শিরোনাম: |
এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ
|
মো. ওসমান গনি : এক সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে নিন্দা করা হয়েছিল। যারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে নিন্দা করতেন তারা সে সময়ে ভাবতেন বাংলাদেশ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। খাদ্যসহ বিভিন্ন সাহায্যের জন্য বিশ্বের দিকে হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু বাংলার জনগণ আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক নেতৃত্বের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছ। গত ১২ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের চার বছর পূর্ণ হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার নানামাত্রিক বিশ্লেষণ চলছে। বিশ্লেষকদের মতে, চতুর্থ বছরেও বিগত তিন বছরের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। এ সময়কালে নানা টানাপড়েন ছিল, পথ চলতে হোঁচটও খেতে হয়েছে। বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে সব সূচকে অগ্রগতি, সাফল্য আর উন্নয়নের নিশান উড়িয়েই টানা দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতার চার বছর পূর্ণ করলো সরকার। পাশাপাশি অর্থনীতি, অবকাঠামো, কূটনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা ও সামগ্রিক উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনের মধ্য দিয়ে সরকার পঞ্চম ও শেষ বছরে পদার্পণ করছে। জঙ্গিবাদ ভয়ঙ্কর সরীসৃপের মতো ফণা তুললেও সরকার দ্রুততার সঙ্গেই বিষদাঁত ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বৈরী বাস্তবতার কারণে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না, তাই দেশের সার্বিক অর্থনীতির উন্নয়ন ধারা বেগবানই থেকেছে। শেখ হাসিনার দৃঢ় ভূমিকা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় বিভিন্ন বাধা উপেক্ষা করে লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সরকার। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাই সাফল্যের পাল্লা ভারী। নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র, মেট্রো-রেল, রামপাল বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র ও দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম রেললাইনের মতো মেগা প্রকল্পসহ বিশাল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করছে সরকার। রাজধানীর দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে গ্রাম। বিশ্বসভায় বাংলাদেশ এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক মহলে গুরুত্ব বেড়েছে বাংলাদেশের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য, সামুদ্রিক অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ জোরালো। রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলায় শেখ হাসিনার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তাকে মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক খালিজ টাইমস, ‘নিউ স্টার অব দ্য ইস্ট পূর্বের নতুন তারকা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ভারত ও মিয়ানমারের বিপক্ষে সমুদ্র বিজয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, পোশাক রফতানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় হওয়া, জাতির জনকের ৭ মার্চের ভাষণের বিশ্ব স্বীকৃতি, উদ্যোক্তাশূন্য বাংলাদেশে এখন লাখো উদ্যোক্তা তৈরি হওয়াসহ সামগ্রিক আমদানি ও রফতানিতে দেশ এগিয়ে চলছে। এক সময়কার আমদানি নির্ভর বাংলাদেশ এখন আমদানির বিকল্প পণ্যের শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছে। খাদ্য উত্পাদনে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর কাতারে দেশের নাম লিখিয়েছেন আমাদের দেশের কৃষকরা। সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠে রোহিঙ্গা সঙ্কট, যা একটি বৈশ্বিক রূপ নিয়ে বাংলাদেশকে এক অভাবনীয় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছে বাংলাদেশ, মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। এর ওপর ভর করে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর এই তিন মাসে রোহিঙ্গা সমস্যার দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় মাত্রা যখন যেটাকে দরকার, সেটাকেই সামনে এনেছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে থাকলেও রাজনীতিতে বিরাজ করছে অস্বস্তি। এ অস্বস্তির বাতাবরণ দূর না করায় সরকারই সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছে। চতুর্থ বছরে সরকারকে মোকাবিলা করতে না হলেও বেশ কিছু ঘটনা ও পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে বেগ পেতে হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে না পারায় সমালোচনার শিকার হতে হয়। চতুর্থ বছর সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলা করা। কম সময়ে এত শারণার্থী আশ্রয় নেয়ার বিষয়টি মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা অন্য দেশের নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ বিষয়েও সফলতা দেখায় সরকার। প্রাথমিকভাবে আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা হলেও তাদের ফেরত পাঠানোর চ্যালেঞ্জ এখনও সরকার কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে শুরু থেকে সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ব্যাপক কূটনৈতিক তত্পরতা শুরু করে। যার ফলে সারাবিশ্বে এ নির্যাতনের ঘটনায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ধিক্কার উচ্চারিত হয় ও রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কণ্ঠ সোচ্চার হয়। শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রায় পুরো বিশ্ব আজ বাংলাদেশের পক্ষে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর সরকারের যাত্রার শুরুতে পাশে ছিল শুধু ভারত। ফলে সরকারের পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার স্বীকৃতি আদায় ছিল সে বছরের প্রথম মাসগুলোতে কূটনীতিকদের প্রধান কাজ। মেয়াদের শেষ বছরে এসে দেখা যাচ্ছে, বৃহত্ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টাই কূটনৈতিক অঙ্গনে সরকারের অন্যতম প্রধান কৌশল হয়ে উঠেছে। ভারত, চীন, রাশিয়া ও জাপানের মতো অর্থনৈতিক শক্তিগুলো সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছে। বাংলাদেশ চীনের ‘এক অঞ্চল ও এক পথ’ আর জাপানের ‘বিগ বি’র মতো বৃহদায়তন উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে। বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে যুক্ততার অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সৌদি আরবের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পর্ক সম্প্রসারিত করেছে বাংলাদেশ। ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈতরণী ২০১৭ সালে সফলভাবে পার হয়েছে সরকার। ২০১৬ সালের শুরু থেকে অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরানোর জন্য চাপ ছিল। বাংলাদেশকে চুক্তি করতে খসড়া দিলেও প্রায় দেড় বছর নানাভাবে তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরে চুক্তিটি সই করে বাংলাদেশ। তবে এতে বাংলাদেশ এটা নিশ্চিত করেছে যে ফিরে আসা লোকজনের পুনর্বাসনে উন্নয়ন সহায়তা দেবে ইইউ। ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরপর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দুই প্রস্তাবকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বাংলাদেশ। কারণ, ওই প্রস্তাব দুটিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার ও জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ইউরোপের অবস্থান স্পষ্ট করা হয়েছে। ব্রাসেলসে ইইউ সদর দফতর এবং স্ত্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নিবিড় যোগাযোগের ফলে এটা সম্ভব হয়েছে বলে কূটনীতিকরা মনে করেন। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্কে এক ধরনের গুণগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর সরকারের বৃহত্ দুটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে দৃশ্যমান সফলতা আসে। বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু করা পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে নির্মাণকাজ পুরোপুরি দৃশ্যমান হয় গত ১ অক্টোবর। এছাড়া গত ১ ডিসেম্বর দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের মূল পর্বের কাজটি শুরু হয়। দেশের প্রায় ৮৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে আর এখন বিদ্যুত্ উত্পাদন ক্ষমতা প্রায় ১৬ হাজার মেগাওয়াট। ফেনীর মহীপালে দেশের প্রথম ছয় লেনের ফ্লাইওভারের কাজ নির্দিষ্ট সময়েই শেষ হয়েছে এবং গত ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী গত ১০ ডিসেম্বর যশোরে নবনির্মিত ‘শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক’ এর উদ্বোধন করেন, যা দেশের আইটি সেক্টরে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) হার ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৩২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার ও রফতানির পরিমাণ ৩৮ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬১০ ডলার। এ সময়ে মুদ্রাস্ফীতি বিগত ৫৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন ডিসেম্বরে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার ৫৭ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশ। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ বছর। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি সম্প্রসারণ ও তাতে অর্থ সহায়তা বৃদ্ধি করায় ৫৭ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের দারিদ্র্য থেকে মুক্তিলাভ সহজ হয়েছে। পাশাপাশি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল-সংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায় নিয়ে বেশ রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ায়। সরকার এ নিয়ে সৃষ্ট সার্বিক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, কূটনীতি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়নে বেশ সাফল্য অর্জন করে বলে মনে করছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া সরকারের চার বছর পূর্তি ও এ সময়ের উন্নয়ন ও সাফল্যগাথাকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সরকার। সে অনুষ্ঠানে সরকারের সফলতার সব কাজকর্ম তুলে ধরা হয়। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট |