শিরোনাম: |
সান্দাকফুর শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্য
|
মুফতানিয়া বেগম : দার্জিলিংয়ের তীব্র ঠাণ্ডায় নরমাল ফ্রিজের ফাংশন বোঝা হয়ে গেল সবার। এবার মনে হলো ডিপ ফ্রিজটা তাহলে বাকি থাকে কেন? বরফ পড়াটাও দেখে যাই। বরফ পড়ছে কোথায়? বরফ পড়ছে গ্যাংটকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল গ্যাংটকে এখন বাংলাদেশিদের অনুমতি দিচ্ছে না। দার্জিলিংয়ে বেড়ানোর সময় ছোট্ট একটা ভ্রমণ-পাগল গ্রুপের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে দেখা হচ্ছিল। তাদেরও একই উদ্বেগ গ্যাংটক বন্ধ- তাহলে যাওয়া যায় কোথায়? ফাইনাল করা হলো সান্দাকফু- ১২ হাজার ফুট উঁচুতে ওয়েস্ট বেঙ্গলের সর্বোচ্চ স্থান এটি। জায়গাটায় এখন রাতে হালকা তুষারপাত হচ্ছে। সেখান থেকে দেখা যাবে এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ বিশ্বের আরও ২টি সর্বোচ্চ শৃঙ্গ লোতছে, মাকালুর সবচেয়ে কাছের দৃশ্য। ট্রেকিং করে যেতে ৩-৪ দিনের মতো লাগে। গাড়িতে একদিনেও যাওয়া যাবে, কিন্তু যেতে খবর আছে! দেখা যাক... কী খবর! দার্জিলিং থেকে পুরোটাই মেঘের রাজ্য, আর দু’পাশে পাইনের বনের মধ্যে দিয়ে পৌঁছলাম আরেকটা উঁচু শহর মানেভাঞ্জনে। এখান থেকেই আসল যাত্রা শুরু। আরও অনেক উপরে উঠতে হবে। সেখানে যাওয়ার সাহস ও শক্তি যে একটিমাত্র গাড়ির আছে ব্রিটিশ নির্মিত সেই ল্যান্ড রোভার ঠিক করা হলো। ধন্যবাদ ব্রিটিশ ভাইয়েরা এই যন্ত্রদানব এবং চা-এর অভ্যেস রেখে যাবার জন্য। দুটোই বেশ কাজে দিয়েছে। রোড পিলারে লেখা আছে- সান্দাকফু ৩১ কিমি.। কিন্তু সময় লাগবে নাকি সাড়ে ৪ ঘণ্টা। ঘটনা কী? ফাজলামি নাকি! ১৫ মিনিট পর থেকে শুরু হলো ঘটনা। রাস্তাজুড়ে পাথর পরিবারের রাজত্ব। দাদা পাথর, বাবা পাথর, মা পাথর, বাচ্চা পাথর। কিছু কিছু আছে পুরাই ভিলেন পাথর, যারা গাড়ি উল্টিয়ে মৃত্যুস্বাদ দেখানোর জন্য ওঁত পেতে আছে। ১০ মিনিট পরপর একেকটা বিশাল আকৃতির সরু, খাড়া বাঁক। ভয়ঙ্কর! বাঁকগুলো উঠতে গিয়ে সবার কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। এদিকে প্রতি ১০ মিনিটে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। যেন চলমান মাল্টিকালার স্ক্রিন। হাজার রকম আর হরেক রঙের বুনো ফুল-ফল, গাছ-লতাপাতা; ওক, ম্যাগ্নোলিয়া, রডোড্রেনডন, অর্কিডের মহাসমারোহ। ফাঁকে ফাঁকে ভ্যানিলা আইসক্রিমের মতো কাঞ্চনজঙ্ঘার উঁকি, বাঁকে বাঁকে ছোট্ট ঝিল, ঝিরি, ধেয়ে আসা মেঘ মিলে অপূর্ব প্যানোরোমা। আমরা বুঝে পেলাম না- ভয়ে