শুক্রবার ২৯ নভেম্বর ২০২৪ ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
বাঙালির ইতিহাসে আরেক কলঙ্কিত দিন
Published : Saturday, 15 July, 2017 at 6:00 AM, Count : 1174

বাহালুল মজনুন চুন্নূ : সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত রিচার্ড ও’ব্রিয়েনের লেখা উইমেন প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড প্রাইম মিনিস্টার্স নামের বইটির প্রচ্ছদে উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ছবি। আর বইটির লেখায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তার সংগ্রাম ও অর্জনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; তুলে ধরা হয়েছে বাংলার আপামর জনসাধারণের প্রতি তার নিখাঁত ভালোবাসা-আবেগের কথা। ওই বইটিতে তুলে ধরা বঙ্গবন্ধু কন্যার একটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্যের মধ্য দিয়েই তার সম্পর্কে সম্যক ধারণা  লাভ করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে যখন আমি দারিদ্র্যমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব, সম্ভবত তখনই আমি বলতে পারব, আমি গর্বিত’। তিনি শুধু বাংলাদেশের নয়, সারাবিশ্বের মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তাই তো, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বিশ্বমানবতার জন্য অনন্য এবং প্রয়োজনীয়। তিনি বিশ্ব মানবতার কণ্ঠস্বর।’ মহার্ণবের মতো এমন উদার যার হূদয়, যার চেতনার সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির মুক্তি-ক্রমোন্নতি, সেই তাকে তার প্রাণাধিক প্রিয় জনগণের সংস্রব থেকে দূরে সরিয়ে রেখে নিজেদের ক্ষমতার মসনদকে কুক্ষিগত রাখার অলোকসামান্য অভিলাষে লালসার্ত অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের সরকার মিথ্যার বেসাতি দিয়ে গড়া সাজানো মামলায় গ্রেফতার করেছিল যেদিন, স্বাভাবিকভাবেই সেদিনটি হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক কলঙ্কিত দিন। আজ থেকে ঠিক বছর দশেক আগের সেই দিনটিকে কলঙ্কিত করার দুঃসাহস দেখিয়ে তারা কেবল দেশে অশান্তির আগুনই জ্বালিয়ে দিল না, সেই সঙ্গে নিজেদের পতনের সুড়ঙ্গও তৈরি প্রশস্থ করে ফেলেছিল। অন্যদিকে সেই কলঙ্কিত দিনটিতে শাপে বরের মতো নেতৃত্বের অগ্নিপরীক্ষায় উতরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মানুষের হূদয়ে গেঁড়েছিলেন চিরস্থায়ী আসন।
একবিংশ শতাব্দীর সূচনার বছরই বাংলার আকাশে দুর্ভেদ্য অন্ধকার নেমে এসেছিল। প্রলয়মেঘে ঢেকে যায় পুরো বাংলাদেশ। ষাঁড়াষাঁড়ির বানের মতো অপ্রতিরোধ্যগতিতে হাওয়াভবন কেন্দ্রিক দুর্নীতি আর লুটপাটের ধকলে বাঙালি হয়ে পড়ে দিশাহারা, বীতশ্রদ্ধ। তাই নিজেদের মসনদ হারানোর ভয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়া নিয়ে খালেদা জিয়ার সরকারের নানা কূটকৌশল আর ছল-চাতুরি শুরু করে দিয়েছিল। গণতন্ত্রের প্রতি অবিশ্বাসী এই গোষ্ঠীর কারসাজিতে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মদ সাংবিধানিক ধারা রক্ষা না করে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদে অধিষ্ঠিত হলে দেশে যে চরম বিশৃঙ্খল ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার সুযোগ নিয়ে ওয়ান এলেভেনের সৃষ্টির মাধ্যেমে মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম নিয়ে এদেশে ক্ষমতাসীন হয়েছিল। আর এর মধ্যে দিয়ে দেশ প্রবেশ করেছিল আরেক অশুভতিথির ভেতরে। এরা দেশে বিরাজনীতিকরণের ধারা চালু করে দিয়েছিল। এদের মদদ দিয়েছিল সোনার পাথর বাটার স্বপ্নে বিভোর তথাকথিত সুশীল সমাজ, যারা তাদের দীর্ঘদিনের লালিত জিঘাংসা চরিতার্থ করতে অযুক্তিসিদ্ধভাবে মাইনাস টু ফর্মুলা দিয়ে ড. ইউনুস বা তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। রথী-মহারথী হয়ে উঠা এই কথাবাগিশ সুশীল সমাজ স্বর্ণমৃগ পাওয়ার প্রত্যাশায় কথার বাঁধুনি বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে কুপ্ররোচনা, কুমন্ত্রণা দিতে লাগল অবৈধ তত্ত্বাবধায় সরকারকে। এদের সম্মিলিত লিপ্সার প্রথম শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কেননা তারা জানত জ্যোতির্ময়ী বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বন্দি করা না গেলে তার আলোকছটায় জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাবে তাদের অনুচ্চারিত স্বপ্ন। সেই সময় খালেদা জিয়া তার ভোগান্বেষী দুনীর্তির বরপুত্র খেতাবধারী পুত্রদ্বয়সহ চিরতরে সৌদি আরবে চলে যেতে সম্মত হয়েছিল বিধায় তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। অবশ্য পরবর্তীতে নানা সমীকরণের কারণে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে গ্রেফতারের প্রায় মাস দুুই পরে খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল।
একটু পেছনের দিকে দৃকপাত করলেই উপলব্ধি হয়, কী নির্মম সুযোগসন্ধানী ছিল তারা! ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অসুস্থ পুত্রবধূকে দেখতে বঙ্গবন্ধুকন্যা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন, ওমনি দস্তুরমাফিক অবৈধ সরকার তাকে দেশে ফিরতে না দেয়ার জন্য নিঠুর নোংরা খেলায় মেতে উঠেছিল। কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘তার (শেখ হাসিনা) নেতৃত্বের অসাধারণ গুণ হলো নিপীড়িত, বঞ্চিত, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো। শেখ হাসিনার মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে।’ সেই পরহিতব্রত, দেশের কল্যাণে আত্মোত্সর্গকারী এবং সতত সত্য ন্যায়ের পথে চলা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা টুকে দিয়েছিল অবৈধ সরকার। ক্ষমতা গ্রহণের মাস তিনেকের মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গৃহীত একের পর এক পদক্ষেপ তাদের অসত্ উদ্দেশ্যকে বাঙালির কাছে স্পষ্ট প্রতীয়মান করে তুলেছিল। তারা বঙ্গবন্ধু কন্যার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা দুর্নীতির মামলা দিলেও দেশের মানুষকে তা বিশ্বাস করানো যায়নি, বরং তারাই মুড়ে যায় অবিশ্বাসের চাদরে। ক্ষমতার লোভ মানুষকে কতটুকু নিচে নামাতে পারে, কতটা কুচক্রী মিথ্যাবাদী বানাতে পারে সেদিন তার প্রমাণই পেয়েছিল বাঙালি। কিন্তু যার দেহে বইছে জাতির পিতার শোনিতধারা, যিনি কখনো বিন্দুমাত্র অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি, তার পক্ষে এই ঘোরতর অন্যায়ে চুপ করে থাকা কী সম্ভব? না। অসাধারণ চিত্তধৈর্য দেখিয়ে মিথ্যা মামলা আইনগতভাবে মোকাবিলার জন্য তিনি চৌদ্দই এপ্রিলের মধ্যে দেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন। কিন্তু অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার দেশে ফিরে আসায় জারি করে দিল নিষেধাজ্ঞা। যেই দেশকে কেন্দ্র করে তার জীবন আবর্তিত হয়েছে, যে দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে বারবার প্রাণনাশের হুমকির মুখে পড়েছেন, যে দেশ এই মর্ত্যে তার কাছে  মহর্লোক সাদৃশ্য, সেই দেশে প্রত্যাবর্তনে নিষেধাজ্ঞায় তিনি ব্যথিত হলেন, তবু একটুও দমে যাননি। অকুণ্ঠচিত্তে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন, ‘কোনো শক্তি আমাকে দেশে ফিরতে বাধা দিতে পারবে না। আমি আমার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালাব এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখব।’
বঙ্গবন্ধু কন্যার এই লৌহকঠিন ঘোষণায় দখলদার সরকারের কেবল পিলেই চমকে যায়নি, তারা ভীষণ ভীতও হয়ে পড়ে। তাই তো, সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশে ফিরলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তারা হুমকি দিতে থাকে। কিন্তু শেখ হাসিনা সব হুমকি-ধমকি, সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ওই বছরের ৭ মে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এর ৭০ দিন বাদে শাসকচক্র তাঁকে মিথ্যো মামলায় গ্রেফতার করে বাংলার ইতিহাসে রচনা করেছিল আরেকটি ঘৃণ্য কালো অধ্যায়। মতিবিভ্রংসতা নয়, মনের গহীনে লালিত ক্ষমতার লিপ্সায় মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত সংবাদ পরিবেশন করে গ্রেফতারের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, যা তিনি ইতোমধ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। ওয়ান এলেভেনের সরকার যে রাতে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে গ্রেফতারের প্রস্তুতি নিয়েছিল, সে রাতে এই ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিবাদেই যেন বাদল বরিষণে কেঁদে ভাসিয়েছিল পৃথিবী। নিস্তব্ধ বিভাবরীতে সমগ্র প্রকৃতি করেছে যেন নীরব শোকের মাতম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জননেত্রীর ধানমন্ডিস্থ সুধাসদন ঘেরাও করে রেখেছিল। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশবাসী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে গিয়েছিলেন। যাতে তিনি লেখেন, ‘যে  যেভাবে আছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথা নত করবেন না। সত্যের জয় হবেই। আমি আছি আপনাদের সঙ্গে, আমৃত্যু থাকব। আমার ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। জয় জনগণের হবেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বই।
দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবই।’ তার সেই চিঠি বাঙালির মনে বুনে দিয়েছিল দ্রোহ আর স্বপ্নের বীজ। বাঙালি মানসে তিনি হয়ে উঠলেন প্রদীপ্ত শিখার মতোই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। একদিকে তার প্রতি জনতার অকৃত্রিম ভালোবাসার ফল্গুধারা বইতে লাগল আর অন্যদিকে তথাকথিত কুচক্রী সুশীল সমাজ মদদপুষ্ট ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছিল যা বাঙালির মাঝে জ্বালিয়ে দিয়েছিল দ্রোহের আগুন। নানা চড়াই-উতরাই, নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই বঙ্গবন্ধু কন্যার মুক্তির দাবিতে তারা গড়ে তুলেছিল তীব্র আন্দোলন; ফলে পাণ্ডুলামের মতো দুলতে শুরু করেছিল অবৈধ সরকারের গদি। অতপর তারা অন্যাপায় হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে মুক্তি দিলে দীর্ঘ নিশুতির পর বাংলার বুকে উচ্চারিত হয়েছিল  জয়ধ্বনি। সেই জয়ধ্বনি এখনও চলছে। কেননা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণে গণতন্ত্রকেই শুধু পুনরুদ্ধারই করেননি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজে এগিয়ে গেছেন বহুদূর। তিনি দেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায় আর নিজে হয়ে উঠেছেন জীবন্ত কিংবদন্তি এক বিশ্ব নেতায়।
লেখক: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক সাধারণ
সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft