের সচিত্র ভিডিওচিত্র তিন দিন যাবত্ প্রদর্শিত হয়েছে। এতে এ ধরনের কাজ করতে মানুষ আরও বেশি উত্সাহিত হবে। কারণ এ রকম অর্থ যত্রতত্র মানুষ অহেতুক অনুত্পাদনশীল খাতে ব্যয় করে থাকে। কিন্তু মানবিক কাজে অর্থ ব্যয়ের ফলাফল সুদূরপ্রসারী। এবার আরও কয়েকটি বিষয় এখানে আলোকপাত করা দরকার। আমাদের মানবিক ও প্রচারবিমুখ উপাচার্য প্রফেসর ড. এএইচএম মোস্তাফিজুর রহমান তার নিজের মাসিক বেতন এবং আরও কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর নিকট থেকে খয়রাতি করে তিনি কয়েকজন অসহায় শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহযোগিতা করে চলেছেন। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হয়ে এসেছেন মাত্র দু’মাস। এরই মধ্যে তিনি এ বিষয়ে উল্লেখ করার মতো শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা দিয়েছেন। তিনি আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন শারীরিক প্রতিবন্দ্বী কর্মচারীদেরকেও। তার এসব কর্মকাণ্ড আমিসহ আমার অনেক সহকর্মীকে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। আমরা সামনে পিছনে যেদিকেই তাকাই না কেন সমাজে এ রকম মানুষের সংখ্যা খুব কমই লক্ষ্য করা যায়। কারণ বলা হয়ে থাকে এখন মানুষের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ আগের তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল। মানুষ আর নিজের জীবনের আরাম আয়েশ জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যদের নিয়ে ভাবতে চায় না। তবে সমাজে ভালো মানুষের সংখ্যা একেবারে ফুরিয়ে গেছে তা মনে হয় না। এতকিছুর পরেও এখনও সৃষ্টি হচ্ছে এ যুগের শত সহস্র হাজী মুহাম্মদ মোহসীন। এভাবেই প্রকৃত মানুষ মানুষের উপকারে ব্রতী হবে। আসুন কামিনী রায়ের মতো বলি, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে, আসে নাই কেহ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’। লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় |