চিত্কার করতে থাকবো নাকি আনন্দে। একেই বুঝি বলে ভয়ঙ্কর সুন্দর! ভয়ঙ্কর সুন্দর!! রাস্তাটার বেশির ভাগই চলে গেছে ইন্ডিয়া, নেপালের বর্ডারের মাঝ দিয়ে। পথে তিনটা চেকপোস্টে থামতে হলো। ক্যাম্পগুলোও ঢেকে আছে ঘন মেঘে। দূর থেকে বোঝা যায় না। ওখানটায় পৌঁছাতেই মেঘের ভিতর থেকে ভূতের মতো বেরিয়ে আসে ডিউটিরত সৈনিকরা। অতি ঠাণ্ডায় থেকে থেকে এদের মেজাজ আর গলার উত্তাপও বুঝি শীতল হয়ে গেছে। সবারই ব্যবহার অতি মিষ্টি। মায়া লাগল। নানান সুদূর প্রদেশ থেকে এসে এরা স্বজন-যোগাযোগ-বিদ্যুত্ বঞ্চিত অবস্থায় মেঘাবৃত হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে বছরের পর বছর! উঠোন পেরিয়ে যাওয়া পর্যটকরাই তাই এদের কাছে স্বজন। ফর্মালিটিজের দুদণ্ড সময়েই হয়ে যায় অনেক গল্প যেন কতদিনের চেনা! ছবি তোলার অনুমতি পাওয়া গেল কিন্তু ঠাণ্ডায় পকেট বা গ্লাভস থেকে কেউই হাত বের করতে রাজি না। স্মৃতি রক্ষার চেয়ে তখন নিজেকে রক্ষা করাটা বেশি জরুরি। অনেকটা দূরে দূরে স্বস্তিদায়ক নেপালি হোটেল। গাড়ি থামিয়ে, মগ ভর্তি চুলার চা পান করে চার্জ নিয়ে নিলাম। ইন্ডিয়ান পাহাড়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে নেপালি হোটেল থেকে বাংলাদেশিদের চা পানের দৃশ্যটা নিজেদের কাছেই মজা লাগছিল। মেঘ কেটে কেটে গাড়ি এগোচ্ছে। ঠাণ্ডা বাড়তে লাগল হু হু করে। উপরে উঠছি তো উঠছিই। রাস্তা আর ফুরায় না। রাত নেমে এলো, সঙ্গে গা শিউরানো ঠাণ্ডা নির্জনতা। ড্রাইভারের মধ্যে রাত বাড়ার আগেই পৌঁছানোর ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছিল। আর মাত্র কিছু পথ বাকি। হঠাত্ আমাদের ল্যান্ড রোভারটা বেঁকে বসলো। সামনে ভিলেন পাথরদের পাথরবন্ধন। ড্রাইভারের একেকটা চেষ্টায় চাকার নিচ থেকে নিরীহ পাথরগুলো নিচে গড়িয়ে যেতে লাগলো। কতদূর সেটা আর দেখা গেল না! গড়ানো পাথরের জায়গায় নিজেদের পরিণতি কল্পনা করে সবাই লাফিয়ে নামলাম। কিছু ভিলেনকে রাস্তা থেকে হাত দিয়ে সরানোর পর ড্রাইভার তার সমস্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটু একটু করে বেশখানি উপরে উঠে গেল। গাড়ি পেছনে আসতে পারবে না। সুতরাং এটুকু আমাদের হেঁটেই উঠতে হবে। কয়েক পা উঠতেই হঠাত্ টের পেলাম নিঃশ্বাস নিতে পারছি না! কী হলো? আমার তো এ ধরনের কোনো সমস্যা নাই! বড় বড় করে শ্বাস নিতে গিয়ে মাইনাস ৩ ডিগ্রি ঠাণ্ডা বাতাস ফুসফুসে ঢুকে গেল। একে শ্বাসকষ্ট, তার উপর পুরো শরীর জমে কুঁকড়ে যেতে লাগলো। রাস্তায় পাথরের উপরই শুয়ে পড়লাম। আর এক পাও এগোনো অসম্ভব! খুব কষ্ট হচ্ছে। আসলে এতক্ষণ গাড়িতে বসে থাকায় টের পাইনি। সর্বোচ্চ উচ্চতা এসে গেছে। সবারই কিছুটা সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু আমার এত কেন? বোনেরা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। আমি অসহায়ের মতো চারদিকে তাকালাম। রহস্যময় রাত, দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া তখনো রূপায় মোড়ানো নিচে ফেলে আসা গহীন শূন্যতা, উপরেই অপেক্ষমান না দেখা এক মায়াপুরী। এই অসহ্য সুন্দরের মাঝেই কি আজ চলে যেতে হবে? পরম করুণাময়কে ডাকলাম, ‘আল্লাহ, অন্তত এখানে, এভাবে নিও না। এখনও তোমার সৃষ্টির কত মহিমা দেখা বাকি! চারপাশে এত বাতাস, আমি কেন পাচ্ছি না, আমাকে একটু অক্সিজেন দাও।’ তিনি শুনলেন। কেউ একজন বুদ্ধি দিলো, মুখ থেকে মুখে শ্বাস দেয়ায় কাজ হলো। বাকি পথটা এক বোনের থেকে শ্বাস ধার নিয়ে নিয়ে একটু একটু করে এগোলাম। চূড়ায় মূলত কোনো লোকালয় নেই, আছে শুধু হাতে গোনা কয়েকটা লজ। আমি আর ভয়ে গাড়ি থেকে নামি না। সবাই দৌড়াদৌড়ি করে লজ ঠিক করে এলো। একটা ডরমিটরি ডাইনিংয়ে অনেকে আপাতত আশ্রয় নিয়েছে। খাবার প্লাস উষ্ণতার জন্য। প্রাণোচ্ছ্বল এক ট্রেকিং গ্রুপের সঙ্গে দেখা এবং কথা হলো। তারা নাকি ৩-৪ দিন ধরে ট্রেকিং করে এখানে পৌঁছেছে! তাদের দেখার পরিধিটা তাহলে আমাদের থেকেও বেশি! ডিপ ফ্রিজের নমুনা পাওয়া গেল। বাইরে মৃদু তুষারপাত। নিম্ন-তাপমাত্রায় জমে গেছে আমাদের সব কসমেটিক্স, বদলে গেছে নাক-মুখের নকশাও। বিদ্যুত্ বন্ধ, নেই হিটারের ব্যবস্থা, হট ওয়াটার প্যাড ভাড়া পাওয়া যায়। দুটো নিয়ে নিলাম হাতে-পায়ে চেপে ঘুমানোর জন্য। তার আগে অনেকক্ষণ কয়লার আগুনে নিজেকে রুটি-সেঁকা সেঁকে কিছুটা স্বাভাবিক হলাম। কিন্তু আমার অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের স্ট্যাটাসটা রয়ে গেল দুর্বল নেটওয়ার্কের মতো। নড়লেই চলে যায়, কী মুশকিল! অভিজ্ঞতাপূর্ণ দিনটির বিনিময়ে পরদিন ভোরে সান্দাকফু যে অমূল্য দৃশ্য উপহার দেয় সেটা বর্ণনাতীত, সারাজীবনের জন্য স্মৃতির একটা অংশ স্থায়ীভাবে দখল করে নেয়ার মতো। পরদিন আমার শ্বাসকষ্ট হবার রহস্য উদ্ধার হলো- চারপাশজুড়ে সৌন্দর্যের যে জাদু ছড়ানো, তা শ্বাসরুদ্ধকরই বটে! সবাই ক্ষেপাতে লাগল, ‘মরতে বসছিলি। আবার যাবি?’ কলার ঝাঁকিয়ে বললাম- ‘অবশ্যই! এবার ট্রেকিং করে যাব। শুধু একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার সঙ্গে নিয়ে নিলেই তো হচ্ছে।’ লেখিকা: বিদেশি এয়ারওয়েজে কর্মরত |