শিরোনাম: |
পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা
|
ধীরাজ কুমার নাথ : ‘পরিবার পরিকল্পনা দেশ ও জনগণকে ক্ষমতায়ন করে’ এমন একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে উদযাপিত হয় গত ১১ জুলাই, ২০১৭ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যা যখন পাঁচ কোটিতে উপনীত হয়েছিল, তখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১১ জুলাইকে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস হিসেবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই এপ্রিল মাসে ২০১৭ বিশ্বে জনসংখ্যা উপনীত হয়েছে ৭৫০ কোটিতে এবং জনমিতির সূক্ষ্ম হিসেবে প্রতি ১৪ মাসে প্রায় ১০ কোটি লোক বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশ্বে এবং তার সিংহ ভাগ হচ্ছে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে। জাতিসঙ্গের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক বিভাগের মতে ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৯৮০ কোটি। গণচীনের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৪০ কোটি এবং ভারতের প্রায় ১৩০ কোটি। ধারণা করা হচ্ছে ভারতের জনসংখ্যা গণচীনের জনসংখ্যাকে কয়েক বছরের মধ্যেই ছাড়িয়ে যাবে এবং নাইজেরিয়া হবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্ জনবহুল দেশ।
এবারের বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে জাতিসঙ্গের আয়োজিত পরিবার পরিকল্পনা সামিট, যার নাম হচ্ছে ‘পরিবার পরিকল্পনা ২০২০ উদ্যোগ’ এবং এর লক্ষ্য হচ্ছে ১২ কোটি অতিরিক্ত মহিলাকে ২০২০ সালের মধ্যে স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে পরিবার পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসা। স্বপ্রণোদিত হয়ে নিরাপদভাবে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ হচ্ছে মানবাধিকারের অংশ। এ হচ্ছে মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গভিত্তিক সমতার নির্দশন যা হচ্ছে দারিদ্র্যবিমোচনের অন্যতম সহায়ক শক্তি। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস মোটামুটি ৫টি মুখ্য বিষয়কে মুখ্য বিবেচনা করেই উদযাপিত হয় সমগ্র বিশ্বে প্রতি বছর, যা হচ্ছে সক্ষম দম্পতিদের পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতি গ্রহণের জন্য প্রচার ও প্রসার, লিঙ্গবৈষম্য দুরীকরণ, দারিদ্র্যবিমোচন, মা ও শিশুস্বাস্থ্য সংরক্ষণ এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ। এই মৌলিক বিষয়সমূহকে দেশ ও জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বব্যাপী সক্ষম এবং দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে প্রতি বছর বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উদযাপন করা হয়। আরও সহজভাবে বলতে হয়, ছেলে এবং মেয়ে সব শ্রেণির যুবশক্তিকে ক্ষমতায়ন এবং নিরাপত্তাদানের লক্ষ্যই হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের অন্যতম ভাবনা। তাদের মধ্যে যৌন আচরণ এবং বিলম্বে বিবাহের সুফল সংক্রান্ত জ্ঞানের প্রসার, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ পরিহারের লক্ষ্যে শিক্ষাদান, পরিকল্পিত পরিবার গঠনে উদ্বুদ্ধ করে দেশের কল্যাণে জনগণকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার প্রচেষ্টাই হচ্ছে এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য। জনগণকে ক্ষমতায়নের অর্থ শুধুমাত্র আর্থিক বা সামাজিকভাবে সচ্ছল করা নয়। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে তাদের জীবনের পাঁচটি বিশেষস্তরে যেমন, প্রসবপূর্ব সময়ে, শিশুকালে, বাল্যকালে, কৈশরে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করাই এর প্রধান লক্ষ্য। তাই পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টা শুধুমাত্র একটি ধারণা নয়, এ হচ্ছে একটি জীবন দর্শন। নৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শ জীবন পদ্ধতির মাধ্যমে জীবনকে পরিচালিত করার ক্ষমতায়ন হচ্ছে নিজেকে শক্তিশালী করা এবং নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি পদ্ধতি। পরিবার পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হচ্ছে- একটি সক্ষম দম্পতিকে পরিবারের সন্তান ধারণ নির্ধারণের অধিকার প্রদান এবং এই অধিকার অর্জন করতে হলে এতদসংক্রান্ত্র জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে ব্যাপকভিত্তিক আচরণ পদ্ধতি সর্ম্পকে অবহিত করা। গণচীন অনেক দেরিতে হলেও বিষয়টি বুঝতে পেরে এক সন্তানের রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে সরে এসেছে। বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে পরিবার পরিকল্পনা বোর্ড সৃষ্টির শুরু থেকেই পরিবারের সন্তানের সংখ্যা সর্ম্পকে দম্পতির স্বাধীন ভাবনার প্রতি সন্মান প্রদর্শন করা হয়েছে ,কখনো কোনো প্রকার বল প্রয়োগের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি। তবে ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার,: ‘দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ এমন বার্তা ও উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণা পরিচালনা করা হয়েছে। বিশ্বে বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি একটি সফল কর্মসূচি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে কারণ মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা ব্যাপকভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিকল্পনার সুফল সম্পর্কে অবহিত করা ও উদ্বুদ্ধকরণের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে সঠিকভাবে। এই আচরণ পরিবর্তণের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে সমাজের জনপ্রতিনিধিগণকে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসভিত্তিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে। এছাড়া সব সময়ে সব রাজনৈতিক দলের এবং সরকারের সহযোগিতা ছিল প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশ সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে সাফল্য প্রদর্শন করে বিশ্বকে চমক দিয়েছে। এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন। এসডিজি-এর লক্ষ্য নং ৩.৭ এর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সার্বজনীন করতে হবে এবং পরিবার পরিকল্পনা তথ্য, শিক্ষা এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন এবং কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এসডিজি -২০৩০ এর মধ্যে কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও নির্ধারণ করা হয়েছে, যেমন প্রত্যেক দেশকে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লক্ষ্যে ৭০ এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১২ তে হ্রাস করতে হবে এবং ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৫ এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশে ২০১৪ সালের জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিসংখ্যানে মাতৃমৃত্যুর হার হচ্ছে প্রতি লক্ষ্যে ১৯৬ জন, সুতরাং এই পরিসংখ্যানকে ১৯৬ থেকে আগামী ১২ বছরে ৭০ এর মধ্যে হ্রাস করা সহজ কথা নয়। তেমনিভাবে নবজাতকের মৃত্যুর হার বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ২৮ যা নামিয়ে আনতে হবে ১২ তে এবং ৫ বছরের বয়সের নিচে শিশু মুত্যুর হার ৪৬ যা হ্রাস করতে হবে ২৫ জনে ২০৩০ সালের মধ্যে। এ সব লক্ষ্য অর্জন করতে হলে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহীতার হার ৬৪ থেকে বৃদ্ধি করতে হবে দ্রুতগতিতে এবং বর্তমান মোট প্রজনন হার ২.৩ থেকে হ্রাস করে নামিয়ে আনতে হবে ১.০০ এর নিচে। একইসঙ্গে নবজাতকের এবং ৫ বছরের নিচের শিশুদের মৃত্যুর হার হ্রাস করতে হলে অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হবে এবং প্রতিটি শিশুর পরিচর্চায় আনতে হবে নিবিড় তদারকি ও পর্যবেক্ষণের প্রসারিত অবকাঠামো। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের নির্বাহী পরিচালক ড. বাবাতুনডে ওসোটিমেহিনের মতে, ‘Every woman deserves safe birth. Yet every day, more than 500 women and adolescent girls die of pregnancy and child birth in humanitarian and fragile settings. Access to services, delivering safely, preventing unintended pregnancy and being safe from HIV are just as crucial as food, water and shelter. Every person is entitled to human rights without discrimination of any kind. Yet every day, people affected by crisis, face impossible choices that jeopardize their health, safety and dignity.’ এমন একটি কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এবং মা ও শিশুদের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার প্রয়োজনে শুধুমাত্র ব্যাপক তথ্যভিত্তিক উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি প্রয়োগ করে অতিদ্রুত কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন হবে সমন্বিত বহুমুখী কর্মসূচি যার লক্ষ্য থাকবে জনগণকে ক্ষমতায়ন করা, সামাজিক মূলধন সৃষ্টি করে জনগণের জীবন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন সাধন করা। একইসঙ্গে দ্রুত শহরমুখী জনগণের জীবনযাত্রার পদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধন করার প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে একীভূত ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালামের অভিমত হচ্ছে, ‘পৃথিবীর অর্ধেক জনগণ বাস করে গ্রামীণ অঞ্চলে এবং বেশির ভাগই দারিদ্র্যপীড়িত। মানব সম্পদ উন্নয়নে এমন বৈষম্য হচ্ছে অস্থিরতার অন্যতম কারণ এবং যা বিশ্বের কোনো কোনো অংশে সহিংস উগ্রবাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে থাকে।’ উগ্রবাদ, সহিংসতা এবং অসহিষ্ণুতা নিবারণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশের জনগণের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রয়োজনে জনগণকে পরিকল্পিত পরিবার গঠনে প্রস্তুত করতে হবে এবং দেশকে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম করার লক্ষ্যে সরকার ও জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা হবে সহায়ক শক্তি। লেখক : সাবেক সচিব |