শিরোনাম: |
সমাপ্তির আগে
|
এম. উমর ফারুক :
শ্রাবণ মাস কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি। আবার কখন বা গতর পোড়ানো রোদ। সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু কোনো বাধাই মানছে না আদিত্য। সব কিছুকে উপেক্ষা করে ছুটছে। তাকে হাসপাতালে যেতেই হবে। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে না পৌঁছলে দেখা করা সম্ভব হবে না অনিতার সঙ্গে। ডাক্তার ঠিক সময়ের মধ্যে তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবে। কিন্তু অনিতা বলেছে অপারেশনের আগে তার সঙ্গে যেন আদিত্যের দেখা হয়। সে তাকে কিছু বলবে। তার কথাগুলো আদিত্যের জানা প্রয়োজন। কি এমন রোগ শরীরে বাসা বাঁধলো যে অনিতার পরিবারের লোকজনও তা জানে না? কেন সে পরিবারকে জানাতে চায় না? জানালে কি হত? যদি অপারেশনে তার বড় ধরনের সমস্যা হয়। ওহ ! কি টেনশন লাগছে। আদিত্য মরিয়া হয়ে ভাবছে। মালিবাগ মোড়ে এসে রিকসা থেমে গেল। মাথা তুলে দেখে সামনে যানজট। এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি গুলো। একটু নড়েচড়ে না। ওহ! কি যন্ত্রণা। ঘড়ির কাঁটা সমানতালে এগিয়ে চলছে। আর বুকের হূদপিন্ড জোরে সোরে কম্পন তুলছে। কেন অনিতা হাসপাতালে ? এখন তার দায়িত্ব পালন করতে পারছি না। ঘুম থেকে উঠতে আজও বিলম্ব হয়েছে। হবেই তো। রাত জেগে ফেসবুকে সময় কাটিয়ে ভোর বেলায় ঘুমালে তো জাগতে বিলম্ব হবেই! সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই এমন মানুষ কমই আছে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় ফেসবুক খোলার সময় হয় না আমার। রাতে বাসায় এলেই আর মন মানে না। ফেসবুক বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং করে বন্ধুদের খোঁজ খবর নেয়া যায়। অনেক তথ্য জানা যায় তাদের কাছ থেকে। আর সহকর্মী ইনামুল হক মনির বিভিন্ন গানের কলি তুলে দেয়া স্ট্যাটাস———! সে কোথায়, কি করছে ? অফিসে আসার পথে কোথায় কি দেখেছে? কার সঙ্গে দেখা হবে? অফিস শেষে সন্ধায় শাহবাগ মোড়ে অথবা ছবির হাটে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা বসাবে। এসব তার স্ট্যাটাসে প্রতিদিন পাওয়া যায়, পড়তে ভালোই লাগে। এমনই আরও কত বন্ধু——। বিশেষ করে প্রতিরাতে ফেসবুক খুলে চোখে পড়ে সরল সন্যাসীর লেখা, পোড় খাওয়া প্রেমের কবিতা। কবিতার ভাষায় সন্যাসী তার প্রেমিকাকে বুঝাতে চেয়েছে মনের গহীনে থাকা কথাগুলো। এক সময়ে বাঁধা ছিল তার পরিবার। এখন আর নেই। কিন্তু সহজ কথাগুলো সহজভাবে বুঝাতে পারছে না তার মনের রানীকে। এ কারণে তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সুয়োগ পেলেই বিরামহীন একাধিক সিগারেট টানা। বেদনার অশ্রু কপোল বয়ে পড়ে তার গাল ভর্তি দাড়িতে। সন্ধার পরে শাহবাগের ছবি হাটে উদাস মনে বসে থাকে সে। বেহালার করুন সুরের মত বেজে ওঠে সরলের কণ্ঠে এলোমেলো গান। সন্যাসীর কথা বারবার মনে পড়ছে আজ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে সাজানো গোছানো সুন্দর জীবন গড়ার স্বপ্নে এগিয়ে চলে তার প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড। খবরের কাগজে বিভিন্ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন পাঠানো ছিল প্রতিদিনের কাজের মধ্যে অন্যতম। চাকরি পরির্বতন করে নিজের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নগুলো জাগিয়ে তোলার মাঝপথে ধরা দেয় এক রমনী। জীবনের দোলাচলে কে না চায় অন্য জনের সাহস-উত্সাহ-উদ্দীপনা! হাজারো ঘটনাকে আড়াল করে তার হাত ধরতে মন থেকে সাড়া মেলে। খরা মনে ফাগুনের বাতাস শান্তির পরশ এনে দেয়। একই অফিসে চাকরির সুবাদে ওদের পরিচয়। সেই থেকে শুরু। নিজের অজান্তে অনুভূতির শেকড় রচিত হয় মনে। সেখান থেকে শাখা প্রশাখা ছড়ালেও সাহসে কুলোয় না সরলের। কোনোভাবেই যথাস্থানে মনের ভাব প্রকাশের কোন আস্থা না পেয়ে দুমড়ে-মুচড়ে যেতে থাকে। কিন্তু যাকে নিয়ে এ লুকোচুরি, যে মানুষটিকে আপন করে পাওয়ার জন্য মনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ সেই মানুষটির আর বুঝতে বাকি রয় না কিছুই। যান্ত্রিক এ শহুরে জীবনে একদিন আসে সেই মহেন্দ্রক্ষণ। স্বপ্নের সঙ্গীনির দেয়া আশ্বাসে ভরসা পায় সরল। অনিশ্চিত পথকে দু’জনে মসৃণ করার এক অদৃশ্য শক্তি নিয়ে শুরু হয় স্বপ্নীল সেই পথ চলা। ভিন্ন আমেজে ফুর ফুরে মেজাজে শুরু হয় নতুন জীবন। কিন্তু সরলের এ স্বপ্ন ভোর না হতেই ভেঙে যায়! কেন যে মানুষটি স্বপ্ন দেখিয়ে নিজ হাতেই তা ভেঙে দিল তার কারণ ভেবে পায় না প্রেমিক হূদয়। ব্যথিত মন বারবার ফিরে যায় কারণ অনুসন্ধানে। ফিরে তাকায় পেছনের দিকে। যথাযোগ্য কারণ ছাড়াই সহসা তাদের মধ্যে শুরু হয় ভুল বোঝা বুঝি। সময়ের ভাঁজে ভাঁজে অভিমানের পালা অমাবস্যার আঁধারে ঢেকে যায়। একই ছাদের নিচে বসে থাকলেও কথা নেই তাদের মাঝে। মনে পড়ে, সে বারবার সরলকে বলছিলো এ চাকরি বাদ দাও। নতুন কোন চাকরি কর। অনেক আয় করতে হবে। বাড়ি গাড়ি সবই থাকতে হবে। আমি অনেক সুখে থাকতে চাই। ইট পাথরের ঢাকা শহরে মানুষের মনে প্রেম না থাকলেও তোমার মাঝে সব খুঁজে পেয়েছি। অশুভ যন্ত্রণার মাঝেও তার এই কথাগুলো নাড়া দেয় সরলের। অসংখ্য বন্ধুর ভিড়ে নিজেকে জড়িয়ে রাখলেও তার কষ্টের গতি বোঝা যায়। কথাতে বারবার আহত করলেও ভালোবাসার যে কমতি নেই তা অনায়াসে ফুটে ওঠে তার চলনে বলনে। সরলের খেয়ালি মন তার পানে চেয়ে আছে। হয়ত ফিরে আসবে! মনের দরজায় কড়া নেড়ে বলবে আমাকে গ্রহণ করো। তোমার বাহুডোরে এমন ভাবে জড়িয়ে রাখ যেন কেউ আমাকে নিয়ে যেতে না পারে। তখন হয়ত পাল্টে যাবে সময়। গাছের সবুজ পাতাও হলুদ রঙ ধারণ করবে! কিন্তু কিছুই ঘটল না। সরল সন্যাসীর সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ বদলে গেছে। অন্য গন্ধ ভেসে আসে নাকে। কাছের মানুষ নাক চেপে দূরে সরে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রঙ্গীন জীবনের ঝাপসা অতীত। সময় বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে তার কাছে। উদাস মনে তাকিয়ে সিগারেট টানে আর বিরবির করে আনমনে কি যেন বলে যায় সরল সন্যাসী...........। রিকশায় বসে ক্লান্ত চোখে বার বার ভেসে আসে অনিতার মুখ। কত সম্ভাবনাময়ী একটা জীবন ছিল তার। আজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। অনিশ্চিত তার নিঃশ্বাস, এ কথা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার অনেক সময় কেটেছে ডাকসুর সংগ্রহ শালায়। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে অখণ্ড রূপে তুলে ধরতে সে সময়ের বিভিন্ন নিদর্শনকে ধারন করে আছে ডাকসু সংগ্রহশালা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের উল্টো দিকের একটি ভবনের নিচতলায় গড়ে উঠেছে এ সংগ্রহশালা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোকচিত্রী গোপালচন্দ্র দাসের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এটি গড়ে উঠে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে দেশের সার্বিক স্বার্থ ও দাবি আদায়ে সময়ে সময়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনতা। আর এই সব ইতিহাসের পটভূমি জুড়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সংগ্রহশালাটি থেকে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলন, বুদ্ধিজীবী হত্যা, সবশেষে ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক সময়ের স্বচিত্র নিদর্শন বুকে ধারণ করে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়কার আলোকচিত্রী গোপাল চন্দ্র দাস তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে এটি গড়ে তুলেছেন। নিজের তোলা বিভিন্ন ঐতিহাসিক ছবি এবং বিভিন্ন সময়ে মানুষের থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও ছবি দিয়ে সাজিয়েছেন ডাকসুর এ সংগ্রহশালাটি। প্রথমে স্থান সঙ্কুলান ছিল বলে এতকিছু প্রদর্শনীর জন্য জায়গা করতে পারতেন না। এখন পরিধি বাড়িয়েছেন যেন তরুণ সমাজ তার সঠিক ইতিহাসকে জানতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, ডাকসুর দেয়াল আলোকিত করে আছে ভাষা শহীদদের রঙিন ম্যুরাল ছবি। দেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে যাদের নাম আজও গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। দরজার ও পাশের দেয়াল জুড়ে আছে ২০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর ছবি ও পরিচয় যাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরে। সামনে কাচের বাক্সের ভেতরে বাংলা অক্ষর বেষ্টিত হয়ে আছে ঐতিহাসিক আমতলার সেই আমগাছটির অংশবিশেষ। ভাষা আন্দোলনের সময় এই আমতলাতেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দাবিতে গাজিউল হকের সভাপতিত্বে জড়ো হয়েছিলেন তত্কালীন ছাত্রনেতারা। তারও পাশে দেয়াল জুড়ে আছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক আলোকচিত্র, সংবাদপত্রের কাটিং, নথিপত্র। যা দর্শনার্থীদের মুহূর্তের মধ্যে সেই অগ্নিঝরা সময়গুলোতে নিয়ে যায়। অনিতার উদাস দৃষ্টি বারবার এসে আটকা পড়ত দেয়ালের ঠিক ডান পাশটাতে। দেয়ালের ওই ডানপাশেই আছে লীলা নাগের বিশাল ক্যানভাস চিত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী শিক্ষার্থী হিসেবে যিনি আজও ইতিহাসের অংশীদার হয়ে আছেন। তার পাশে বইয়ের আলমারি জুড়ে আছে ১৯৮৩ সাল থেকে প্রকাশিত ইতিহাসভিত্তিক বিভিন্ন বই, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, জার্নাল ইত্যাদি। আছে বিরল সময়ের টাকা ও ধাতব মুদ্রা। মাঝখানে আছে বঙ্গবন্ধুর পায়রা হাতে ভাস্কর্য যা দেশের শান্তি ও স্বাধীনতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এছাড়াও আছে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার ছবি ও তথ্য। আছে ডাকসু পি জি এস দের ছবিসহ পরিচয়। এ সংগ্রহশালায় আরও আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্নের ইতিহাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়কালের বিশেষ করে দেশ বিভাগ, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুথান এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্লভ সব আলোকচিত্র ও স্মৃতি স্মারক। আমার এসব দেখে সময়টা ভালই কেটে যেত। একদিন সেই সংগ্রহ শালা থেকে বের হতেই পাশ থেকে ডাক দেয় একটি মেয়ে। দেখতে যেমন সুদর্শনা তেমন স্মার্টও বটে। সংগ্রহ সালায় মেয়েটিকে দেখলেও ভালো করে দেখা হয়ে ওঠেনি কখনও। পরিচয়ও হয়নি। মেরুন রংয়ের ফতুয়ার সঙ্গে হালকা সবুজ জিন্স প্যান্ট পরায় বেশ মানিয়েছে। সেম্পু করা মেঘবতী লম্বা কেশ তার বাতাসে উড়ছে। অনিতা তার নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া লেখা করছেন। হাঁটতে হাঁটতে দুজন এসে দাঁড়াই টিএসসির সামনে। কিছু সময় ধরে কথা হয় অনিতার সঙ্গে। কনার স্টল থেকে চা’ নিয়ে দুজনে বসে পড়ি। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অনিতা বলে, অনেক দিন থেকে আপনাকে দেখলেও কথা বলার সুযোগ পাইনি। আজ পরিচয় হয়ে ও কথা বলতে পারায় ভাল লাগছে। বললাম একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া লেখা করি পরিচয় হবে না কেন। তাছাড়া বিষয় ভিন্ন হলেও আমরা তো একই বর্ষে। আমাদের মধ্যে জানা শোনা হবে এটাই স্বাভাবিক। এরপর বিভিন্ন বিভাগের স্যারদের আচরণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাদিক নিয়ে আলোচনা হয়। সম্পর্কের ভাষাও বদলে আপনি থেকে তুমিতে আসে। মধ্যাহ্নের সুর্য্যও পশ্চিমের কোলে হেলে পড়ায় সন্ধা নেমে আসে। আলোচনার ছন্দপতন ঘটিয়ে হোস্টেলে চলে যায় অনিতা। আমি চলে আসি বাসায়। মোবাইল ফোন থাকায় সময়ে অসময়ে কথা হয়। দেখা হয় মধূর ক্যান্টিনে। কিন্তু অনিতাকে মন খুলে হাসতে দেখিনি কখনও। প্রায় সময়ে উদাস থাকে সে। কোথায় যেন তার বড় ধরনের কষ্ট জড়িয়ে আছে। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি জানার। কষ্টের কথা জানতে চাইলে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য দিকে চলে যায়। ক্রমেই রহস্যের দানা বাধতে থাকে। এক সময়ে বিরক্ত হয়ে আমি আর জানতে চাইনি। মাঝে মধ্যে সে আমাকে বলত, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কেন যেতে হবে জানতে চাইলে সে এটা মেয়েলি সমস্যা বলে এড়িয়ে যেত। বলত তোমার জেনে কোন লাভ হবে না। আমি কিছু না বলেই মেনে নেই অনিতার কথা। কথা প্রসঙ্গে একদিন অনিতা বলেছিল উত্তরাঞ্চল কুড়িগ্রাম জেলার নদী