শিরোনাম: |
দীপিত চৈতন্য
|
কাজী মুনমুন আক্তার লীনা : সমাজকে যে তীব্র প্রাবল্যে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তা বিস্ময়কর! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজ বিশ্বাসে থেকেছেন অনড়। তিনি জ্ঞান পিপাসাকে প্রবল করে দিয়েছেন উপযুক্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে। সংঘ তৈরি করেছেন, ছাত্রদের তর্ক করতে উত্সাহ দিয়েছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি প্রশ্ন করতে উত্সাহিত করেছেন। কৌতূহল প্রশ্ন হয়ে প্রকাশিত হয় এবং নিবৃত্তি হলো উপযুক্ত উত্তর, ন্যায়, বা সত্যের কষ্টি পাথরে যাচাই করে নেয়া উত্তর। ডিরোজিও বলেছেন কৌতুহলের যাতনা থেকে নিজ সত্তাকে মুক্তি দিতে এবং উত্তর পাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রশ্ন করতে। সার্থক হয়েছেন তিনি। জীবনকে দান করে গেছেন অকাতরে। তাইতো ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে, বারবার অর্ঘ্য দিয়েছে চেতনার বেদীমূলে
‘ডিরোজিও’ নামটির সাথে পরিচয়ের অপূর্ব আলোড়ন কতজন পাঠকের ভাগ্যে জুটেছে কে জানে! এই নামটি বহন করেছেন ২২ বছর ৮ মাস ৮ দিনের যে মানুষটি সেই মানুষটি ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় অন্য জগতে পাড়ি দেয়ার আগে নিশ্চয়ই অনুভব করেছিলেন যে তিনি জন্ম দিয়ে গেলেন এক বিপ্লবের, শোধ করে গেলেন সময়ের ঋণ। তাই তো ক্ষণজন্মা হয়ে এসেছিলেন একটি যুগকে অপরিণত চৈতন্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে। ‘শিক্ষক’ তিনি যিনি শিক্ষার্থীর জ্ঞান বাসনাকে উসকে দেন যাতে চন্দ্রাহতের মতো সে কেবল সৌন্দর্যের উত্স খুঁজে বেড়ায় আর প্রকৃতির হাত ধরে পৃথিবীর অনবরত দিনরাত্রিকে উদ্ভাসিত করে উচ্ছ্বল পরিচর্যায়। সার্থক শিক্ষক ডিরোজিও-এর আকর্ষণ সেকালের তরুণদের কাছে ছিল তৃষিত চাতকের কাছে বৃষ্টির প্রথম ফোঁটার মতো। তিনিও তো তার শিক্ষকের সার্থকতার প্রমাণ! ডিরোজিও-এর অবদান কতটুকু? তা কি পরিমাপযোগ্য? কেউ কি সংখ্যার গণ্ডিতে আটকে দিতে পারে আকাশের বিশালতা? ডিরোজিও-এর অবদানও তেমনি। সংস্কারমুক্ত মননের জমিতে তিনি বুনেছিলেন উদারতার বীজ যা মহীরুহ হয়ে ছায়া দিচ্ছিল তারুণ্যের দিগ্বিদিক অস্থিরতাকে। তরুণরা তার কাছেই পেয়েছিল মানসিক আহারের খোঁজ। তার ফলে পুষ্টি হলো চেতনার আর পরম আত্মবিশ্বাসে নিজেরাই হয়ে উঠতে চাই নিজেদের অবলম্বন। ভারতবর্ষের সক্রেটিস বললে অত্যুক্তি হবে কি? সারাজীবন ন্যায় বা যুক্তিকেই সত্য বলে মেনেছেন তাইতো অন্ধ আঘাতকে প্রতিহত করতে পেরেছেন অনায়াসেই। নিজের সময়কে ছাপিয়ে গেছেন জ্ঞানের ভেলায় ভর করে। দুর্ভিক্ষের ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলায় রেখে গেছেন পর্যাপ্ত ফসল। সমাজকে যে তীব্র প্রাবল্যে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তা বিস্ময়কর! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজ বিশ্বাসে থেকেছেন অনড়। তিনি জ্ঞান পিপাসাকে প্রবল করে দিয়েছেন উপযুক্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে। সংঘ তৈরি করেছেন, ছাত্রদের তর্ক করতে উত্সাহ দিয়েছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি প্রশ্ন করতে উত্সাহিত করেছেন। কৌতূহল প্রশ্ন হয়ে প্রকাশিত হয় এবং নিবৃত্তি হলো উপযুক্ত উত্তর, ন্যায়, বা সত্যের কষ্টি পাথরে যাচাই করে নেয়া উত্তর। ডিরোজিও বলেছেন কৌতুহলের যাতনা থেকে নিজ সত্তাকে মুক্তি দিতে এবং উত্তর পাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রশ্ন করতে। সার্থক হয়েছেন তিনি। জীবনকে দান করে গেছেন অকাতরে। তাইতো ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে, বারবার অর্ঘ্য দিয়েছে চেতনার বেদীমূলে। এই শিক্ষকের ভাব শিষ্যরা হয়তো তারুণ্যের গমকে আদর্শের জায়গা থেকে কিছুটা সরে এসেছিলেন এবং চরম নিন্দার মুখে পড়েছিলেন গুরুসহ। শাস্তি স্বরূপ তাকে কর্তাব্যক্তিদের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। কোনরকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়াই তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল হিন্দু কলেজ থেকে। শিক্ষকতার আনুষ্ঠানিকতা থেকে মুক্তি পেলেন। এরপর বেঁচে ছিলেন মাত্র আট মাস। এই সময়ে তিনি ‘দ্য ইস্ট ইন্ডিয়ান’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা সম্পাদনার কাজ করতেন। তার রচিত ‘দ্য ফকির অব জঙ্গিরা’ কাব্য পড়লেই সাহসিকতা আর দূরদর্শনেরর প্রমাণ পাওয়া যায়। এটির প্রকাশকাল ১৮২৮। এর এক বছর পরেই ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে রোধ করা হয় ‘সতীদাহ’ আইন আর বিধবা বিবাহের উদ্যোগ শুরু হয় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। বৈপ্লবিক এ কাব্য ধারণ করেছিল দ্রোহের আর্তনাদ। যার ফল হিসেবে আমরা উপরিউক্ত উদ্যোগের জন্ম লাভ দেখতে পাই। নদীর মতো চৈতন্যের গতিও রোধ করা যায় না। ইতিহাসের সোনালি পাতায় না কেবল, যাপিত প্রবাহমানতায় চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে যাওয়া মানুষের মধ্যে ‘ডিরোজিও’ একজন! ধরণীকে প্রাণ ভরে দিতে হয়, সর্বংসহা বলে মুখ ফিরিয়ে না নিয়ে স্নেহের চিত্রলিপি আঁকতে হয় তার শরীরে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভরিয়ে দিতে হয় ডালি। এ জন্য সময়ের ব্যপ্তিতে একেকজন আসেন আলোকবর্তিকা নিয়ে, অনুজদের দিয়ে যান পথ নির্দেশনা এবং সঠিক পর্যবেক্ষণ দিয়ে যাচাই করেন মূল্য। |