শিরোনাম: |
চিকু মকলেস কিংবা কচুক্ষেতের আইল
|
মোহাম্মদ মোজাফফর হোসেন : গাঁয়ের সবচেয়ে বোকা-সরল ছেলেটি খুন হলো। ব্যাঙগাড়ির মাঠে কচুক্ষেতের আইলে গলাকাটা অবস্থায় পড়েছিল ওর নিথর ধড়টা। গায়ে শেষবার খুন হয়েছিল মুকুল ডাক্তার, তাও বছর দশেক আগে। রাস্তায় ধারে একইরকমভাবে গলাকাটা অবস্থায় পড়ে ছিল ও। পরকীয়া প্রেমের নির্মম-বলি। তবে সাদেক কেন খুন হলো এখনো জানতে পারেনি গাঁয়ের মানুষ। হালে দেশে অন্যান্য খুনের সঙ্গে মিলিয়ে অনুমান করেছে মাত্র। অনুমানটা তাদের আরও পোক্ত হয় যখন আইএস তাদের ওয়েবসাইটে খুনের দায় শিকার করেছে বলে টেলিভিশনের স্ক্রলে ভেসে ওঠে। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট কারণ আইএস উল্লেখ করেনি। ফলে রহস্য একটা রয়েই গেল। এ নিয়ে কথা বলছিল সাদেকের কাছের কয়েকজন বন্ধু, গাঁয়ের উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আধভাঙা প্রাচীরে বসে। সামনেই বালিকা বিদ্যালয়, ছুটি হওয়ার আগমুহূর্তে ওরা কীভাবে যেন এখানে জড়ো হয়ে যায়! আইএস কেন্তু কামটা ঠিক কইরলু না। খুনের কারণটা তো জানাতি পারতুক! তালি আর আমাদের এত ভেবি ভেবি চান্দি গরম কইরতি হতুক না।’ সফিক বলে। ‘শোন, আইএস মেরি ফেলা মানেই কারণটা পুকুরের পানির মতোন টলটলা। মাঠ-ঘাটের বিরোধ, মুক্তিপণ, প্রেমঘটিত ব্যাপার-স্যাপার- এইসব ফ্যাসাদে আইএস কি খুন করে ককুনু; শুনিচিস তুই? এই যে তারা নিয়ম করি ফেলচি, সব তো এক কারণেই!’ বলল দলের সবচেয়ে বিচক্ষণ ছেলেটি, বরকত। ‘হ্যাঁ, কেন্তু যাদের গলা ফেলিচে, তারা তো নাস্তিক! ‘সবাই কেন্তো নাস্তিক না। পুরুত ও পাদ্রিকেও মেরিচে। হোক বেধর্মের তারা কেন্তো নাস্তিক না!’ ‘ওই একই- বেধর্মী আর নাস্তিকে তেমুন পার্থক্য আছে-নি?’ এটা কেন্তো ঠিক বুইললিনি আসাদ?’ বরকত পাল্টা প্রশ্ন করে। ‘ঠিক-বেঠিক জানি নি। শুনিচি ভারতে হেঁদুরা নাকি মসুলমানদের তাজা জ্বালিপুড়ি মারচি!’ ‘কেনে শাহরুখ খান, সালমান খান, আমির খান, তারপর মনে কর ইউসুফ পাঠান, জহির খান - ইরা তো মসুলমান। ইদির তো হেঁদুরাও মাতায় তুলি নাচে?’ বন্ধুদের ভেতর মাথামোটা বলে চিহ্নিত আকবর বলে। বরকত আর আসাদ বরাবরের মতো ওর কথায় গা করে না। ‘আচ্ছা, মানলাম নাস্তিক আর বেধর্মীদের মেরি ফেলচি ওরা। তাহলে যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার নাস্তিক ছেল না; গান-বাজনা পছন্দ করতুক, তাকে মারা হলু ক্যানে?’ বরকত প্রশ্ন করে। ‘ইসলামে তো গান-বাজনা মানা আছে। ছেলি-মেয়িরা পড়ার জন্যি গিচে, আর তাদের ধরি ধরি গানবাজনা শিকাতুক ওই লোকটা, বিদেশি সব সিনেমা দেকাতুক। বিদেশি সিনেমা মানে বুঝিস? এক-টিকিটে দুইটু- ওই যে দেখলাম না? ওইরকম মার্কা মারা।’ কথাগুলো যোগ করল হাবেল। ‘গান-বাজনা খারাপ কিনা জানি নি। তবে হাদিসে কুতাও পড়িনি যে নবীজি সাহাবিদের নিয়ে কুতাও বুলছেন- আসু এবার আমরা একটু গান-বাজনা করি? এমুন কতা কেন্ত কুতাও নেই।’ হাবেলের কথায় সায় দিয়ে নিজের যুক্তি জাহির করে চিকনা ওরফে চিকু মকলেস। ‘সবই বুঝলাম। কেন্ত আমাদের সাদেক ক্যানে? গেল হপ্তায় আমি আর ও পাশাপাশি দাঁড়ি জুম্মার নামাজ পড়লাম। নামাজের আগে উকে কানে কানে বুলিলাম, আজ বিশেষ দিন। আজ যে ৫০ রাকাত নামাজ পড়বি, ঠিক রাত বারোটার সুময় আকাশে মিকাইল আলাইহিসালামের ছায়া দেকতি পাবে! আমার কথা শুনি ও বিস্ময় নি একবার তাকালু খালি, কিছু বুলল না। পরদিন কলেজে যাওয়ার সুময় দেকি আমার দিকে ছুটি আসচি মারার ভঙ্গিনি, বলে কি- কই, কিছু তো দেখলাম না আকাশে? একুন বল এই মানুষটা ক্যানে খুন হলু? ও তো গানও গাতি পারতুক না। একবার স্কুলে উকে গান গাতি বুললি পেছনের ভাঙা দরজার ফাঁক দি লাফ দিতি গি জামা ছিড়ি ফেললু- মনে নেই তোদের?’ বলে হাদিসুর। ‘তবে তুরা যাই বুলিশ, আইএস হিসাবে ভুল করার মতো দল না। শুনিচি উরা আমেরিকার চেয়ি শক্তিশালী। উরা মেলা বছর ধরি স্পাইগিরি করি তবেই কুনো সিদ্ধান্তে আসে। উরা বাতাসে বাতাসে কি সব যন্ত্রপাতি ছেট করি রেখিচে।’ বলল হাবেল। ‘হুম, একুশ বছর বয়সী সাদেকের ওপর উরা পঁচিশ বচর ধরি নজরদারী করচি!’ ‘আমার কতার টিটকিরি মারিস নি, বরকত। আমাদের কতা কেন্ত আইএস শুনচি। আমার কি, আমি তো আর তাদের বিরুদ্ধে কিচু বুলচি নি! আমার ভয় কিসি?’ কথাগুলো বলতে বলতে জড়সড় হয়ে বসে হাবেল। কেনে শাহরুখ, সালমান, আমির, তারপর ইরফান, জহির- ইরা তো মসুলমান। ইদের তো হেঁদুরাই মাতায় তুলি নাচে।’ মাথামোটা আকবর বিরতি দিয়ে তার কথাটা রিপিট করে। আরও কয়েকবার বলবে। অনেক ভেবে সে একটা কিছু আবিষ্কার করে খানিক বাদ দিয়ে সেটা বলে যায়। অন্যদের সয়ে গেছে, তাই তাদের আর এতে গা করতে হয় না। তবে আজ শাহরুখের নামটা শুনে নড়েচড়ে বসল আসাদ। ‘এই ফ্যান ছবিটা দেকিচিস তুরা? আমি না বহুবার চেষ্টা করিও দেখতি পারলাম না। মাল-মসলা কিছু নেই, বুঝলি?’ বলে আসাদ। ‘হুম, একটা আইটেম দিলিই পারতুক। আমি দেকিচি, তবে খুব কষ্ট করি। উর থেকি সানি লিওনের মাস্তিযাদে দেকা ভালো।’ ‘সানি লিওনের পিংক লিপস গানটার ভিডিওটা দেখবি? আমি কালই মোবাইলে নিচি।’ বলে হাবেল। এরপর তাদের পুরো দলের আলোচনা সানিময় হয়ে ওঠে। শুক্রবার। একটু আগে আগেই মসজিদে যায় গফুর মিয়া, সাদেকের বাবা। গফুর মেয়া খেয়ালি নামাজি মানুষ- টানা পাঁচদিন পড়ে তো তিনদিন পড়ে না। সাদেক মারা যাওয়ার পর আজ প্রথম জুম্মা। ও ছুটে এসেছে হুজুরকে বলে বাদজুম্মা সাদেকের জন্য একটা মোনাজাত করানোর জন্যে। নিজেও এককোণায় বসে সাদেকের জন্য প্রাণখুলে প্রার্থনা করবে। এ কয়দিন পুলিশি ঝামেলা, সাংবাদিকদের এ প্রশ্ন সে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা। ঠিক মতো শোকটাও পালন করা হয়নি ছেলের জন্য। মোনাজাতের কথা শুনে হুজুর কেমন চুপসে গেলেন। ‘এটা কি ঠিক হবে?’ ছোট্ট করে বললেন তিনি। ‘ক্যানে ঠিক হবে না; ক্যানে হুজুর?’ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে গফুর। ‘বোঝোই তো। তুমার ছেলি নাস্তিক না আস্তিক সেটা তো একুনো প্রমাণিত হয়নি। নাস্তিক হলি তার জন্যি দুয়া করি আর লাভ কি? দেশের অবস্থা ভালো না। আমি এই বিতর্কে জড়াতি চাই নি।’ হুজুরের কথায় যুক্তি আছে। জোর করে লাভ নেই। গফুর মন খারাপ করে জুম্মার নামাজটা পড়েই বাড়ি চলে আসে। নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে জায়নামাজ নিয়ে বসে। বের হয় সেই সন্ধ্যায়, চোখজোড়া ফোলা। কেঁদেছে, কাঁদছে, আরও কাঁদবে- এই একমাত্র প্রতিজ্ঞা তার। বিচার চাইতে গিয়েছিল জেলা শহরে এমপি সাহেবের কাছে। এমপি সাহেব আগের দিন স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, খুনিরা যেই হোক, তাদের বিচার হবে। গফুরকে ডেকে শোনালেন অন্য কথা। ধমকের সুরে বললেন, নাস্তিক ইস্যুতে তিনি হাত দিতে চান না। ‘স্যার, গায়ির সব্বাই বুলবি, আমার ছেলি আল্লাহওয়ালা ছ্যালো। নাস্তিক কি জিনিস আমরা জানতামই না!’ অনুনয় বিনয় করে বলে গফুর। ‘গাঁয়ের লোক বলবে? কিন্তু কেউ বলছে তো না! সবাই তো তোমার ছেলে সম্পর্কে জানতে চাইলে কেমন সুড়সুড় করে কেটে পড়ে।’ ‘স্যার, ও তো নামাজ পড়তুক। মানুষ ভয়ি ভয়ি কিছু বুলছি না। কেন্তু আল্লাহ সাক্ষী।’ ‘আমিও সেই কথা বলি। সত্য-মিথ্যা সব আল্লাহ তো জানছেই। ও আস্তিক ছিল সেটি প্রমাণ করলেই তো আর তোমার মরা ছেলে ফেরত আসবে না। বরং নাস্তিক কোনোভাবে প্রমাণিত হলে তুমি গাঁয়ে টিকতে পারবে না? তোমার দুটো মেয়ে আছে বিয়ের বয়সী- বিয়ে দিতে পারবে তাদের? যে গেছে সে গেছে। সাংবাদিকদের বলে দাও যা ঘটেছে সেটি মেনে নিয়েছ। প্রয়োজনে আমি ঘোষণা দিয়ে তোমাকে দশ হাজার টাকা দিচ্ছি। নগদ টাকা আবার হাতে থাকে না, একজোড়া ছাগল নাও, মেয়েদের বিয়েতে কাজে লাগবে।’ এমপি সাহেবের কথার পর আর কোনো কথা টেকে না। তিনি কথা যেখানে শেষ করেন, সেটাই শেষ কথা। যেদিন গফুর ফিরে আসল শহর থেকে ঐদিনই মাঝরাতে গাঁয়ের ক্ষমতাসীন নেতার সঙ্গে এমপির একজন খাসলোক আসে গফুরের কাছে। এ কয়দিনে গফুরের ঘুমটা কেবল এসেছে। এমপির কথায় মনে যে অস্থিরতা ছিল, দ্রোহের আগুন ছিল সব নিভে গেছে। এখন কেবল এক ওপর ছাড়া কারো দিকে মুখ তুলে তাকাবে না সে। তাকিয়ে লাভ নেই জেনেই। হঠাত্ তার বাড়িতে এভাবে চোরের মতোন দুইজন গণ্যমান্য ব্যক্তির আগমনকে সে কীভাবে নেবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ‘শোন্ গফুর, তোর কপাল খুলেছে। হিংসে হচ্ছে তোর ভাগ্য দেখে!’ স্থানীয় নেতার কথায় নড়েচড়ে বসল গফুর। এ কয়দিনে এইটা একেবারে নতুন কথা। এভাবে কেউ বলেনি কখনো। কিন্তু কেন বলছেন নেতা সেটি তাকে ভাবতে না দিয়েই নেতা বললেন, ‘এমপি সাহেব একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। শহরে তোকে ভালো পজিশনে একটা দোকানের ব্যবস্থা করে দেবেন। সঙ্গে মালপত্রও। পরের জমি করি খাস একিনে। কেমন হবে বল তো?’ ‘জ্বি, ভালো।’ গফুর ভয়ে ভয়ে বলে। ‘আরে ভালো কি, বল্ জবর-ভালো’- এইপ্রথম কথা বললেন এমপি সাহেবের খাসলোক। শহরে আস্ত একটা দোকান দিয়ে দেয়ার বিষয়টি গফুরের ভালো ঠেকছে না। ‘তবে একটা কাজ করতে হবে তোকে।’ নেতা বলেন। ‘অতি সামান্য একটা কাজ।’ যোগ করেন খাসলোক। গফুর কোনো নির্বাক শ্রোতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে তখনো ভেবে চলে দোকানটি গ্রহণ করা উচিত হবে কিনা। ‘শুধু তোমার ছেলের খুনের বিষয়টায় মুনসুর মোল্লার দিকে আঙুল তুলতে হবে। সব কাজ আমরাই করব। কেবল কাল থানায় গিয়ে বলবে, মুনসুর মোল্লার লোকজনকে তোমার সন্দেহ হয়। বাকি কাহিনি যা সাজানোর আমরা সাজিয়ে নেবো। তোমার আর কিছুই করা লাগবে না। দোকানে পায়ের ওপর পা তুলে খাবে কেবল!’ ‘আর, আমরা যে তোকে এটা করতে বলেছি, এটা তুই খবরদার কাউকে বলবি না। মানুষ দেখবে, বুঝবে, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। তুই মুখ ফুটে কিছু না বললেই হলো।’ স্থানীয় নেতা চোখ রাঙিয়ে কথাগুলো বলেন। ‘স্যার, আমি কটাদিন ভেবি দেখি?’ ভয়ে ভয়ে বলে গফুর। ‘আমরা তো তোকে ভাবতে দিতে আসিনি! এটা এমপি সাহেবের নির্দেশ। তোর অনুমতি চাইতে আসিনি এই মাঝরাতের ঘুম ভেঙে। কি করতে হবে সেটা বলতে এসেছি।’ শেষকথাটা বলে সেদিনকার মতো নেতারা বের হয়ে যান। যেমন নিঃশব্দে এসেছিলেন, তেমন নিঃশব্দে। আড়ালে স্ত্রী দাঁড়িয়ে সব শুনেছে, নাহলে দুঃস্বপ্ন বলে বিষয়টিকে সেই মুহূর্তে এড়িয়ে যেতে পারতো গফুর। ‘চলেন, ভিটিমাটি বেচি দি অন্যগাঁ চলি যাই। একিন আর টিকা যাবে না বুলি মনে ঠেকচি।’ স্ত্রী নছিরন বলে। এই দ্যাশ ছেড়ি তো আর যেতি পারবি নি! তাছাড়া গাঁ ছাড়লি ভিটামাটি বেচতি পারবু মনে করচিস? চেয়ারম্যান একিনে মিল বসানুর প্লান করি বসি আছে। নিজেও কিনবি না, অন্যকেউ কিনতি দেবে না।’ ৩. মাস দুয়েক গত হয়েছে। সাদেক হত্যার বিচার চাওয়া তো দূরের কথা গাঁয়ের মানুষ নিজেদের ভেতর আলোচনা করে সাদেককে একরকম নাস্তিক হিসেবে মেনে নিয়েছে। গফুর গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্তটা একরকম নিয়েই ফেলে। এরই মধ্যে ঘটে যায় ঘটনাটা। পাশের গাঁয়ে অনুরূপভাবে খুন হয় সাদেক। আরেক সাদেক। শহরে পড়তো, গ্রামে এসেছিল ছুটিতে। গলায় শেষ কোপটা মারার সময় খুনিদের কেউ একজন বলতে শোনে- ‘আল্লাহু-আকবর! এবার আর ভুল করিনি!’ ‘থুতনিতে কাটার দাগটা থাকলে আরও নিশ্চিত হওয়া যেত।’ অন্যজন বলে। |