বিধৌত উপজেলা চিলমারী গয়নার পটল চরে তাদের গ্রামের বাড়ি। কয়েকদফা নদী ভাঙগনে তাদের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যায়। ফলে প্রতিবেশিরা অনেকেই ওয়াপদা বাধ ও রাস্তাসহ বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। মাথা গোজার ঠাঁই না থাকায় অনিতা ও তার পরিবার তার নানা বাড়ি পাশের উপজেলা সুন্দরগঞ্জে চলে আসে। শৈশবের স্কুল, গ্রাম ও চাচা-চাচী এবং চাচাত ভাইবোনদের ছেড়ে আসতে তার খুব কষ্ট হয়েছিল। অনিতার মামা ছিলো প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। অনিতা লেখা পড়ায় মেধাবী ছিল। এসএসসি ও এইচএসসিতে ফলাফলও তার ভালো হয়। সেই ফলাফলের কারণে সবাই মুগ্ধ হয়। মামার প্রচেষ্টায় অনিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পড়ার সুযোগও পায়। প্রথমে মামা লেখা পড়ার খরচ চালালেও পরে খরচ চালাতে ব্যর্থ হন। নদী ভাঙনে সব হারানোর ফলে অনিতার বাবাও লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারে না। তাছাড়া অনিতার ছোট ভাই ও বোন আছে। তাদেরও পড়ালেখার খরচ চালাতে হয়। একটা সময়ে অনিতা দু-দুটি প্রাইভেট পড়াতো। সেই টাকায় কোনমতে চলতে হতো তাকে। অভাব অনটনের সঙ্গে সব সময়ে যুদ্ধ করলেও তাকে বোঝায় যায় না কি কষ্টে আছে অনিতা। প্রাচীন বন্দরনগরী চিলমারী। ভাওয়াইয়ার সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া “...ও.... কি গাড়িয়াল ভাই, হাকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে...”। সেই ইতিহাস ঐতিহ্যের চিলমারীতে অনিতার গ্রামের বাড়ি হওয়ায় আমি বেড়াতে যেতে চেয়েছিলাম। গান আর ইতিহাসে জেনেছি বলে চিলমারী যেতে আমার খুব আগ্রহ আগে থেকেই। অনিতা আমাকে নিয়েও যেতেও চেয়েছে। সেখানে রমনার ওয়াপদা বাঁধে তার চাচার বাড়ি আছে। দু’ তিন দিন থাকলেও কোনো সমস্যা হবে না। আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি আজও। এসব ভাবতে ভাবতে ফিরে গিয়েছিলাম অতিত দিনগুলোতে। হঠাত্ ট্রাফিকের বাঁশির শব্দে ঘোর কেঁটে গেল। গাড়ি চলছে সঙ্গে রিকশাও চলছে। কাকরাইল মোড়, জাতীয় প্রেসক্লাবের মোড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা হয়ে রিকশা দাঁড়ায় ঢাকা মেডিকেল কালেজ হাসপাতালের সামনে। রিকশাওলাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ৩য় তলায় সোজা সার্জারি ওয়ার্ডে যাই। দেখি ডাক্তার তার ডিউটি রুমে নেই। জানতে পারি অনিতার অপারেশন শুরু হয়েছে। ডাক্তার অপারেশনের কাজে ব্যস্ত। ওটি রুমের সামনে অস্থির হয়ে পায়চারি করছি। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ডাক্তার বেরিয়ে এলো। তার মুখে বিষণ্নতার ছাপ। সামনে এগিয়ে গিয়ে অনিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে কৃত্রিম হাসি দিয়ে ডাক্তার বলেন, চেম্বারে বসেন আমি আসতেছি। বিস্তারিত জানতে পারবেন। মনটা যারপরনাই খারাপ হয়ে গেল। কি করব বুঝতে পারছি না। ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এলেন। আমি অতি আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলাম অনিতার কথা। ডাক্তার সোজা কোনো উত্তর না দিয়ে বিভিন্ন উদাহরণ সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন জীবন মৃত্যুর মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছি। অপারেশন হয়েছে। কিন্তু কিছু জটিলতার কারণে পুরোপুরি সফল হয়নি। অনিতার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। আগামী ছয় ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান ফেরে তাহলে আর একটি অপারেশন করতে হবে। আর যদি জ্ঞান না ফেরে তাহলে...!!! তাহলে কি হবে ডাক্তার....? যা হবে তা ভাগ্য বলে মেনে নিতে হবে। চিত্কার করে বললাম, কি মেনে নিতে হবে ডাক্তার...?? ডাক্তার ততধিক শান্ত স্বরে বললেন, ঠিক আছে আপনি টেনশন করবেন না। দেখি, আমাদের হাতে তো এখনও ৫ ঘণ্টা সময় আছে। আপনি বরং অনিতার বাবা মা ও আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তারাও বিধাতার কাছে প্রার্থনা করুন। আল্লাহ নিশ্চয়ই ক্ষমা করতে পারেন। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে বারান্দায় পাঁয়চারি করছি। আর ভাবছি কিভাবে অনিতার বাবা মাকে জানাব!! আমার কাছে তো তাদের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। এমনকি মোবাইল নাম্বারও নেই। অনিতা কখনো আমাকে দেয়নি। আর জানারও তেমন প্রয়োজন মনে করিনি কখনো। কে জানে এমন পরিস্থিতি হবে। দুচিন্তায় সময় কাটে না! ৫ ঘণ্টা যেন ৫ দিনের মতো মনে হচ্ছে। ঘড়ির কাটাও যেন আস্তে চলছে। মনের ভেতরে অস্থিরতা বাড়তে থাকে! আজ আকাশেরও মন ভালো নেই। কালো মেঘ বাসা বেঁধেছে আকাশের বুকে। যে কোনো মুহূর্তে আবার বৃষ্টি নামতে পারে। মনে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে অনিতা আমাকে কি বলতে চেয়েছিল? নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে, কেন রাত জেগে থাকলাম? কেন সকালে অপারেশনের আগে অনিতার সঙ্গে দেখা করতে পেলাম না? কেন তার কথাগুলো শোনা হলো না? কি কথা বলতে চেয়েছিল সে? জ্ঞান ফিরলে অনিতার সঙ্গে দেখা করে আগে জানতে চাইব সে আমাকে কি বলতে চেয়েছিল? কেটে গেল ৬ ঘণ্টা। ডাক্তার ওটি রুমে আছে। বের হচ্ছে না। ওটি রুমের সামনে অপেক্ষা করছি। হূদপিণ্ডের কম্পন বেড়ে যাচ্ছে!! কোন দুর্ঘটনা হলো কি-না? ডাক্তার আসছে না কেন!! দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন ডাক্তার। আমি ছুটে গেলাম তার কাছে। জানতে চাই অনিতার অবস্থা সম্পর্কে। ডাক্তার কোনো কথা বলে না। নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আবারও জিজ্ঞাসা করি অনিতার কি জ্ঞান ফিরেছে? ডাক্তার আমার ঘাড়ে তার হাতটি রেখে ঠোট চেপে জবাব দেন, মিঃ আদিত্য শান্ত হউন!। সব কিছুই উপরওয়ালার হাতে। অনিতাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি!!-সরি!!! আমাকে আর প্রশ্ন করবেন না প্লিজ! আমি হতভম্ব হয়ে মেঝেতে বসে পড়ি, ডাক্তার সাহেব মৃদু গতিতে তার চেম্বারের দিকে হেটে যাচ্ছেন...!! আমার অপরাধি মন উদাস দৃষ্টিতে অনিতার অপারেশন থিয়েটারের দিকে অপলক তাকিয়ে আছি... ক্ষমা করো, আমায় ক্ষমা কর!!!! আদিত্যকে ক্ষমা করে দিও অনিতা!!! |